গল্প- এক চিলতে আকাশ

এক চিলতে আকাশ

-পারমিতা ভট্টাচার্য

 

লাবনী ছিল মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। অনেক কষ্ট করে ওর বাবা বিজন বাবু ওকে লেখাপড়া শিখিয়ে ছিলেন।লাবনী মধবিত্ত ঘরের মেয়ে হলেও তার বাবা কখনও তাকে মাথা নিচু করে বাঁচতে শেখান নি। তাই লাবনী ছিল আত্ম-সচেতন মেয়ে। অনেক কষ্ট করে বিজন বাবু তার বিয়ে দিয়েছিলেন নামী অফিসে কর্মরত অর্ণবের সাথে। মা- ছেলের ছোট্ট সংসার। ফ্ল্যাটের চারিদিকে নান্দনিক শৌখিনতা, অর্ণবের আর্থিক সচ্ছলতার জানান দেয়। তবে লাবনী মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, আর্থিক প্রাচুর্যতায় ভরপুর সংসারে মানাতে তার একটু অসুবিধা হবে বইকি। তার বাবা জীবনেও কোনও দিন মদ ছুঁয়েও দেখেননি, সেখানে অর্ণবের লাগাম ছাড়া জীবন – মদ, পার্টি, সঙ্গিনী আর তার সাথে প্রতি রাতে টালমাটাল পায়ের একটা মানুষ। এর সাথে যুক্ত হয় প্রতি রাতে লাবনীর সাথে পশুর মত ব্যবহার। নিজের আত্মসম্মান বোধ জলাঞ্জলি দিয়ে লাবনী সব মেনে নিয়েছিল শুধু নিজের বাবা –মা’র কথা ভেবে। মাঝে মাঝে খুব মন চাইতো রুখে দাঁড়াবার জন্য। কিন্তু পরক্ষণেই বাবা- মা’র মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলেই সে নিজেকে শান্ত করে নিত।

এভাবেই ভালোয়- মন্দে কেটে যাচ্ছিল লাবনীর জীবন। হঠাৎ একদিন খুশির খবর বয়ে আনল অর্ণব লাবনীর কাছে। অর্ণবদের অফিস থেকে ট্যুরে শিমলা যাবার প্ল্যান হচ্ছে। তাই এই ট্যুরে অর্ণব লাবনীকেও সাথে নিয়ে যেতে চায়। উদ্দেশ্য হানিমুনটাও সেরে নেবে ওরা। অবশেষে ওরা এসে উপস্থিত হল শিমলাতে। উফফ কী সুন্দর দৃশ্য চারিদিকে। লাবনীর শরীরে –মনে একটা অদ্ভুত ভাললাগা মিশে যাচ্ছে। তাই হোটেলের রুমে ঢুকেই সে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। পাহাড়ের অপরূপ রূপ দেখে সে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ধরা দিলো প্রকৃতির কাছে। সন্ধ্যাবেলা ওরা দু’জনে একটু ঘুরতে বেরল। সবাই আগেই চলে গিয়েছিল। ওরা একটু দেরি করেই বেরল একটু নিজেদের মত সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে। ঘুরতে ঘুরতে ওরা ম্যালে এসে হাজির হল। শিমলা কালীবাড়ি থেকে দূরের পাহাড়ের রাতের দৃশ্য দেখে লাবনী মুগ্ধ হয়ে গেল। এই তো তার স্বপ্নের স্বর্গ রাজ্য। রেলিং ধরে সে একদৃষ্টে দেখতে থাকে রাতের পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য। সে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে অর্ণব কখন তার পাশ থেকে চলে গেছে সে টেরও পায়নি। হঠাৎ তার মনে হল অর্ণব তো তার পাশে নেই। সে চারিদিক দেখতে লাগলো, কোথায় অর্ণব? এখানের কোনও রাস্তাঘাটই সে চেনে না। কোথায় খুঁজবে তাকে? এদিকে রাত বাড়ার সাথে সাথে ম্যালও ফাঁকা হচ্ছে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে সে দেখতে পেল অর্ণব তার বন্ধুদের সাথে একটা বার থেকে বেরোচ্ছে। অর্ণবকে দেখেই সে রাগে ফেটে পড়লো। কিন্তু বন্ধুদের সাথে থাকায় লাবনী একটা কথাও সেই মুহূর্তে বললো না। অন্যদিকে অর্ণব এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন সে কিছু অন্যায়ই করেনি। ওদের অফিসের ম্যানেজার ওদের সাথে আসেননি। পরে এসে যোগ দিয়েছেন ওদের সাথে। বয়সে অর্ণবদের বয়সীই হবে। অর্ণব পরিচয় করিয়ে দিলো লাবনীর সাথে। নাম অখিলেশ বসাক। এতদূর ঠিকই ছিল। কিন্তু সেই ছেলেটি আচমকাই লাবনীর সাথে হাত মেলানোর উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলো লাবনীর দিকে। লাবনীও সৌজন্যতাবশত হাত বাড়ালে ছেলেটি লাবনীর হাতে আলতো করে চাপ দিতে থাকলো আর আঙুলে করে হাতে বিলি কাটতে লাগলো। এক ঝটকায় লাবনী তার হাতটা ছাড়িয়ে নিতেই ছেলেটি লাবনীর কানের কাছে বলল – ‘যা তোমার ইচ্ছা।‘ এতো শীতেও তার কান মাথা গরম হয়ে উঠল ছেলেটির ব্যবহারে।

সেদিন রাতে লাবনী একটু রাগারাগিও করলো অর্ণবের সাথে এই সব ব্যাপার নিয়ে। রেগে সেই যে অর্ণব রুমের বাইরে বেরল আর ফিরল না। বন্ধুদের সাথে মদের আড্ডায় মিশে গেল সে। লাবনী ভাবে এই তার হানিমুন? এটা আসলে বাড়ির বাইরে রাত্রি যাপন ছাড়া আর কিছুই নয়। হঠাৎ মাঝরাতে কলিং বেলের আওয়াজ শুনে সে তাড়াতাড়ি দরজা খোলে, ভাবে অর্ণব এসেছে বুঝি। দরজা খুলে দেখে, কোথায় অর্ণব? সামনে দাঁড়িয়ে আছে ম্যালের সেই ছেলেটি— যে লাবনীর হাতের স্পর্শে মোহিত হয়ে গিয়েছিল। কিছু না বলেই ছেলেটি মানে অর্ণবের অফিসের ম্যানেজার ঘরে আচমকাই ঢুকে দরজা ভিতর থেকে লক করে দেয়। চিৎকার করতে গিয়েও লাবনী চুপ করে যায় কারণ সে বোঝে তার চিৎকারে কেউ আসবে না তাকে সাহায্য করতে। এরপর ছেলেটি লাবনীর হাত ধরে টেনে নিজের বুকের কাছে আনতে চাইলে সে সজোরে একটা থাপ্পড় কষায় ছেলেটির গালে। অপ্রত্যাশিত থাপ্পড় খেয়ে ছেলেটি ঘুরে বিছানায় গিয়ে পড়ে। এরপর লাবনীর মাথায় আসে কলেজে পড়ার সময় থেকেই তার পার্সে সবসময় আত্মরক্ষার জন্য ব্ল্যাক পিপার স্প্রে থাকে। তড়িঘড়ি লাবনী পার্স থেকে সেটা বের করে পিছনে লুকিয়ে রাখে। এরপর ছেলেটি আবার উঠে তার দিকে এগিয়ে এলেই লাবনী তার চোখ লক্ষ্য করে সেটি স্প্রে করে দেয়। আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছেলেটি। এই ঘটনার পর লাবনী ভালোই বুঝতে পারে তাকে শিমলা আনার উদ্দেশ্যটা অর্ণবের আসলে কী? শুধুমাত্র নিজের প্রোমোশনের জন্য নিজের স্ত্রীকে নিজের হাতে ভোগ করতে দেয় অফিসারের হাতে। এসব ভেবে গা গুলিয়ে ওঠে লাবনীর। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল।

পরদিন তাদের ফেরার পালা। সকালে ঘরে এসেই অর্ণব এক চড় কষালো লাবনীর গালে, তার সুবর্ণ সুযোগ প্রোমোশন আটকে যাবার জন্য। লাবনী একটা কথাও বলল না প্রতি উত্তরে। কারণ,তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়ি ফিরে তার অনেক কাজ বাকি। লাবনী একেবারে স্থির হয়ে গেছে শুধু এই কথা ভেবে যে, মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের বড়লোক স্বামীরা এই ভাবে ব্যবহার করে উচ্চপদ হাসিল করে? আজ তার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন জাগে। অর্ণবও কিছুটা স্তম্ভিত এতো পরিণত লাবনীকে দেখে। এই অচেনা লাবনীকে দেখে একটু হলেও অর্ণবের বুক কেঁপে ওঠে।

লাবনী শিমলা থেকে ফিরে জরুরী কাজ আছে বলে ষ্টেশন থেকেই বাপের বাড়ি চলে যায়। লাবনীর বাবা-মা তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় অনেক দিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে। কিন্তু পরদিনই লাবনী যখন তার বাবার কাছে তাঁর অ্যাডভোকেট বন্ধু নন্দলাল পাঠকের ফোন নম্বর চেয়ে বসে তখনই তার বাবা-মায়ের কপালে চিন্তার গভীর রেখা ফুটে উঠে।

সেদিনের ঘটনার পর অর্ণবের অফিসের ম্যানেজার মিঃ বসাকের চরিত্রের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। কারণ এতদিন তিনি অবলা নারীকেই দেখে এসেছেন। কিন্তু লাবনীকে দেখার পর তিনি দেখলেন নারীর প্রতিবাদী রূপ। এই ঘটনার পর মিঃ বসাকের যতটা না নিজের উপর ঘৃণা বোধ জন্মাল তার থেকে বেশি ঘৃণা হল অর্ণবের উপর। কারণ যে ব্যক্তি নিজের প্রোমোশনের জন্য এতটা ঘৃণ্য কাজ করতে পারে, সে ব্যক্তি কখনই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনা। তাই মিঃ বসাক অর্ণবকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন এবং অর্ণবের হাতে ধরিয়ে দেন বরখাস্তের চিঠি। অতো টাকা মাইনের চাকরী হারিয়ে যখন পাগলপারা অর্ণব ঠিক তখনই একদিন পোস্টম্যান অর্ণবের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে যায়। সেটা খুলে অর্ণবের মাথায় বজ্রাঘাত পড়ে। লাবনী বিবাহ বিচ্ছেদের চিঠি পাঠিয়েছে। অতিরিক্ত লোভ তাকে পথের ভিখারি করে দিলো। অন্য দিকে লাবনী নিজের মতো করে বাঁচার এক চিলতে আকাশ পেয়ে তানপুরায় গান ধরে – ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু——‘ শুরু হয় তার জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।

সমাপ্ত

Loading

Leave A Comment