রাধার জিত
– সোহিনী সামন্ত
দশ বছর হল রাধার বিয়ে হয়েছে। রাধার স্বামীকে কর্মক্ষেত্রের জন্য মাঝে মধ্যেই বাইরে যেতে হয়। তার বড় নিঃসঙ্গ মনে হয়। রাধার শাশুড়ি সেকেলে মনের মানুষ। রাধা আগে গান, নাচ শিখতে যেত। কিন্তু তাতে শাশুড়ির বড় আপত্তি। আর বাইরে কোন ছোট প্রোগ্রাম করলে তো রেগে যা না তাই বলেন।
“কি গো বৌমা কোথায় গেলে? দুপুর তো বয়ে গেল কখন খেতে দেবে?” বলে উঠলেন মালিনী দেবী। মালিনী দেবী রাধার শাশুড়ি মা। রাধা একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল, “এই তো যাচ্ছি মা, এখনি আমরা খেতে বসব..” যেই বলা সেই কাজ। রাধার রান্নার হাত বড় ভাল। মালিনী দেবীর তো খুব আনন্দ। ইলিশের ভাপা আর চিংড়ির মালাইকারী একেবারে জিভে জল নিয়ে এসেছে। রাধার নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সঙ্গী হল তার শাশুড়িমা। তবে তার সাথে মনের মিল করা সম্ভব হয় না। উনি বউমার পছন্দ বুঝতে চান না। রাধা খেতে খেতে হঠাৎ বলে উঠল, “মা বলছি কি, আমার মা একবার ফোন করেছিল। যেতে বলেছে আমাকে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে যাব।”
-“তা আর বলতে। তোমার আপন মা যখন ডেকেছে যেতে হবে বইকি। তবে বেশিদিন থাকা চলবে না। নাতি নাতনির ঝামেলা নেই সে বুঝলাম। কিন্তু হঠাৎ করে যদি ছেলে বাড়ী চলে আসে?”
-“মা ও নিয়ে ভাবছেন কেন? ওঁর সাথে ফোনে কথা বলেই যাব।”
-“ঠিক আছে। বেয়ানকে আমার শুবেচ্ছা ও প্রণাম জানিও।”
-“হ্যাঁ, মা..”বলে রাধা নিজের বাড়ীর কাজে মগ্ন হয়ে গেল। কিছুদিন হল তার স্বামী রাকেশ একটা ফোন উপহার দিয়েছে।মোবাইলে নানা আঁকা ছবি দেখতে রাধার খুব ভাল লাগে। তার আঁকা শেখার খুব ইচ্ছে তবে শাশুড়িকে বললে ঝামেলা বাঁধিয়ে দেবে। তাই আর সাহস পায় না।
বাপের বাড়ী যাওয়ার দিন এগিয়ে আসে। মালিনী দেবীকে প্রণাম করে রাধা যাত্রা শুরু করে। পৌঁছিয়ে মা’কে দেখে নিজের আবেগ আর ধরে রাখতে পারে না।
মাকে জড়িয়ে ধরে রাধা কাঁদতে থাকে। রাধার মা মৌসুমীদেবী বলেন, ‘কি হল রে এমন ফুঁপিয়ে কাঁদছিস কেন?”
-“ভালো লাগে না। বড় একা লাগে মা। শাশুড়ি মা তো আমার সব স্বাধীনতা কেড়ে নিল।” ফুঁপিয়ে ওঠে রাধা।
-“কি হয়েছে পরিষ্কার করে বল?”
-“কি আর বলব– নাচ, গান, আঁকা কিছুই উনি পছন্দ করেন না”।
-“উফ চল আর কান্নাকাটি করতে হবে না। ফ্রেশ হয়ে কিছু মুখে দিয়ে জিরিয়ে নে, তারপর কথা হবে”।
বিকেল হতে রাধা বাজারে যায়। নিজের কিছু কেনাকাটা করে ফিরে আসে।
মায়ের বিছানার কাছে বসে কি যেন ভাবতে থাকে।
মৌসুমিদেবী বলেন, “শোন তোর সমস্যার সমাধান আমি করে দিচ্ছি। পাশের বাড়ীর মাণিক বড় আঁকার মাস্টারমশাই। তার সাথে কথা বলেছি। তুই সময় পেলে এখানে চলে আসবি। আমি মানিককে বলে রাখব, ও এসে তোকে আঁকা শিখিয়ে যাবে। টাকা পয়সার কথা চিন্তা করতে হবে না। আর তোর শাশুড়ি মাকে এ ব্যাপারে জানাতে হবে না।”
মায়ের কথা শুনে রাধা যেন মনে শক্তি পেল। নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে পেল।
এমন করেই দিন কাটতে লাগলো। মাঝে মাঝেই সে বাপের বাড়ী যেত, আঁকা শিখে আসতো। রাধার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগল। একদিন সে বড় শিল্পী হবেই এমন স্বপ্ন সে দেখতে লাগল।
কিছুদিন আঁকা শেখার পর মাণিক বাবু বললেন, “রাধা, আমাদের এখানে আঁকার প্রদর্শনী হবে, তুমি আঁকা দিও।”
রাধার চোখে আনন্দে জল চলে এল। এমন সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় না।
প্রদর্শনীর দিন চলে এল । রাধার তার আঁকা জমা দিয়েছে। সারি সারি কত ছবি লাগানো আছে। আজ রাধা এসেছে, কিন্তু সে একা আসেনি, সঙ্গে করে মা ও শাশুড়ি মা’কেও নিয়ে এসেছে। শাশুড়ি মা একদম আশ্চর্য হয়ে বলল, “কে মা আমাকে এত সুন্দর করে এঁকেছে? এতে তো তোমার নাম লেখা!! তুমি এত সুন্দর আঁকতে পারো। মুগ্ধ আমি মুগ্ধ। এবার থেকে তুমি আঁকা শিখবে; আমি কোন বাঁধা দেব না। অনেক বড় হও তুমি। অনেক আশীর্বাদ।”
এই কথা শুনে রাধা কেঁদে ফেলল। আজ থেকে তার সুখের দিন যাপন শুরু হল।