অণু গল্প -তিন কন্যা

তিন কন্যা
-অঞ্জনা গোড়িয়া

 

পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। ছটপট করছে আমিনা বিবি।মরোদটা বাড়ি ফিরেই লাথি মেরে ধাক্কা দিল দরজায়। ভাঙা কপাটটা আছড়ে পড়ল পায়ে। যন্ত্রণার ওপর যন্ত্রণা। ওমা গো, বলে চেঁচিয়ে উঠলো আমিনা।
ছোট মেয়েটা আঙুল চুষে চুষে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে। বুঝতেই পারেনি সে। বড় মেয়েটা ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে চুপটি করে শুয়ে আছে। আর আমিনা নিজের যন্ত্রণা চেপে রেখে সকাল থেকে মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে। এখন আর পারছে না সইতে এ যন্ত্রণা। তার ওপর পায়ে দরজার আঘাত। আর কত সহ্য করবে বেচারিটা।
জুয়া খেলে সব খুইয়ে ঘরে ফিরেছে মদ্যোটা। হাতের শেষ সম্বল চুড়িদু’খান খুলে নিয়েছিল জোর করে। বলে গিয়েছিল আজ হিঁদুদের কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা। দেখবি ঠিক ঘরে লক্ষ্মী আনবো। একদম ভাবিস না।
কাল তোকে ঠিক হাসপাতালে নিয়ে যাবো। সব বেদনা কমে যাবে। আজ রাতটা সহ্য করে থাক। সারা দিন পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে৷ কিছু পান্তা ছিল। তাই সকালে মেয়েদু’টি খেয়েছিল লঙ্কা মেখে।
আবার একটা রাত। আবার একটা দিন। কাল যে কি করে দিন কাটবে আমিনা জানে না?
আল্লার দয়ায় দু’টোকে খেয়ে পরে দিব্যি চলছিল। দু-দু’টো মেয়ে হওয়ায় বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকতো। তবু দিন চলে যেত কোনো ক্রমে।
হঠাৎ কিছু দিন পর আবার আমিনার মাথা ঘোরা শুরু হলো। বমি বমি ভাব দেখে স্বামীর মনে খুশি আর ধরে না। পীর বাবার কাছে মানত ও করে এল দু’জনে। ছেলে হলে আবার আসবে আল্লাহর কাছে দয়া নিতে।
আমিনাকে হেলথ সেন্টারে দেখাতে নিয়ে গেল। ডাক্তার সব কিছু পরীক্ষা করে জানিয়ে দিল, পেটে কোনো বাচ্ছা নেই। ঠিক মতো না খেয়ে খেয়ে পেটে পিত্তি জমেছে। হয় এপেন্ডিক্স হয়েছে নয় তো বড় কিছু হয়েছে। আল্টাসনোগ্রাফি না করলে জানা যাবে না। সেই দিন থেকে আমিনার বর আরও বিগড়ে গেল। টাকা রোজকারের জন্য যত রকমের খারাপ কাজ আছে, সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করলো। নইলে এত টাকা আসবে কোথা থেকে? চিকিৎসা খরচই বা আসবে কি ভাবে? লোভ আরও বেড়ে গেল। আরও পাপ বাড়লো। নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বসান্ত হলো। একদিন মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে বলল, বাড়িটুকুও বন্ধক দিয়েছি। জুয়া খেলার আর কিছুই নেই।
কাল নিশ্চয় জিতব। অনেক টাকা আনব।
আমিনা পাথর হয়ে গেল। ঘরহীন সহায় সম্বলহীন হয়ে আজ পুরোপুরি নিঃস্ব।
ভোরের আলো জ্বলে উঠেছে। নীল আকাশ রামধনু রং এ রঙিন হয়েছে।
ঘরের দরজা ভাঙা। কেউ নেই ঘরে।
আমিনার মাতাল বরের নেশা এতক্ষণে কেটে গেছে। চারিদিকে খোঁজ করল। কেউ কোথাও নেই। কপাল চাপড়ে বসে পড়ল। কোথায় গেল ওরা?

পুলিশ এসে খবর দিল, বড় রাস্তায় মোড়ে ট্রেন লাইনের পাশে তিনটি ট্রেনে কাটা লাশ পাওয়া গেছে।
কতকটা আমিনার মতো। আর দু’টো মেয়ে।
কে জানে কে? অন্ধকারে মাথাটা বাড়িয়ে দিয়েছিল লাইনে। আর দু’টোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল রেলের সামনে…সব শান্ত। আর কেউ কাঁদবে না খিদেয়। কেউ যন্ত্রণায় ছটপট করবে না। শান্তিতে ঘুমাচ্ছে তিন কন্যা।

Loading

Leave A Comment