গল্প- বন্ধু

বন্ধু

-পায়েল সাহু

 

 

॥১॥

অনেকদিন বাদে রুপসা আজ ডায়েরি লিখতে বসেছে ।অদিতির কথা মনে পড়লেই তার মনটা কষ্টে ভরে যায় ।অবাক্ হয় নিজেই ,মানুষ এত পাল্টে যেতে পারে ? কি করে সম্ভব ??আজ অদিতির কথাই সে লিখবে ঠিক করেছে ,অনেক অনেক মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে অদিতির সঙ্গে ,সেগুলো আর মনে করতে চায়না এখন আর রূপসা ,কি হবে মনে করে ?সেই তো শেষ পর্যন্ত চোখে জল এসে যাবে ।

রূপসা বাবা মা র একমাত্র মেয়ে ।খুব আদুরী ।এমনিতে শান্ত তবে বন্ধুদের সঙ্গে পেলে খুব পাগলামি করে ,মজা করে । একদম ছোট্ট বেলা থেকে তার বন্ধু অদিতি । রূপসা আর অদিতি দুজনেই পড়াশোনায় বেশ ভালো । দুজনেরই দুজনের বাড়ি আসা যাওয়া ,খাওয়া ,দুজনের জামা বদল করে পরা এমনকি জুতো টা অব্দি অদল বদল করে পরতো ওরা । দুজন দুজনের নয়ন মনি ছিল ,এতটাই ভালবাসা ছিল ওদের মধ্যে ।দুজনের মধ্যে রূপসা বেশ দিদিগিরি চালাতো অদিতির ওপর আর সেও সব কিছু হাসি মুখে মেনে নিত ।
দেখতে দেখতে ওরা মাধ্যমিক পাশ করে গেলো । রূপসার বাবার একটু নামী স্কুলে পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও অদিতির বাবার নামীদামী স্কুলে পড়ানোর ক্ষমতা হবেনা বলে রুপসা বাবার কথায় রাজি হয়না । দুজনে একই স্কুলে ভর্তি হয় একই সাবজেক্ট নিয়ে । ওদের দুজনকে আলাদা করা কি অতই সহজ ?
॥২॥
১১ক্লাসে ওঠার পর পরই অদিতির জীবনে প্রেম আসে এবং এক্ নয় একাধিক ।
যাকেই অদিতি দেখত তারই প্রেমে পড়ে যেতো আর এই জন্য কম বকা খায়নি সে রূপসার কাছে ।কিন্তু অদিতির প্রেমিকদের মধ্যে তার কোচিং এর একটি ছেলেও ছিল ,যে বিভিন্ন সময় নানা অছিলায় অদিতির শরীর স্পর্শ করতে চাইত এবং এই সব ব্যাপারে অদিতিও খুব উৎসাহী ছিল ।সে খুব পছন্দ করত এসব শারীরিক ভালবাসা আর রূপসার কাছে বকুনি খাবে জেনেও তাকে এসে সব বলত ।রূপসা বহু বার সাবধান করেছে অদিতিকে কিন্তু এই একটা ব্যাপারে রূপসার কথা শুনতে চাইতো না তার মনে হত রূপসার কোনো প্রেমিক জোটেনি বলেই বোধহয় সে তাকে এসব শারীরিক সম্পর্কের কথা শুনে হিংসা করে ।অদিতি তার প্রেমিক ছেলেটিককে এই সব কথা বলেও দিতো । তবে অদিতি সব সময়ই রূপসাকে নিজের বোনের মতই ভালোবেসে এসেছে ।এই ভাবে দিন যায় ।তারা দুজনে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যথারীতি একই কলেজে ভর্তি হয় । রূপসার কথা মত রূপসাকে সঙ্গে নিয়ে তবেই অদিতি কলেজে পৌঁছতো কারণ বরাবর গার্লস স্কূলে পড়া রূপসা ছেলেদের সামনে স্বাভাবিক হতে পারত না ,যথারীতি অদিতির সে সব ব্যাপার ছিলনা।ছেলে বন্ধুদের কাছ থেকে রোজ ক্যান্টিনে খাওয়া ,ওদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া ,একসঙ্গে বাড়ি ফেরা ,এক্ কথায় অদিতি কলেজের ছেলে বন্ধুদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ।তবে রূপসা এসব ক্ষেত্রে অদিতিকে সবসময় এড়িয়ে চলত ,আর অদিতিও জোর করত না রূপসাকে ।

॥৩॥
হঠাৎ অদিতির বিয়ের প্রস্তাব আসে আর তার মা বাবাও খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েন এই সমন্ধের ব্যাপারটায় । অদিতি নিজেও এই ব্যাপার টায় খুব আনন্দ পেলেও পড়ে মহা চিন্তায় ।কাকে বিয়ে করবে সেটা ঠিক করতে না পেরে সে রূপসাকে বলে “কি করি বলত ?কোন ছেলেটা বেশি ভাল রে ?” রূপসার খুব হাসি পেলেও সেদিন সে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে ছিল অদিতির দিকে ,রূপসার দিকে তাকিয়ে অদিতিও ভয়ে চুপ করে গেছিলো ।আজও কথাটা মনে পড়াতে রূপসা একটু হেসে নেয় ।
আসলে ততদিনে কলেজেও বেশ কয়েকটি প্রেমিক জুটিয়ে ফেলেছিল অদিতি,তাই বেচারী দ্বন্দ্বে পড়ে গেছিলো ।সেদিন রূপসা পরামর্শ দিয়েছিলো কোচিংয়ের প্রেমিক ছেলেটির সঙ্গে কথা বলার । সেই মত দুই ব্ন্ধু গিয়ে হাজির হয় ছেলেটির সঙ্গে দেখা করার জন্য ।বিয়ের কথা শুনে হেসেই উড়িয়ে দেয় ছেলেটি ,বলে যে অদিতির মত এরকম ঝাঁটার কাঠির মত মেয়েকে বিয়ে করে কি সুখ পাবে সে ,যার শরীরে নারীত্ব ফুটে বেরোয়নি এখনো ? তার সব পরখ করে দেখা হয়ে গেছে ,প্রেম ট্রেম যা ছিল ভুলে মা বাবার দেখা পাত্র কে বিয়ে করে নিতে ।চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরে আসে অদিতি।সঙ্গে রূপসা ,সেদিন তার চোখেও জল ।

॥৪॥
শুভ দিন দেখে বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো অদিতির ।
বিয়ের আগে অদিতি তার হবু বরের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়েছিল রূপসাকে ।সেই হিসেবে অদিতির বর অনিকেত আর রূপসা দুজনেই পরিচিত ।বিয়ের দিন সন্ধে বেলা বর এসেছে ,তবে বর যাত্রী খুব কম ,এমনকি বরের কোনো বন্ধুও আসেনি।রুপসার সাজগোজ করতে গিয়ে বিয়ে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে এত দেরী হয়ে যায় যে সে গিয়ে দেখে ততক্ষণে বরযাত্রীরা এসে গেছে । রূপসা অদিতির সঙ্গে দেখা করে নতুন বরের সঙ্গে যায় আলাপ করতে ।হবু বর তখন তার জন্য সাজানো আলাদা ঘরে আধশোয়া ,২/৪ জন ছোট ছেলে ছাড়া আর কেউ ছিল না সেই সময় সেখানে । রূপসা গিয়ে নিজের পরিচয় না দিয়ে অনিকেতের সঙ্গে কথা শুরু করতেই রূপসার দিকে অদ্ভুত চাউনিতে অনিকেত বলে ওঠে তুমি তো আমার রুহ (প্রাণ ) ।
প্রিয় বান্ধবীর হবু স্বামীর ওই অদ্ভুত চাউনির সামনে দাঁড়িয়ে অস্বস্তি হতে থাকে রূপসার,একদমই পছন্দ হয় না বরবেশে বসে থাকা মানুষটিকে । বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে সে চলে আসে অদিতির কাছে।অদিতির বিয়ে হয় বেশ অবস্থাপন্ন ঘরে ।বিয়ের পর যদিও কলেজে যাওয়ার অনুমতি মেলে না ,বাড়িতে বসেই পড়ে পরীক্ষা দিতে হবে অদিতি কে ,তার শ্বশুরবাড়ির এমনটাই কথা ।
॥৫॥
রূপসার ভীষণ একা একা লাগে আজকাল ।বন্ধুর অভাব নেই তার তবু অদিতির জন্য মন খারাপ হয় ।মাঝে এক্ দু দিন গিয়ে দেখা করে এসেছে কিন্তু অনিকেতের মায়ের পাহারায় তেমন ভাবে কথা বলার সুযোগ হয়নি অদিতির সঙ্গে ।
বিয়ের ২ মাস পর অনিকেতের বদলি হয়ে যায় মধ্যপ্রদেশে।যথারীতি অদিতিও তার সঙ্গে চলে যায় ।এরই মাঝে একদিন দুই বন্ধু ফোনে গল্প করছে হঠাৎ অনিকেত ফোনটা কেড়ে নেয় অদিতির হাত থেকে ।রূপসা স্পষ্ট শুনতে পায় অনিকেত অদিতি কে বলছে “তুই এখান থেকে যা “। এরপর রূপসাকে অনিকেত বলতে থাকে “তোমার বন্ধুর (অদিতি ) ব্যাপারে কিছু বলোতো…কেমন যেন একটা বোকা বোকা ,নির্বোধ ,ভালো লাগে না একদম ;আমার তোমাকে সেদিন দারুন ভালো লেগেছিলো রুপসা ,যদি তোমার সঙ্গে বিয়েটা হত ,খুব ভালো হত “। রাগে ,ঘেন্নায় রূপসা শুধু একটাই কথা বলে অদিতির সম্পর্কে “আপনি বেঁচে গেছেন অদিতির মত মেয়েকে বিয়ে করে ,ওর মত ভালো মেয়ে আর হয়না “।
এতটা বলে ফোন টা রেখে দেয় ,খানিক পর আবার অদিতির ফোন ,”রূপসা তোকে অনিকেত কি বললো রে ?? দেখনা আমায় ঘর থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দরজা বন্ধ করে তোর সঙ্গে গল্প করেছে ,কি এমন কথা বলল রে “বলেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে অদিতি ।
হতভম্ব রূপসা অদিতিকে বলে” কিছু না রে ,এমনি তোকে রাগানোর জন্য অনিকেতদা এটা করলো , আমার কাছে তো তোর অনেক প্রশংসা করছিলো ,তোকে কিন্তু অনিকেতদা ভীষণ ভালবাসে “।
এর পর আসতে আসতে যোগাযোগ ক্ষীণ হতে থাকে দুই বন্ধুর ।অদিতি যেন সরে যায় ক্রমশ ,বাপের বাড়ি আসলে অবশ্যই দুই বন্ধু দেখা করত ।কিন্তু ওই টুকুই ,বরের কর্মস্থলে চলে গেলে আর যোগাযোগ রাখত না অদিতি রূপসার সঙ্গে |

॥৬॥
চার বছর পরের কথা……………
অনিকেতের ট্রান্সফার হয়ে যায় কলকাতায় ,ততদিনে একটি কন্যা সন্তানের জননী অদিতি ,আর রূপসা ঢুকেছে একটা প্রাইভেট ফার্ম এর চাকরীতে ।
অফিস যাওয়া আসার পথে প্রায় রোজই দেখা হয়ে যায় অনিকেতের সঙ্গে । অনিকেত যেন ইচ্ছাকৃত ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে রূপসার অফিসের সামনে ,রোজই একসাথে অফিস থেকে ফেরার প্রস্তাব নিয়ে । বিরক্ত লাগে রূপসার ভীষণ ,নানারকম অজুহাত দিয়ে কখনো অন্য রাস্তা দিয়ে ,কখনো একটু দেরী করে ফেরে কিন্তু কখনো কখনো অজুহাত কাজে দেয় না ,তখন একসঙ্গেই ফিরতে হয় ।
এমনই একদিন……….
অনিকেত রূপসাকে বলে “তোমার বান্ধবী অদিতি কোনো একজন ছেলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বুঝলে ! এভাবে সংসার করতে পারব না ওর সঙ্গে ,ভাবছি divorce দেব ওকে ” ,অবাক্ হয়ে যায় রূপসা ,ভাবে অদিতি এখনো সেই বিয়ের আগের মতই থেকে গেলো নাকি !!!!অনিকেত বলে চলে “তোমাকে আমার প্রথমদিন থেকেই পছন্দ রুহ , বিয়ে করবে আমাকে? ” ,কথাটা শুনে মাথায় যেন আগুন জ্বলে ওঠে রূপসার , আর সামলাতে পারেনা রূপসা নিজেকে, সজোরে একটা চড় কষিয়ে দেয় অনিকেতের গালে “বলে তোর মুখ যেন সারা জীবনেও আমাকে দেখতে না হয় জানোয়ার ” ।সারা রাত ঘুম হয় না রূপসার শুধু অদিতির ভাগ্যের কথা ভেবে ।
পরদিন সকালেই সে আর অফিস না গিয়ে উপস্থিত হয় অদিতির বাপের বাড়ি ,সবকথা বলবে বলে ।গিয়ে দেখে অদিতির চোখের তলায় কালি ,কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে যাওয়া চোখ নিয়ে বসে আছে বজ্রাহতের মত । রূপসাকে দেখে বলে ওঠে “তুই ?তুই এই কাজ করলি ? এ আমি আশা করিনি ” বলেই কাঁদতে শুরু করে ।রূপসা থতমত খেয়ে গিয়ে অদিতির হাত দুটো ধরে বলে “কি হয়েছে তোর ?কেন শরীরের এই অবস্থা ?”
তখন অদিতির মা এসে চিৎকার করে বলতে থাকেন “রূপসা তুই আর ছেলে পেলি না ?? শেষ অব্দি অনিকেত ?নিজের বোনের মত বান্ধবীর জীবনটা শেষ করতে চলে এলি ?একেই অদিতির শাশুড়ি প্রতিদিন গঞ্জনা দিচ্ছে নাতি না হওয়ার জন্য ,এমনকি মারধর অব্দি করছে ,আর তুই অনিকেতকে বলেছিস তুই ওকে বিয়ে করতে চাস ? তোরা নাকি দুজন দুজনকে ভালবাসিস “
এতো অব্দি শুনে রূপসা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা ,মাথাটা যেন ঘুরে ওঠে ,বমি পেয়ে যায় তার ।
কিছুক্ষণ বাদে একটু ধাতস্থ হয়ে শুরু থেকে সব কথা খুলে বলে অদিতি আর অদিতির মা কে ।দিশাহারা অদিতি জড়িয়ে ধরে রূপসাকে ,হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে “এখন আমি কি করব ?আমার পেটে যে আরো একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে ,আমি কি করে অনিকেতকে ছেড়ে যাব এখন ?কার ভরসায় মানুষ করব দুটো বাচ্ছাকে ? আমি তো গ্র্যাজুয়েশন টাও শেষ করতে পারিনি ,কি হবে আমার ?”
রূপসা জড়িয়ে ধরে অদিতিকে ,বলে তোকে কোনদিন নিজের বোনের চেয়ে কম ভাবিনি ,আমি আর তুই একসঙ্গে তোর বাচ্ছাদের মানুষ করব ,তোর চাকরির ব্যবস্থা আমি করব ,তুই ভাবিস না ।অদিতি এবারে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে “না রে ,তা সম্ভব নয় ,আমি অনি’কে ছেড়ে যাব না ,সে যেমনই হোক আর যাই করুক”।রূপসাকে অবাক্ করে দিয়ে অদিতির মাও অদিতির কথায় সায় দেন ।সেই শেষ দেখা দুই বন্ধুর ।আর কখনো যোগাযোগ করেনি অদিতি রূপসার সঙ্গে ।অদ্ভুত ভাবে এই ঘটনার কিছুদিন পর অদিতির দ্বিতীয় সন্তান জন্মানোর পর তার মা বাবাও বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যায় ।এমনকি অদিতির ফোন নং টাও পালটে যায় ।আর যোগাযোগ করার কোনো উপায় থাকেনা অদিতির সঙ্গে ।
কথাগুলো মনে হতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে রূপসা ,এক কলমও লেখা হয়না ডায়েরিতে ।
॥৭॥
আজ বছর খানেক হলো রূপসার বিয়ে হয়েছে , কপালগুনে বাপের বাড়ির কাছেই ,তাও আবার সম্বন্ধ করে ।বিবাহিত জীবনে খুব খুশি রূপসা ,মনের মত জীবন সঙ্গী পেয়েছে সে ।
সুস্মিত একটি বড় কম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ,পাশাপাশি সে স্বপ্ননীড় নামে একটি এন জি ও চালায় ,সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় ।সেখানে অনাথ ,দরিদ্র মেয়েদের রোজগারের বিভিন্ন উপায় থেকে শুরু করে দুঃস্থ বাচ্ছাদের পড়ানো ,তাদের খাওয়াদাওয়া ,চিকিৎসা সব কিছুই হয় ।রূপসা বিয়ের পর নিজের ইচ্ছাতেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলো মন দিয়ে সংসার করবে ভেবে ,কিন্তু অত্যন্ত ধনী তার শ্বশুরবাড়িতে তাকে কিছুই করতে হয় না ।দিন রাত বাড়িতে বসে বসে বিরক্ত রূপসা ,কখনো শপিং ,কখনো পার্লারে গিয়ে সময় কাটায় । একদিন হঠাৎ সুস্মিত বলে “তুমি যদি আমার এন জি ও র ভার নিতে ,তাহলে আমি একটু নিশ্চিন্ত হতে পারি ,ইদানীং অফিসের চাপ এত বেড়েছে যে সময় দিতে পারছি না এন জি ও র দেখাশোনায় ।”রূপসা সানন্দে রাজি হয়ে যায় এই প্রস্তাবে ।পরদিন সকাল সকাল সুস্মিতের সঙ্গে রূপসা গিয়ে হাজির হয় স্বপ্ননীড়ে । সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল চত্বর জুড়ে টিনের চালা দেওয়া ছোট ছোট বাড়ি । এক্ একটা বাড়িতে এক্ এক্ রকম কাজ চলছে৷ ,কোথাও সেলাই মেশিন চলছে তো কোথাও ফেব্রিকের কাজ শেখানো হচ্ছে ,কোথাও আচার বানানো হচ্ছে ,কোথাও বড়ি তৈরি হচ্ছে আবার কোথাও ছোট ছোট বাচ্ছাদের পড়ানো ,কোথাও গান শেখানো চলছে৷ এতদিন সুস্মিতের কাছে গল্প শুনলেও আজ নিজের চোখে এই বিশাল কর্মকাণ্ড দেখে রূপসার মন ভরে যায় । সুস্মিতের জন্য শ্রদ্ধায় ভরে যায় রূপসার মন ।”চলো তোমাকে স্বপ্ননীড়ের সুপারভাইজের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি ,উনি তোমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাবেন ।তোমাকে ওনার কাছে রেখে আমি অফিস যাবো ” ফেব্রিকের কাজ দেখতে মগ্ন রূপসাকে তাড়া দেয় সুস্মিত।

॥ ৮॥
স্বপ্ননীড়ের সুপারভাইজাররুপী অদিতিকে দেখে রূপসা চমকে যায় ।এখানে এইভাবে অদিতিকে আবিষ্কার করবে রূপসা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি ।দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে হাঁ করে ।খুব সাধারণ পোশাকে, চোখে চশমা পড়া অদিতি রূপসা কে হেসে বলে ওঠে “কেমন আছিস ?” রূপসার যেন তখনো ঘোর কাটেনি কিছুতেই হিসেবটা মেলাতে পারছেনা যে অদিতি এখানে কিভাবে এল ,কোথা থেকেই বা এলো ,ঘোর কাটলো সুস্মিতের ঠেলায় ।”তোমরা পরস্পরকে চেনো নাকি ?? বাহ এতো দারুণ ব্যাপার “সুস্মিত বলে ওঠে রূপসার দিকে তাকিয়ে ,রূপসা সুস্মিতের দিকে তাকিয়ে তোতলাতে থাকে “ও..ও..ও কে তুমি কো..কোথায় পেলে ?”,”অদিতি এখানে শুরু থেকেই কাজ করছেন ,আর এখানেই নিজের বাচ্ছাদের নিয়ে সারাদিন থাকেন,সন্ধের পর কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরেন “। রূপসার যেন চমকের পর চমক লাগে,কথা বলতে পারেনা ।শেষে অদিতি এগিয়ে এসে রূপসাকে ধরে বসায় ,জল দেয় এক গ্লাস ।রূপসা এক্ নিঃশ্বাসে জলটা শেষ করে প্রথম বলে ওঠে “তুই এখানে ?? অনিকেত দা কোথায় ?তোর মা বাবা ,শ্বশুরবাড়ির লোকজন সবার কি খবর ?সুস্মিতের সামনে একটু ইতস্ততঃ করে অদিতি বলে ” সব আজই শুনবি ? অন্যদিন শুনিস নাহয়”…..রূপসার চোখ পাকিয়ে বলে ওঠে “তুই বলবি কি না বল ! সব আজই এক্ষুণি শুনব “,খানিকটা হেসে অদিতি বলে “তুই আর পাল্টালি না ,সেই একই থেকে গেলি ,এতোদিন বাদে দেখা তাও বকছিস ,আচ্ছা বলছি শোন ” । কৌতুহল বশত সুস্মিতও বসে যায় রূপসার পাশে অদিতির গল্প শুনতে ,সে কোনদিনই এত প্রশ্ন করেনি অদিতিকে ,দুঃস্থ,বাসস্থানহীন অথচ শিক্ষিতা ভদ্র ঘরের মহিলা দেখে কাজে রেখেছিলো ।
॥ ৯॥
অদিতির কথা……

“আমার দ্বিতীয় সন্তানটিও কন্যা হওয়াতে শ্বাশুড়ী প্রায়ই আমাকে মারধোর শুরু করে ।এমনকি ছোট মেয়েটিকে মেরে ফেলারও চেষ্টা করে ।অনিকেত সব দেখেও না দেখার ভান করে থাকতো ।আমার মা বাবা আর সহ্য করতে পেরে শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বলতে যান । শ্বাশুড়ী মা বাবাকে বাড়িতেও ঢুকতে দেয় না ,রাস্তায় দাঁড় করিয়ে চিৎকার করে বলে ২০ লক্ষ টাকা দিলে তিনি আমাকে আর আমার ছোট মেয়েকে মেনে নেবেন ।আমার বাপের বাড়ির অবস্থা খুব সাধারণ ছিল তুই জানিস রূপসা ,বাবার পক্ষে এতগুলো টাকা যোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে ।শেষে বাবা নিজেদের বাড়ি বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন আমাকে বাঁচানোর জন্য। টাকা পেয়ে শাশুড়ি অত্যাচার বন্ধ করে এবং পাকাপাকিভাবে তাঁর মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে আরম্ভ করেন ।কিন্তু এদিকে অনিকেতের অসভ্যতামি বন্ধ হয়না ।রোজ রাতে মদ্যপ অবস্থায় সে আমাকে জোর করে শারীরিক মিলনে বাধ্য করতে থাকে একটি পুত্র সন্তানের আশায় ।এমনই একদিন মদ্যপ অবস্থায় অফিস থেকে ফেরার পথে পথ দুর্ঘটনায় অনিকেতের মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে ।তার স্মৃতিশক্তি চলে যায় ,প্রায় অথর্ব হয়ে পড়ে । বহু চিকিৎসাতেও অনিকেতকে সুস্থ করে তুলতে পারিনি আমি ।এই অবস্থায় দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির কারণে অনিকেতের চাকরিটাও চলে যায় ।দুটো বাচ্ছা নিয়ে আমার তখন পথে বসার মত অবস্থা। তখনই হঠাৎ কাগজে স্বপ্ননীড় এর জন্য কর্মখালির বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে আমার ।সেই শুরু ।তারপর থেকে এখানেই কাজ দেখাশোনা করি ,আমার মেয়েরাও এখানের বাচ্ছাদের সঙ্গেই একসঙ্গে পড়াশোনা করে,খায় ।দিন শেষে বাড়ি ফিরি মেয়েদের নিয়ে ।এই ভাবেই দিন চলে যাচ্ছে ।অনিকেতের চিকিৎসা এখনো চললেও তার সুস্থ হবার কোনো লক্ষণই নেই ।এত অব্দি বলে থামলো অদিতি ।”আর তোর মা বাবা ???”জিগগেস করে ওঠে রূপসা ,”মা বাবাও এখন আমার বাড়িতেই থাকে রে ,সবাই একসঙ্গে ভালোই আছি “।বলে একটু হাসে অদিতি ।
এবার রূপসার বলার পালা ,সে বলে ওঠে “অনেক কষ্ট দিয়েছিস তুই আমাকে ,অনেক কেঁদেছি ,কোনো যোগাযোগ করিসনি ,কেন করিসনি জানিনা ।আমাকে নিজের বোন বলে ভাবতিস ,আজ আমার একটা দাবি তোকে মানতে হবে ।তুই মেয়েদের ভাল স্কূলে ভর্তি কর ,ওদের সারাজীবনের লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ আমার ।আজ যদি তুই আমাকে ফিরিয়ে দিস ভাবব আমাদের সম্পর্কটা মিথ্যে ছিল “।অদিতি উঠে এসে রূপসাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে ।দুই বন্ধুর পুনর্মিলনের নীরব দর্শক সুস্মিতের চোখেও তখন জল ।দূরে কোনো একটি ঘরে তখন বাচ্ছাদের গান শেখানো হচ্ছে “তোরা হাত ধর ,প্রতিজ্ঞা কর ,চিরদিন তোরা বন্ধু হয়ে থাকবি ,বন্ধু কথার মর্যাদাটা রাখবি ।”

Loading

2 thoughts on “গল্প- বন্ধু

Leave A Comment