গল্প

গল্প- পরিণতি

পরিণতি
– রাখী চক্রবর্তী

 

(1)

সকাল থেকেই সাজসাজ রব “আনন্দ ধামে”। আমাদের পাড়ার সবচেয়ে ধনী পরিবারের বাস এই “আনন্দধামে”।

বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন। কচিকাচারা এদিক ওদিক ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে। রবীন্দ্র সংগীতের হাল্কা সুর ভেসে আসছে আমার কানে তাও আবার আমার জানলার গ্রীল ভেদ করে। নিমন্ত্রিত আমিও। কিন্তু আমার মন নেই এই অনুষ্ঠানে যাওয়ার। ওই বাড়িতে পাপীদের বাস। আজ হয়তো ওরা খুব আনন্দ করছে। কিন্তু দু’বছর আগে ওদের পরিবারের মুখে এতটুকু আনন্দ, হাসি ছিল না।
কিন্তু “আনন্দধাম” সে তো আর নিরানন্দ ধাম করা যাবে না।

(2)

বাড়ির একমাত্র ছেলে তাপস বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ একদিন বিয়ে করে নতুন বৌ নিয়ে সষ্টাঙ্গে প্রণাম করল ইজিচেয়ারে বসে থাকা নব্বই বছরের ঠাকুরদার চরণে। বয়সোজনিত কারণে ঠাকুরদা চোখে কম দেখেন তবে নাতি কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফিরেছে এটা উনি ভালোই বুঝতে পেরেছেন। যাইহোক তাপসের মা, বাবা, ঠাকুমা সবার কানে পৌঁছাল এই সুসংবাদ।তারপর শঙ্খ ধ্বনিতে, উলু ধ্বনিতে বধূবরণ অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হল।

(3)

কনে সলাজ নয়নে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছে। স্বপ্নে যা যা দেখেছিল করবী হুবহু মিলে গেছে। করবীর জীবন সার্থক হল আজ। বড় ঘরে বিয়ে হল আবার শাশুড়ি শ্বশুর মেনেও নিল। বারবার নিজের হাতে চিমটি কেটে কেটে দেখছে করবী সত্যি তো সব। নাকি গত দু’দিনের স্বপ্নের মতো। ঘুম ভাঙলেই সব ধা…
(4)

সারা বাড়ি আলোকে আলোকিত আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই নিমন্ত্রিত।বৌভাতের অনুষ্ঠান বেশ ধুমধাম করেই হচ্ছে। ধন সম্পত্তি তো আর কম না ওদের, এতো বিশাল আয়োজন হতেই পারে।
বৌভাতের ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠানে করবীকে ওর শাশুড়ি মা বলছে, বৌমা পরের বছর পুত্রকে কোলে নিয়ে যেন মণ্ডা মিঠাই খেতে পারো এই আশীর্বাদ করি। পুত্র সন্তানের মা হওয়াই মেয়েদের অহংকার। যেমন আমার অহংকার তাপস, বংশের প্রদীপ আমার ছেলে, বংশকে ওই তো এগিয়ে নিয়ে যাবে।

(5)

করবী মা হতে চলেছে। আমার বাড়ি মিষ্টি নিয়ে এসে করবী বলল, “মিষ্টি দি ,আমি মা হতে চলেছি তুমি আমাকে আশীর্বাদ কর যেন আমি পুত্র সন্তান জন্ম দিতে পারি।”

আমি সন্ন্যাসী, পুজো পাঠ নিয়ে সবসময় থাকি তাই পাড়ার সবাই আমার আশীর্বাদকে মূল্য দেয়। আমাকে ভক্তি করে সবাই।

করবীর কানেও এই কথাটা পৌঁছে গেছে। তা না হলে ও আমার কাছে আসবে কেন?

আমি সব শুনে বললাম, মায়ের কাছে সন্তানের ভেদাভেদ করতে নেই। ছেলে মেয়ে সবাই আদরের।

– না দিদি। আমি স্বপ্নে দেখেছি ছেলে কোলে নিয়ে আমি মন্দিরে মন্দিরে ঘুরছি।
– তুমি কন্যা সন্তান নিয়ে সুখী হও। এই কথা শোনার পর করবী আর আমার ঘরে থাকল না।

(6)

পাঁচ মাস হতে চললো অথচ তাপসের বাড়ির লোকজন মনমরা হয়ে আছে। করবী আর আমার বাড়ি এল না। কদিন পর লোকমুখে জানতে পারলাম করবীর প্রথম সন্তানকে পেটের ভেতরেই হত্যা করেছে পরিবারের সবাই। এতে সায় ছিল জন্মদাত্রী মায়েরও।

(7)

আর কদিন পর পুত্র সন্তান জন্ম নেবে আনন্দধামে তাই সাধের বিশাল আয়োজন।
একবছর হয়ে গেল করবী মা হয়েছে। আমার সাথে তেমন কোন কথা বলে না ও।
তবে আজ বলল, আমার অহঙ্কার আমার পুত্র, আমার অলংকার আমার পুত্র। আমি সৌভাগ্যবতী। তা না হলে তোমার অভিশাপ আমার ওপর ফলতো।
আমি বললাম, আমি সেদিন তোমায় সত্য বলেছি। তুমি অভিশাপ ভেবেছো। ভালো থেকো।

(8)

করবী এখন বৃদ্ধাশ্রমে থাকে। ছেলে কুনাল ব্যাংকে উচু পোস্টে কাজ করে। ছেলে বৌ নিয়ে সুখে আছে। হয়তো বড় বাড়িতে জায়গা কম। তাই মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছে।তা না হলে করবীর গর্ব, অহংকার যে ছেলেকে নিয়ে সে নিশ্চয়ই মাকে এমনি এমনি ভিটে ছাড়া করত না।

(9)

এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। করবীকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল, অনেক দিন ওর খবরও পাইনি। আমি সেদিন বৃদ্ধাশ্রমে গেছিলাম ওকে দেখতে, করবী একটা সাজগোজ করা পুতুলকে নিয়ে গান গাইছে,
“শঙ্খ বাজিয়ে তোকে ঘরে আনিনি,
তাই তোর অভিশাপে আমি সুখী হয়নি,
আসছে জনমে আসিস আমার কোলে,
ভালবেসে জাপটে ধরিস মা, মা বলে..”

আমি পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলাম, করবীর মুখোমুখি হওয়ার সাহস হলো না আমার। আবার যদি বলে ও আমাকে তোমার অভিশাপে…

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page