Site icon আলাপী মন

গল্প- লটারি

লটারি
– পারমিতা ভট্টাচার্য

 

 

সুনন্দা এই শহরে নতুন এসেছে। তার স্বামী বিনয় যেহেতু ব্যাংকে চাকরি করে তাই কিছু বছর অন্তর অন্তরই সে ট্রান্সফার হয়। নতুন নতুন শহরে সুনন্দাকেও ঘুরতে হয় তাই। বর্তমানে তারা এসে উঠেছে আরামবাগ শহরে। মফঃস্বল ঘেঁষা শহর। সবুজের ছোঁয়াও আছে এখানে। কবিতা প্রেমী সুনন্দার তাই খুব পছন্দ হয়েছে এই শহরটা। ওদের যখন বিয়ে হয় তখন বিনয় ছিল মালদাতে। তার পর মিষ্টি জন্মালো। মিষ্টি ওদের একমাত্র মেয়ে, বয়স চার বছর। ছোট্ট মিষ্টিকে নিয়ে ওরা মালদা থেকে এলো কৃষ্ণনগর। সেখান থেকে বর্তমান ঠিকানা ওদের আরামবাগ। দেখতে দেখতে ছ’বছর কেটে গেছে ওদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এত ব্যস্ত বিনয় নিজের চাকরি নিয়ে যে সে সুনন্দা আর মিষ্টিকে ঠিক মত সময়ই দিয়ে উঠতে পারে না। একে তো বদলির চাকরি। সমস্ত লটবহর নিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরতে সুনন্দার আর ভালো লাগে না। কিন্তু চাকরি তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না। অগত্যা তাকে নতুন শহর, নতুন মানুষ জন, নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতেই হয়।

সকালের দিকটা একটু ব্যস্তই থাকে সুনন্দা, রান্নার কাজে। সকাল দশটার মধ্যে বিনয় অফিস বেরিয়ে যায়, সাথে ছোট্ট মিষ্টিকেও স্কুলে দিয়ে যায় সে। ওরা বেরিয়ে গেলে সুনন্দার অনন্ত সময় কাটে গল্পের বই পড়ে, গান শুনে আবার কখনও বা জানালার ধারে বসে নতুন জায়গার মানুষজন দেখে। কাজের মাসি এসে সকাল – বিকেল কাজ করে দিয়ে যায়। সুনন্দার কাজের মাসিটি গল্প করতে ভারী ভালোবাসে। বোবা থাকা সুনন্দারও স্বভাব নয়। কিছুটা সময় তাই তার গল্প করেও কেটে যায়। কাজের মাসি চলে গেলে আবার সুনন্দা একা হয়ে পড়ে। তখন সে রাস্তার দিকে জানালার ধারে বসে কবিতার ডায়রি হাতে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে নতুন কিছু লেখার আশায়। এই জানালার ধারে বসেই সে রোজ একটা জিনিস লক্ষ্য করে। একটা মাঝ বয়সী লোক, পরনে ছেঁড়া, নোংরা জামা প্যান্ট, উস্কোখুস্কো চুল, গালে কত দিনের না কামানো দাড়ি নিরন্তর রাস্তায় কী যেন খুঁজে চলেছে। কখনও ডাঁই করে রাখা নোংরায় তো কখনও রাস্তার দু’ ধারে প্রতিনিয়ত একই ভাবে সে কী যেন খুঁজে চলে। বেশ অদ্ভুত লাগে তার লোকটিকে দেখে। লোকটিকে দেখে সুনন্দার পাগল বলেই মনে হয়। মুখে কী যেন বিড়বিড় করে বলে চলে। একদিন কৌতূহল সামলাতে না পেরে কাজের মাসিকে সে জিজ্ঞাসাই করে বসে সেই পাগলটার বিষয়। তখন কাজের মাসি অবাক দৃষ্টিতে সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বলে – ‘তুমি ওকে দেখেছো বুঝি?’
তখন সুনন্দা বলে – ‘রোজই তো দেখি। রাস্তার ধারে রোজই কী যেন খুঁজে চলেছে ও।’
তখন কাজের মাসি মাটিতে বসে বলতে লাগে সেই পাগলের অতীত কাহিনী।

পাগল লোকটির নাম, রতন। লোকটি আগাগোড়া পাগল ছিল না। গরীব মধ্যবিত্ত সংসার ছিল তার। রতন একটি কারখানায় কাজ করতো। মাসে মোটা মাইনে না পেলেও কষ্টে শিষ্টে এক ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে তার দিন চলে যেত। কষ্টের সংসারে তার একটা বদ অভ্যাসের জন্য অশান্তি লেগেই থাকতো। বদ অভ্যাসটি হলো লটারি খেলা। সে প্রায় প্রতিনিয়তই পঞ্চাশ – একশো টাকার লটারি খেলে টাকা উড়িয়ে দিতো। সে অভ্যাসবসত লটারির প্রতিটি নম্বর একটা খাতায় নোট করে রাখতো। কিন্তু কোনও দিনই লটারি থেকে কোনও টাকাই সে পুরস্কার স্বরূপ ফেরত পেত না। একে তো ওই ক’টা টাকা মাইনে, তাতে সংসারটাই ভালো করে চলে না…. তার উপর ছেলের পড়াশোনা, রোগ – অসুখ সবই ছিল। এর উপর প্রতিদিন লটারি খেলে টাকা উড়িয়ে দেওয়ার ফলে সংসারে অভাব বাড়তো বই কমতো না। এই নিয়েই ছেলে, বৌয়ের সাথে তার প্রতিদিনই প্রায় তুমুল ঝগড়া, অশান্তি লেগেই থাকতো। টাকার অভাবে সে ছেলেটিকেও সে ভাবে লেখাপড়া শেখাতে পারেনি। সংসারে বেহাল দশা দেখে অল্প বয়সে ছেলেটিও কারখানার কাজে ঢুকে যায় দু’টো পয়সা রোজগারের আশায়। তার সাথে ধরে মদ, গাঁজার নেশাও। এক কথায় সংসারের অবস্থা দিন দিন আরও অবনতির দিকে যেতে থাকে। কালী পুজোর সময় চারিদিকে এত খুশি, এত আলোর রোশনাই, কিন্তু রতনের বাড়িতে দু’ দিন যাবৎ হাঁড়ি চড়েনি। কারণ সেই একটাই, তার লটারি খেলা। কালী পুজোয় বাম্পার লটারির টিকিট কাটে রতন। একদিকে খাবার কোনও সংস্থান নেই, অন্য দিকে ধার দেনা করে লটারির টিকিট কাটায় বাড়িতে অশান্তি চরমে উঠে। সে দিন রতনের বৌ তুমুল ঝগড়া করতে থাকে রতনের সাথে। রাগ সামলাতে না পেরে রতন লটারির টিকিট নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এর পর রাগের মাথায় কুচোকুচি করে রাস্তায় ফেলে দেয় লটারির টিকিটটা। এমতাবস্থায় সন্ধ্যাতে বাজারে গিয়ে মুখ গোমড়া করে লটারির দোকানে ঢোকে রতন। তখন দোকানি লটারির কাগজ আনতে বলে রতনকে। রতন তখন বিজিত পুরস্কারের নম্বরটা লিখে নিয়ে বাড়ি আসে। বাড়ি এসে ডায়রিতে লেখা নম্বরটার সাথে বিজিত পুরস্কারের নম্বরটা মেলাতে গিয়ে দেখে হুবহু এক নম্বর। সে তো তখন হাঁ। বাম্পার লটারিতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে সে, পঞ্চাশ লাখ টাকার। কিন্তু লটারির টিকিট কই? সেতো টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছে সে। অভাবের সংসারে সেই টাকাটা ছিল আলোর ঝলক। সাথে সাথে সে ছুটে যায় রাস্তায়, যেখানে সে লটারির টিকিট ফেলে এসেছিল। কোথায় বা সেই টিকিট আর কোথায় সেই পঞ্চাশ লাখ টাকা!! কত লাঞ্ছনা, গঞ্জনাই না সহ্য করেছে সে এই লটারির নেশার জন্য। আজ যখন টাকা ভাগ্যে এলো তখন সব শেষ। তীরে গিয়েও তরী ডুবে গেল। এই মনঃকষ্ট সে সহ্য করতে পারলো না শেষ অবধি। খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলো, কাজেও যেত না আর। ফলে সংসারের দারিদ্রতা দিন দিন মারাত্মক রূপ নিলো। এর সাথে যোগ হলো ছেলে, বৌয়ের অশান্তি। তবে তার পর থেকে রতন লটারি খেলা চিরকালের মত ছেড়ে দিয়েছিল। এই রকম পরিস্থিতিতে সে ভয়ংকর ভাবে ডিপ্রেশনে চলে যায়। মাথার গন্ডগোল দেখা দেয় ভয়ংকর ভাবে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাগজ দেখলেই তা কুড়িয়ে লটারির নম্বর মেলাতে থাকে সে। লটারির নম্বর ছাড়া তার সমস্ত ভাষা মন থেকে মুছে গিয়েছিল। সব সময় মুখে বিড়বিড় করে যেত লটারির সেই নম্বরটা। প্রথম প্রথম রতনের বৌ রতনকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এসে খাবার খাওয়াতো, ঘরে দরজা বন্ধ করে রেখে দিতো.. কিন্তু পরে পরে রাস্তা থেকে নিয়ে আসা, ঘরে আটকে রাখা কোনোটাই আর সম্ভবপর হতো না। কারণ, সে অত্যধিক মারধোর করতো, কামড়ে – খিমচে একাকার করতো। ধীরে ধীরে বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয় রতন।

সব শুনে সুনন্দা হাঁ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলো এরকমও হয় মানুষের জীবন! কিন্তু সে ভেবেই বা কী আর করতে পারে? মানুষটার জন্য শুধু সহানুভূতি জ্ঞাপন ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
একদিন বিকেল থেকে আরম্ভ হলো প্রচন্ড বৃষ্টি। বিনয় প্রায় কাক ভেজা হয় অফিস থেকে ফিরলো। সে দিন সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু সুনন্দার ঘুম এলো না কিছুতেই। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলো নানা চিন্তা। বৃষ্টি চিরকালই খুব প্রিয় সুনন্দার। সে বৃষ্টি দেখতে খুব ভালোবাসে। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। সুনন্দা বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরের জানালার ধারে এসে দাঁড়ালো। রাস্তায় জনপ্রাণী কেউ নেই। রাস্তার ধারে ল্যাম্প পোস্টের আলোয় হঠাৎ সে দেখতে পেলো রতনকে। ওই প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যেও রাস্তার ধারে সে কাগজ কুড়োচ্ছে আর কী যেন মেলাচ্ছে। এক অজানা মন খারাপের মেঘ ছেয়ে গেল সুনন্দার মন জুড়ে।

সমাপ্ত।

Exit mobile version