দেবতার বলি
– দেবস্মিতা ঘোষ
“তুমি যদি পুরো ব্যাপারটা না জানাও তাহলে কি ভাবে সাহায্য করব বলো তো?” বললেন প্রফেসর বিশ্বাস। এতক্ষণ টেবিলে পরে থাকা খবরের কাগজটা নিয়ে মিনার দিকে এগিয়ে গেলেন। মিনা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রফেসরের কথা সে ভ্রূক্ষেপ করল না। তার দিকে খবরের কাগজটা এগিয়ে দিয়ে প্রফেসর বললেন, ”সামনের পেজটা দেখে রেখো। কয়েকটা চাকরির সম্বন্ধে ভালো লেখা আছে। আর বাজে চিন্তা ছেড়ে পড়াশোনায় মন দাও। এখন আমি আসি।” প্রফেসর বেরিয়ে গেলেন। কাগজটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো মিনা।
মিনা মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। প্রফেসর অরুণ বিশ্বাস তার কলেজেই পড়ান। বছর বিয়াল্লিশের বিবাহিত, ফর্সা লম্বা, সুপুরুষ। কলেজের পড়ান তবে স্ত্রী পুত্র কলকাতায় থাকে। ছেলের পড়াশোনার সুবিধার জন্য মনে হয় এই ব্যবস্থা। তার স্ত্রীও কলকাতার মেয়ে তাই কলকাতার সুযোগ সুবিধা ত্যাগ করে সে মেদিনীপুরে এসে থাকতে চাইনি। প্রফেসর তাই এখানে ব্যাচেলরের জীবন যাপন করছেন। তবে মিনার সাথে তার সম্পর্কের কথাটা ধরলে তাকে ঠিক ব্যাচেলর বলা চলে না। মিনার সাথে তার সম্পর্কের বয়স প্রায় দু’বছর। মিনা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মেয়ে। কলেজের কাছে মেয়েদের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে সে। বাবা মা পরিবার এসব ব্যাপারে সে প্রফেসরকে কোনোদিনই বেশী কিছু বলেনি মিনা। প্রফেসরও অত আগ্রহী ছিলেন না। কালো, ঘন চুল, গোলগাল চোখ, একটু মোটা মিনাকে প্রফেসর প্রথম থেকেই পছন্দ করতেন। ধীরে ধীরে মিনাই ছাত্রী শিক্ষকের সম্পর্কের বাইরে গিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ছিল। প্রফেসর আপত্তি করেননি। যদিও তাদের সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বে থেমে থাকেনি। ভালোবাসা থেকে শরীর আদান প্রদান সবই হয়েছে। আধুনিক মেয়েদের থেকে আলাদা একটু আনাড়ি সরল মিনাকে প্রফেসর সত্যিই ভালবাসেন। অপর দিকে মিনা প্রফেসরের বিবাহিত জীবনের ব্যাপারেও জানে। কিন্তু তাতে ওর কোনো সমস্যা নেই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ও বর্তমানের সুখকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে না। আর ও প্রথম থেকেই সব জানত। সব জেনে শুনেই ও প্রফেসরকে ভালবেসেছে। যদিও ওদের কলেজের কেউ বা বাইরের কেউই ওদের সম্পর্কের কথা জানেনা। দু’জনের ভালর জন্য ওরা ব্যাপারটার গোপনীয়তা বজায় রেখেছে।
সামনের গরমের ছুটির পর মিনার সেমিস্টার। কিন্তু আজ সকালেই মিনার কাছে খবর এসেছে তার বাবার শেষ নিঃশ্বাস ফেলার খবর। গত সপ্তাহেই তার বাবার মৃত্যু ঘটেছে, সৎকারও হয়ে গেছে। আদিবাসি গ্রামের কেউ শহরে এসে মিনুকে খবর পর্যন্ত দেয়নি। এ কারণে ক্ষুব্ধ শোকাহত মিনা সবার আগে প্রফেসরকে জানিয়ে ছিল সবকিছু। লোক জানাজানির ভয় থাকা সত্ত্বেও প্রফেসর সকাল বেলাতেই এসেছিলেন মিনার হস্টেলে। গরমের ছুটিতে মিনাকে নিয়ে তিনি মিনার গ্রাম বটঝুরি নিয়ে যাবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ফিরে গেলেন।
কিন্তু তাদের একসাথে যেতে দেখলে সমস্যা হতে পারে এইকথা ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা বানালো তারা। দেখতে দেখতে গরমের ছুটি এসে গেল। প্রফেসর তার বন্ধু মহলে জানিয়ে দিলেন যে তিনি এবার নিজের গাড়ি নিয়েই লং ড্রাইভে কলকাতায় যাবেন। প্রফেসরের লং ড্রাইভে যাওয়ার অভ্যাস আছে। তাই কারুর কাছেই কিছু অস্বাভাবিক লাগলো না। অন্য দিকে মিনার বাবার মৃত্যু খবর কমবেশি সবার কাছে ছিল, তাই এত বছর পর মিনার গ্রামে যাওয়া নিয়েও খুব একটা কৌতূহল বাড়েনি। এমনিতেও আদিবাসি মিনার কথা ভাবার মত ছাত্র ছাত্রী মেডিকেল কলেজে বেশি নেই। মিনাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাওয়ার সময় প্রফেসর নিজের মনের জিজ্ঞাসাগুলোকে আর আটকে রাখতে পারলেন না।
“গত দুবছরে তোমাকে তোমার পরিবার, গ্রাম নিয়ে কোন কথা বলতে শুনিনি। খারাপ ভেব না যে বাবার কোন খবরই তুমি রাখতে তার চলে যাওয়ার পর তুমি গ্রামে ফিরছ তোমার মা কি ভাববেন। গ্রামের বাকিরা কি ভাববে। শেষ কবে তুমি গ্রামে গেছিলে? আমাকেই বা কিভাবে পরিচয় করাবে কিছু ভেবে রেখেছ? আমারই ভুল এগুলো আগে আলোচনা করে নেওয়া ছিল।”
জানলার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মিনা বলল, “আমি গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম যখন আমার বয়স দশ। ওই বছরই মা মারা যান। বাবা আমার আদিবাসি ছিলেন তবে মূর্খ ছিলেন না। দশ বছরের মেয়েকে ওই গ্রামে একা মানুষ করতে পারবেন না তা তিনি বুঝেছিলেন। তিনি তার এক বিশ্বস্ত শহরের বন্ধুর মাধ্যমে আমাকে একটি হস্টেলে পাঠিয়ে দিন। খরচপাতি সব ওই বন্ধুই দিতেন। তিনি আমকে দত্তক নিয়েছিলেন। উনি আর ওনার স্ত্রী বিদেশে চলে যান আমার কলেজে ভরতি হবার পর। তাও খরচ উনি পাঠান এখনও। বাবা আমার সাথে কোনও যোগাযোগ রাখেননি। তিনি চাইতেন না আমি ওনার সাথে যোগাযোগ রাখি। তাই আমিও রাখিনি। তবে রক্তের সম্পর্ক বলতে ওই বাবাই ছিলেন, তাই মনটা খুব খারাপ লাগল। যতই হোক ওটা আমার জন্মভূমি।“
“এগুলো তুমি আমাকে আগেও বলতে পারতে। শেয়ার করলে ভাল লাগত।“
“আমি এই ব্যাপারে কথা বলতে খুব একটা ভালবাসি না। আর হ্যাঁ, গ্রামবাসীদের বলব তুমি আমার স্যার, আদিবাসি গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য এসেছ।“
“ তুমি রাস্তা চিনতে পারবে তো?”
“হ্যাঁ পারবো। আচ্ছা তুমি আমাকে কতটা বিশ্বাস কর?”
“এ আবার কি কথা মিনা, আমার গোপন ব্যাবসার কথা তুমি ছাড়া আর কেউ জানে না। এর পরেও তুমি বিশ্বাসের কথা বলছো”
“আচ্ছা, ছাড়ো। জানো আমাদের গ্রামের লোকেরা তেরো বছর অন্তর রিভু দেবতার পুজা করে। নরবলি হয়। শেষ যে বছর আমি গ্রাম ছেড়ে আসি সেবছর হয়েছিল। পুলিশ কেসও হয়েছিল। কোনোভাবে পুলিশ জানতে পেরেছিল। তবে বলি আটকাতে পারেনি। তবে পুরোহিতকে এরেস্ট করেছিল। গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী মোড়লের মেয়েরাই এই পুজোর পুরোহিত হয়। সেই বারের পুরোহিত ছিল ঝরনা। নিজের ঝাতে নরবলি দিয়েছিল সে, বাবার মুখে শোনা। লাশের খোঁজ না পেয়ে আর প্রমাণের অভাবে পুলিশ ঝরনাকে ছেড়ে দিতে বাধ্যহয়। তবে গ্রামে ফিরে এসে ঝরনা সুইসাইড করে। আমার গ্রাম ছেড়ে চলে আসার ঠিক আগের দিন।“ এতোক্ষণ পর চুপ করে মিনা। রাত সাড়ে আটটা বাজে। গ্রামে যেতে এখনও আধ ঘণ্টা লাগবে। মিনার এতোক্ষণের গল্প শুনে প্রফেসরের মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখা যায়। প্রফেসরের মুখের শুকনো হাসি দেখে আর থাকতে পারল না মিনা। হো হো করে হেসে উঠল সে।
“ উফফ তুমি সত্যি বিশ্বাস করে নিলে। আমি তো তোমাকে বোকা বানাচ্ছিলাম। আর তুমি ভয় পেয়ে গেলে”
“তুমি না মিনা। সত্যি ভয় খেয়ে গেছিলাম। যাক গে বল আর কতটা বাকি”
আর মিনিট কুরি পরে জঙ্গলের মাঝখানে একটা গ্রামে এসে পৌঁছালেন প্রফেসর। চারদিকে মাটির বাড়ি, কারেন্ট নেই, মশাল জ্বলছে। তার গাড়িটাকে এই জঙ্গলের রাস্তায় আনতে অনেক কসরত করতে হয়েছে। তার গাড়ি দেখেই মশাল নিয়ে ছোট ছোট কাপড় পড়া পুরুষ মহিলারা গাড়িটাকে ঘিরে ধরল। প্রত্যন্ত গ্রামে গাড়ি নিয়ে আসলে এরকম হবে তাতে আর আশ্চর্য কি। তাকে গাড়িতে বসতে বলে মিনা নেমে গেল। নিজেদের ভাষায় কথা বলল গ্রামবাসীদের সাথে। ধীরে ধীরে সন্দেহে ভরা মুখগুলোতে কৌতূহল আর খুশি দেখা দিল। মিনার ইশারায় তিনি গাড়ি থেকে নেমে এলেন। তাদের গোল করে ঘিরে গ্রামবাসীরা একটা বাড়িতে বসতে দিল। পাতার গ্লাসে জল দিল। প্রফেসরের জলে একটা গন্ধ লাগল। আদিবাসি তো কোথাকার জল খায় কে জানে। প্রফেসর জলটুকু খেয়ে নিলেন। মাথাটা ঘুরে উঠল, হাত বাড়িয়ে মিনাকে ডাকতে গিয়ে পড়ে গেলেন তিনি।
চোখ খুলে নিজেকে একটা মন্দিরে আবিস্কার করলেন তিনি। বীভৎস মূর্তিটার জন্যই এই খড়ের চালাটাকে মন্দির বলে বুঝতে পারলেন প্রফেসর। একাধিক মশালের আলোয় আদিবাসির পোশাকে মিনাকে সেই মূর্তির সামনে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠলেন অরুণ বিশ্বাস। চারদিকে আদিবাসির পাহারা দেখে পালানোর শেষ আশাটাও শেষ বুঝলেন তিনি। সামনে থাকা হাঁড়িকাঠটাকেই অদৃষ্ট হিসাবে মেনে নিলেন তিনি। মিনা উঠে ঘুরে তাকাল তার দিকে। প্রফেসর কোনো কথা বললেন না। শুধু মনে মনে সেই নিরীহ মেয়েটির সাথে এই ভয়ঙ্কর নারীটির মিল খোঁজার চেষ্টা করতে থাকলেন।
শুধু আস্তে একবার জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন মিনা?”
“কখনও কখনও নিজের গোপন জিনিস কারুর সাথে ভাগ করা উচিত না, প্রফেসর। আমার বাবা সাধারণ একজন আদিবাসি ছিলেন। পেটের বাথায় কাতর হয়ে অনেক সাহস জুগিয়ে শহরের হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানে তার দেখা হয়েছিল এক দেবতার সাথে। হ্যাঁ, তিনি দেবতাই ছিলেন, বিনা পয়সায় বাবার অপারেশনের ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে ফিরে আসা বাবা ঠিক এক সপ্তাহ পর মারা যান, চাষের কাজ করতে গিয়ে। শহরের হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলেছিল বাবার শরীর থেকে একটি কিডনি বের করে নেয়া হয়েছিল। একটা কিডনি নিয়ে ভারি কাজ করতে গিয়ে বাবার মৃত্যু হয়। এই শুনে গ্রামে ফিরে মা আত্মহত্যা করে। শহরের সেই ডাক্তার আমায় দত্তক নেন। অনেক খুঁজে জানতে পারি সেই দেবতার নাম, ডঃ অরুন বিশ্বাস। মনে আছে প্রফেসর আপনি যখন আপনার গোপন ব্যাবসার কথা বলেছিলেন আমি অবাক হইনি। কেনই বা হবো? আমি তো জানতাম আগে থেকেই। তবে আপনি নিজে থেকে জানানোর পর আমার আর কোন সন্দেহ ছিল না। সেই ডাক্তার মানে আমার দত্তক নেওয়া পিতা বিদেশে চলে গেছেন। আমার টিকিট রয়েছে কাল সকালের। আমাকে বিশ্বাস করে আপনি ভুল করেছিলেন । আমার বাবাও মোড়ল ছিলেন। সেই হিসাবে আমিও পুরোহিত। শুধু তেরো বছর শেষের অপেক্ষা ছিল। জন্মভুমির প্রতি শেষ দায়িত্ব পালন করে যাব। আজ আমি আমাদের দেবতার সামনে আমার সরল বাবার বিশ্বাসের সাথে খেলা করা দেবতার বলি দেব।“
মিনার আদেশে দু’জন আদিবাসি প্রফেসরের কপালে সিঁদুরের তিলক কেটে দিল। আর তাকে নিয়ে চলল হাঁড়িকাঠের দিকে।