অভাগীর স্বপ্ন
– শচীদুলাল পাল
পুরুলিয়া জেলার জোড়াবান্ধা গ্রাম। এক অজ পাড়াগ্রাম। দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোনো জনবসতি নাই। আবাদহীন ধূ ধু মাঠ। বছরে একবারই চাষ হয়। তাও বৃষ্টির ভরসা।
বাঁধের জলে যেটুকু সবজি হয় তার দাম পাওয়া যায়না। দু’ টাকায় ফুলকপি, বাঁধাকপি। গ্রীষ্মে খেঁড়ো, কুমড়ো, শশা। নিবারন মন্ডলের একমাত্র মেয়ে আমি তনুশ্রী। মা খেত খামারের কাজ করে। বাবাও খেত মজুর। দিন এনে দিন খাওয়া। আমি দেখতে সুন্দরী ও ফর্সা তাই স্কুলের মাষ্টার মশাইরা আমার নাম রেখেছিল তনুশ্রী। অনেক দূরের স্কুল থেকে বিজ্ঞানে সব বিষয়ে ভালো নম্বর পেয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করলাম। ইচ্ছে ছিল কলেজে পড়ার।
কিন্তু বাবা রাজি হলো না। ইতিপূর্বে শহরের কলেজ থেকে ফেরার পথে গ্রামের অনেক মেয়ে অঞ্চলের প্রভাবশালী ছেলে ও তার সাঙ্গপাঙ্গ দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিল। তারা মদ খায়, যেখানে সেখানে আড্ডা দেয়। কাজ নেই কর্ম নেই। অল্পসল্প লেখাপড়া শিখে না হয়েছে মানুষ না হয়েছে মুনিশ। অনেকের বিয়ের বয়স পার হয়েছে। এই বেরোজগার ছেলেদের মেয়ে দেবে কোন বাপ?
শুধু রাজনীতি দলাদলি। ভোটের সময় সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে। দু’একজন মার্ডারও হয়েছে।
বাবা বলল, “ওরা তোর জীবনটা নষ্ট করে দেবে। তাই আর পড়তে হবে না। তোর বিয়ে দিয়ে দেব।” শার্দূলদের ভয়ে আমিও জড়সড়। বাস স্ট্যান্ড থেকে আমাদের গ্রাম অনেক দূরে। বাসের সংখ্যা খুব অল্প। শহর থেকে কলেজ শেষ করে বাস স্ট্যান্ড থেকে ঘরে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। তখন ওই বদমাশগুলো সুযোগ নেয়।
বাবার কথায় রাজি হয়ে গেলাম। বাবা গ্রামের এক মাষ্টার মশায়ের সাহচর্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দিল। অনেক সম্বন্ধ এলো। যথারীতি আপ্যায়ন করা হলো। অবশেষে কোলকাতা থেকে এক বিশাল বড় গাড়ি করে ছেলে, বাবা মা বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন নিয়ে মেয়ে দেখে পছন্দ করে গেলো। ছেলে কর্পোরেট অফিসার। বেতন সত্তর হাজার। বাবা মায়ের আনন্দে চোখ বেয়ে জল এসে গেলো। বাবা গ্রামের মাতব্বরদের কাছে জানতে চাইল। তারা সবাই বললো, “বাহ্ বেশ তো সুযোগ। এ সু্যোগ হাতছাড়া করবি না। তোর মেয়ের ভাগ্য কত ভালো নিবারন!”
একদিন বাবা মা মাষ্টার মশাইকে সাথে নিয়ে কলকাতা গিয়ে দেখে এলো। ছেলে অতনু মন্ডল ও তার বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। এসে অনেক প্রশংসা করলো।
আমিও আনন্দে আত্মহারা। বিয়ের জন্য দিন গুনতে লাগলাম। ছেলে পক্ষের কোনো দাবিদাওয়া নেই। তবুও বাবা শেষ সম্বল এক টুকরো ভালো জমিটা বিক্রি করে যথাসাধ্য গহনাগাঁটির ও অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলো।
নির্দিষ্ট দিনে পাঁচটা বড়ো বড়ো গাড়ি করে বর ও বরযাত্রী এলো এবং আমার বিয়ে হয়ে গেলো।
সারারাত বাসর জাগার ক্লান্তি তো ছিলই। কিন্তু গাড়ির জানালার ধারে বসে নানান দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আমি ক্লান্তি ভুলে দেখতে দেখতে চললাম। খরা কবলিত গ্রাম ছেড়ে দেখলাম কত সবুজের সমারোহ। নদ নদী পুকুর পুস্করিণী গাছ গাছালি, কত গ্রাম কত শহর। কত অচেনা অদেখা দৃশ্য দেখে আমি রোমাঞ্চিত হতে লাগলাম। বিষ্ফোরিত নেত্রে দেখলাম বৈশাখ মাসে ধান খেতে সবুজ আর সবুজ। কত ফুলের চাষ। এভাবে পৌঁছে গেলাম কলকাতা। সামনে মা গঙ্গা, বিদ্যাসাগর সেতু। আমি হাত জোড়ে প্রণাম করলাম। মনে মনে স্মরণ করলাম বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন, মাইকেল, জগদীশ চন্দ্র বসুকে। বিশ্ব সেরা সাহিত্য ও সংস্কৃতির শহরে প্রবেশ করছি ভেবে শিহরিত হলাম। বিশাল বিশাল সব বাড়়ি। অগুনতি মানুষ আর কত রকমের গাড়ি। সবাই ছুটছে। দু’ একটি দরকারী কথা ছাড়া বরটি কোনো কথা বলেনি।
বন্ধু বান্ধবদের সাথে চুপিচুপি কথা বলাতেই ব্যস্ত।
মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে বন্ধুরা মিলে কিছু একটা খেয়ে এসেছে। মনে হয় মদ। কারণ গন্ধটা অন্যরকম।
যাই হোক অবশেষে আমরা পৌঁছালাম গন্তব্যে। সল্টলেক। চারিদিকে শুধু বড় বড় বাড়ি। বিশাল চওড়া চওড়া রাস্তা। দ্রুতগামী সব গাড়ি বাস। সাধারণ লোকজন খুব একটা নেই। আমাদের গাড়ি সামনের পার্কিং জোনে পার্ক করা হলো। বাদবাকি যে যার ঘরে চলে গেছে। আমি আর বর ঘরে এলাম। দশ তলা বাড়ির আট তলায় ফ্ল্যাট। লিফটে উঠে দু’জনে ঘরে প্রবেশ করলাম।
দেখলাম একজোড়া ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা। আমি তাদের প্রণাম করলাম। তারা দু’জনেই নিঃশ্চুপ। বুঝতে পারলাম না। লোকাচার নেই। কোনো বধূবরণ হলো না।
সুসজ্জিত বড়ো ফ্ল্যাট। বিশাল বিছানা। রুমের সাথে এটাচ বাথরুম। আমি স্নান সেরে কাপড় ছেড়ে অল্প কিছু খেয়ে বিশ্রাম করতে গেলাম। শুনশান ফ্ল্যাট। এ.সি.র ঠান্ডাতে রাত্রি জাগরনের ক্লান্তিতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ধড়ফড় করে ওঠে দেখলাম কেউ কোথাও নেই। তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটে আমি একা। জানালা দিয়ে দেখলাম অধিকাংশ ঘরেই আলো জ্বলছে না। রাস্তার একাংশ দেখা যাচ্ছে। অসংখ্য গাড়ি দীপাবলির আলোর মালার মত। ছুটে চলেছে। সামনের বাঁকে অর্ধবৃত্ত আকার ধারণ করছে। এটা কী বিয়ে বাড়ি! আমি কোথায় এলাম। এত নির্জন নিরালায় আমার ভয় করতে লাগলো। বাড়ির কথা, বাবা মায়ের কথা, বান্ধবীদের কথা মনে পড়তে কান্না পেয়ে গেল।
আশে পাশে কেউ নেই যার সাথে কথা বলবো। দমবন্ধ করা পরিবেশ। কেমন যেন বাক্স বাক্স মনে হয়।
ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম ঘরের সব। বিলাসের ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছু মজুত। কোনোকিছুর অভাব নেই। রান্নাঘরে গেলাম। সেখানেও ফ্রীজে সবকিছু মজুত। ভাবলাম একবার রান্না করি। কিন্তু বর যে কোথায় গেলো!
মধ্যরাত্রিতে বাইরে থেকে চাবি দিয়ে খুলে বর ঢুকল। পা দু’টো টলমল করছে। মুখে বিকট গন্ধ। হাতে খাবারের প্যাকেট।
আমার হাতে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল “খাবার রেডি কর। আমি আসছি।”
খাবার খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, “এই ফ্ল্যাটে আপনার বাবা মা থাকেনা?” বর অতনু বলল, “বাবা অনেক দিন আগেই গত হয়েছেন। মা এডজাস্ট করতে পারছিল না। বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দিয়ে এসেছি।”
– তবে যাঁদের দেখলাম, যাঁরা আপনার বাবা মা পরিচয়ে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন তাঁরা?
– সেসব পরে জানতে পারবে। আজ চলো এনজয় করি।
– আমার মন ভীষণ উদাস হয়ে গেল।
রাতের খাবার শেষে ভারাক্রান্ত মনে নিজের ঘরে শুতে এসেছি। অতনু এল এবং আমাকে দেহ মিলনে বাধ্য করলো। আমি বললাম আজ আমাদের কালরাত্রি। আজ একসাথে থাকতে নেই।
– ওসব গেঁয়ো কালচার। শহরে চলে না।
ব্যাথা যন্ত্রণা আবেগ অনাস্বাদিত আনন্দে প্রথম মিলনের আবেগে আমি শিহরিত হলাম।
– তুমি এম.এস.সি পাস। লক্ষ টাকা মাসিক আয়। গাড়ি, দামি ফ্ল্যাট আছে। এই এতবড় শহরে অনেক সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ে থাকতে আমাকে তোমার পছন্দ কেন হলো?
– এই শহরের মেয়েদের আমি বিশ্বাস করি না। তুমি সতেরো বছরের সুচরিত্রা, সুন্দরী, ত্বন্বী কুমারী। ভার্জিন।
রাত শেষে ভোর হলো আমি স্নান করে চা হাতে নিয়ে অতনুর ঘুম ভাঙালাম।
– বাহ্। খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে ও তোমার হাতের গরম চা। আজ একটু পরে কাজের মেয়ে আসবে। সে যাবতীয় কাজ করবে। রান্নাবান্না করবে। আর আজ আমাদের বিয়ের পার্টি। বিউটি পার্লারের মেয়ে আসবে। তোমাকে সাজাবে।
যথারীতি নববধূর সাজে সুসজ্জিতা হয়ে পার্টিতে গেলাম। অনেক হাই ফাই লোকজনের সমারোহ। কিন্তু কোনো আন্তরিকতা নেই। সব কেমন মেকি। দেঁতো হাসি। ভদ্রবেশে জোড়ায় জোড়ায় নাচ করছে। প্রায় সবাই মদ্যপ। জোড়াগুলি আবার পরিবর্তিত হচ্ছে। এক মহিলা আমাকে ড্রিঙ্ক অফার করল। আমি তীব্র প্রতিবাদ করলাম। তখন তারা আমাকে কোল্ড ড্রিক্সস খেতে দিল। খেতেই আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। কে একজন টেনে নিয়ে নাচের আসরে জোর করে নিয়ে গেল। আমি নাচতে জানি না। কিছুক্ষণ পর মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। জ্ঞান ছিলনা। একজন আমাকে একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে আমার গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করলে আমার সম্বিৎ ফিরে এলো। আমি ছেলেটিকে সজোরে মারলাম এক চড়। ছেলেটি ভিরমি খেয়ে পড়ে গেল। ভদ্রবেশী এই সমাজ আমাকে একদম ভালো লাগছিলো না।
এভাবে প্রায় এক বছর কেটে গেলো। নিঃসঙ্গ জীবন। কৃত্রিম ভালোবাসা। শুধু দেহের টান। বাইরে কোনো আনন্দ নেই। লোকজন কেমন যেন। অসহিষ্ণু, স্বার্থপর। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। জানতাম মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। এখানে কোনো সমাজ নেই। সবার টাকা আছে। গাড়ি আছে। কেউ কাউকে সাহায্য করে না। কারো দুঃখে কেউ সান্ত্বনা দেবার প্রয়োজন মনে করে না। সবাই অর্থের আর স্বার্থের পিছনে ছুটছে। টাকা সর্বস্ব। আদর্শ বলে কিছু নেই। এখানে যারা চাকরি করে তারা ফ্ল্যাটে তাদের পিতামাতাকে থাকতে দেয় না। আর যারা ফ্ল্যাট কিনে বিদেশে চাকরি করে তাদের বাবা, মা একাই বাস করে। তাদের দেখার কেউ নেই।
একদিন আমি অসুস্থ হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলাম। অতনু তখন ডিউটি যাবে। সামনাসামনি ডাক্তার নেই।
অতনু ড্রাইভারকে ফোন করে ডেকে বললো, ম্যাডামকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে এসো দমদম থেকে।
ডাক্তার বলল, “আপনি অন্তঃসত্ত্বা। রেষ্ট নিন।”
মাস কয়েক পর একদিন অতনু বলল, “আমি কোম্পানির কাজে দিন কয়েকের জন্য মুম্বাই যাচ্ছি। তুমি ড্রাইভারের সাথে চেক আপে চলে যেও। ড্রাইভার অনেকদিন ধরে অতনুর গাড়ি চালায়। একদিন ফেরার পথে ড্রাইভারকে বললাম, “শুনেছি আমার শাশুড়ী এখানে কোথাও বৃদ্ধাশ্রমে থাকে। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?” ড্রাইভার অবাক হয়ে গেল। বললো, “নিশ্চয়ই ম্যাডাম”।
বৃদ্ধাশ্রমে শাশুড়ী মার সাথে দেখা হলো। প্রণাম করে বললাম, “আমি আপনার ছেলে অতনুর বউ। গাঁয়ের মেয়ে।” দু’বছর হলো বিয়ে হয়েছে।
শাশুড়ী মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো। অনেক জমানো কথা শেষে যা বললো তা শুনে আমি ত হতবাক।
– কোলকাতায় অনেক বিশাল জায়গা জুড়ে আমাদের বাড়ি ছিল। একমাত্র ছেলে অতনু। আমরা উচ্চশিক্ষিত করেছি। সেই ছেলের কথামতো তার সুবিধার্থে সেই বাড়ি বেচে সল্টলেকে ফ্ল্যাট কিনলাম ছেলের নামে। এই ফ্ল্যাটে আসার পর সে মদ ধরল। প্রতিদিন মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত। লম্পট ছেলে নিত্যনতুন মেয়েদের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসতো। বাবা প্রতিবাদ করতো।
একদিন এক কাজের মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢোকালো। তার স্বামী এসে শাসিয়ে গেল তোমার শ্বশুরকে।
প্রতিবাদ করলো অতনুর বাবা। বললো, “আমি বেঁচে থাকতে এসব অনাচার সহ্য করবো না।” মদ্যপ ছেলে বাবার গালে কষে এক চড় মেরে বললো, “আমার ফ্ল্যাট। যা খুশি করবো। সহ্য যদি না করতে পারো। মরে যাও।” অবশেষে বাবা নিত্য নিদারুণ নির্যাতন, পুত্রদ্বারা নিত্য অপমান সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করল।
বাবার মৃত্যুর পর অতনু আরোও লম্পট হলো। বাবার জমানো টাকা, বাড়ি বিক্রি করার টাকায় আরোও ফুর্তি করতে লাগলো, আমি প্রতিবাদ করতাম। তাই শাস্তি দিল। আজ আমি বৃদ্ধাশ্রমে চার দেওয়ালের মাঝে এক ছোট্ট কামরায় দিন কাটাচ্ছি। কিছু বললে বলতো, “এটাই নিয়ম মা। আধুনিক সমাজের নিয়ম।”
আমি ভারাক্রান্ত মনে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, যে দু’জন বয়স্ক দম্পতি আমাকে দেখতে গেছিলেন এবং যাঁদের আমি ফ্ল্যাটে সেদিন প্রণাম করেছিলাম তারা অতনুর কেউ নয়। মেয়ে সাপ্লায়ের কাজ করে। কুখ্যাত লোক। ঘরে ফিরে এসে আমার কৌতুহল বাড়লো। একদিন কৌতুহলবশতঃ অতনুর আলমারির চাবি নিয়ে আলমারি খুলে দেখলাম। প্রচুর টাকা গয়না, ব্যাঙ্কের সব কাগজপত্র। তারমধ্যে থেকে একটা খাম মেঝেতে পড়ে গেলো। কুড়িয়ে নিলাম, খুলে দেখি বিভিন্ন মেয়েদের সাথে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় অশ্লীল ছবি অতনুর। আর একটা প্রেসক্রিপশন। তাতে বিভিন্ন ধরণের রক্তপরীক্ষার উল্লেখ করা আছে, তারমধ্যে একটি এইচ. আই.ভি. টেষ্ট। কিন্তু কোথাও রিপোর্ট খুঁজে পেলাম না। খুব ভয় লাগছিল।
মুম্বাই থেকে ফিরে এলো অতনু। আমি চুপচাপ থাকতে লাগলাম। আমি যে এত কথা জানতে পেরেছি কিছুই বুঝতে দিলাম না। সব জেনে বুঝে চুপ থাকলাম যদি আমার পাখির বাসাটা ভেঙ্গে যায়!
ধীরে ধীরে এডভান্স স্টেজে পৌঁছে গেলাম। নির্দিষ্ট দিনে কলকাতার নামী নার্সিং হোমে ভর্তি করলো অতনু। সিজার হলো। পুত্র সন্তানের জন্ম দিলাম। আমি আমার পুত্রকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। অসুস্থ শরীরে আলাদা থাকি। অতনু খোঁজ খবর নেয় না। একদিন অবসন্ন শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ মেয়েলি এক হাসির শব্দে ঘুমটা গেলো ভেঙ্গে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম অতনুর ঘরে। দরজা ঠেলতেই দেখলাম অতনু ও লাস্যময়ী সেই মেয়েটি অপ্রীতিকর অবস্থায় শুয়ে আছে। আমি তীব্র প্রতিবাদ করলে তারা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের বাইরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে অতনু তার ঘরের দরজা বন্ধ করল। আমি ক্রন্দনরত শিশু পুত্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
প্রায় প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটেই চলেছে।
কাজের মেয়ে, রান্না করার মেয়ে সব ছাড়িয়ে দিল। একদিকে শিশুপুত্রের যত্ন, অন্যদিকে ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম আমি অসুস্থ শরীরে করতে লাগলাম।
নিজে ও শয্যাসঙ্গীনিকে নিয়ে বাইরে খেয়ে ঘরে আসতো। আমি সহ্য করতে করতে পাথর হয়ে গেলাম।
একদিন আমার কোলের ছেলেকে নিয়ে অটো চেপে স্থানীয় থানায় জানালাম। ঘরে পুলিশ এলো। এতে ফল বিপরীত হলো। আমার উপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়লো।
একদিন খবর এলো বাবা রাজমিস্ত্রীর কাজে শহরে গিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। অসুস্থ মা কাকার বাড়ীতে ক্রীতদাসের মতো জীবন কাটাচ্ছে।
আমি ঠিক করলাম সব কিছুকে মেনেই নেব। কিন্তু তাতে ফল উল্টো হলো। ক’দিন থেকে বাচ্চাটার খুব জ্বর। একদিন রাতে অতনুর ঘরে গেলাম চিকিৎসার ব্যবস্থার কথা বলতে। দেখি সেই মেয়েটির সাথে শুয়ে আছে। এখন সে নিত্যি আসে। অতনু আর সেই মেয়েটি রেগে আমাকে দু’জনে মিলে মারধোর করে ঘর থেকে বের করে দিল। এরপর একদিন রাতে আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি মদ্যপ স্বামী আমাকে গলা টিপে ধরেছে। আর মেয়েটি পা দু’টো চেপে ধরে আছে। আমি দাঁত দিয়ে এক কামড় দিয়ে নিজেকে মুক্ত করলাম। মেয়েটিকে এক লাথি মারলাম। তারা আমাকে মারার জন্য দড়িও এনেছে। আমি তখন পরাস্ত হয়ে বুঝলাম ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। বাচ্চাটাকে তুলে আছড়ে মারতে গেলো। আমি তখন হাঁটু মুড়ে করজোড়ে বললাম, “তোমরা আমার ছেলেকে মেরো না আমি আমার ছেলেকে নিয়ে চলে যাবো। তোমাদের কোনো ক্ষতি করবো না।”
রাত শেষে ভোর হলো। আমি শিশুপুত্রকে নিয়ে রাস্তায় এলাম। ভাগ্যচক্রে এক স্বেচ্ছাসেবকের সাথে দেখা হলো। সে আমাদেরকে সল্টলেক থেকে অনেক দূরে কলকাতার এক বস্তিতে নিয়ে গেল। সেখানে দরমার ঘরে আশ্রয় নিলাম। আমার মনের জোর বেড়ে গেলো। আমি যেভাবে হোক আমার সন্তানকে মানুষ করবো। আমি রান্নার কাজ, কোথাও বাসন মাজার কাজ জুটিয়ে নিলাম। মেধা থাকা সত্ত্বেও বাবা না পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছিলো, সুখে- সম্মানে সংসার করবো বলে। আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম। গরীবের স্বপ্ন দেখতে নেই, ভুলে গেছিলাম। আমি তনুশ্রী আজ বাসন মেজে সংসার চালাই।