Site icon আলাপী মন

গল্প- আয়নার ইঙ্গিত

আয়নার ইঙ্গিত
-প্রলয় কুমার নাথ

 

পর্ব-১

নেতাজী সুভাষ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেই মৈনাক আরেকবার স্পর্শ করল তার ফোনের স্ক্রিনে থাকা স্বাগতার নাম্বার। কিন্তু কিছুক্ষণ ফোনটা কানে রেখেই, বিরক্ত হয়ে লাইনটা কেটে দিল মৈনাক। এবারও সেই এক ব্যাপার, সেই এক যান্ত্রিক আওয়াজ এল কানে,
–“দা নাম্বার ইউ আর ডায়ালিং ইস কারেন্টলি সুইচড অফ, প্লীজ ট্রাই আফটার সাম টাইম…” আর কোন কিছু না ভেবে মৈনাক এয়ারপোর্টের সামনে থেকে একটা ট্যাক্সি ধরল। তারপর গাড়ির চালককে নিজের বাড়ির অবস্থান বুঝিয়ে দিয়ে ঢুকে পরল ট্যাক্সির ভেতর। চালক স্টার্ট দিল গাড়িতে, আর সেই সঙ্গেই সকল উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা ভিড় করে এল মৈনাকের মস্তিষ্কে। কি যে হল স্বাগতার? কালকের গোটা দিনটা, আর আজকের এই দুপুরটা অবধি ওর ফোন বন্ধ…এমন তো কখনো হয়নি আগে!

মৈনাক আর স্বাগতার বিবাহ হয়েছে প্রায় তিন বছর আগে। আরেঞ্জড ম্যারেজ হলেও বিয়ের পর তা “লাভ”-এই পরিণত হয়েছিল প্রথম প্রথম। কলকাতার একটি নামী মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে মার্কেটিং ম্যানেজার পদে কর্মরত মৈনাককে কর্মসূত্রে প্রায় যেতে হয় কলকাতার বাইরে। এই যেমন সে এক সপ্তাহ ধরে তার কোম্পানির ব্যাঙ্গালোর ব্রাঞ্চে বসেছিল, আজ দুপুরেই সে সেখানকার কাজ মিটিয়ে ফ্লাইটে করে কলকাতায় ফিরল। স্বাগতার সাথে বিবাহের এক বছরের মধ্যেই একটি পথ দুর্ঘটনায় মারা যান মৈনাকের মা এবং বাবা। তাই মৈনাকের অনুপস্থিতিতে, স্বাগতাকে একাই থাকতে হয় এই এত বড় বাড়িতে। বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই একবার সন্তান-সম্ভবা হয়েও মিসক্যারেজ হয়ে যায় স্বাগতার, তাই তার সেই দুঃখ এবং মৈনাকের মা বাবাকে হারানোর শোক যেন ক্রমশ ওদের দু’জনকে আলাদা করে দিচ্ছিল। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও, প্রতিদিন কম করেও পাঁচ থেকে ছয় বার ফোনে কথা হয় মৈনাকের স্বাগতার সাথে।

শুধু বিপত্তি বাঁধল গত দিন থেকে…স্বাগতাকে কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না ফোনে! যখনই মৈনাক তাকে ফোন করছে, তখনই সেই এক কথা শোনা যাচ্ছে! আতঙ্কে আর উত্তেজনায় বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল মৈনাক…হঠাৎ করে কি হল স্বাগতার? কেনই বা বন্ধ করে রেখেছে সে তার ফোন? কোন যান্ত্রিক গোলযোগ হলেও তা এতোক্ষণ ধরে চলার কথা নয়…তাহলে কোন বিপদ হল না তো স্বাগতার!

ওদের বাড়িটা একটা ফাঁকা জায়গায় অবস্থিত, যানজটে ভরা জনবসতি থেকে একটু দূরে। বাড়ির সামনে একটি ফাঁকা মাঠ, অন্য দুই ধারে বাগান আর বাড়ির পেছনে আছে একটি দিগন্ত বিস্তৃত জঙ্গলাকীর্ণ জমি। মৈনাকের ট্যাক্সিটা ওর বাড়ির সামনে পৌঁছলে সে চালকের ভাড়া মিটিয়ে, দুরু দুরু বুকে ছুটে গেল বাড়ির কাছে। সে জোরে জোরে চিৎকার করে স্বাগতার নাম ধরে ডাকতে লাগল, কিন্তু কোন উত্তর এল না বাড়ির ভেতরে থেকে। মৈনাক বাড়ির সদর দরজার কাছে ছুটে এসে দেখল, যে দরজাটা শুধুমাত্র বাইরে থেকে আটকানো…তবে কোন তালা দেওয়া নেই তাতে। এটা দেখে ধক করে উঠল মৈনাকের হৃদয়…তার মানে কি স্বাগতাকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে এই বাড়ি থেকে? আর সেজন্যই সে বুঝি ফোন ধরতে পারছে না!

আর দেরি না করে মৈনাক এক ঝটকায় দরজা খুলে ছুটে গেল বাড়ির ভেতর। সে সারা বাড়িময় স্বাগতার নাম ধরে ডাকতে লাগল, তাকে খুঁজতে লাগল এই ঘর থেকে সেই ঘর…কিন্ত প্রতিটা ঘরের সব কিছু ঠিক আগের মত একই জায়গায় থাকলেও নেই শুধু স্বাগতা! কিছুক্ষণ তাকে খোঁজার পর, ড্রয়িং রুমে সোফায় ক্লান্ত হয়ে বসে, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মৈনাক,
–“কি হল তোমার স্বাগতা…কোথায় গেলে তুমি আমায় ছেড়ে…কোথায়!”

একটু পরেই বেজে উঠল মৈনাকের ফোন, ও নিজের হুঁশ ফিরে পেয়ে ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পেল সূর্যর নাম্বার। সূর্য ওর অফিস কলিগ এবং বিশিষ্ট বন্ধু। ওরা একসাথেই কোম্পানির কাজে ব্যাঙ্গালোরে গিয়েছিল, তারপর আজকে দু’জনে একই ফ্লাইটে ফিরেছে। সূর্য থাকে দমদম এয়ারপোর্টের কাছেই, ওকে ওর স্ত্রী আজ এয়ারপোর্টে রিসিভও করতে এসেছিল। এবং মৈনাকের এই স্বাগতার ফোন না পাওয়ার ঘটনার কথা সূর্য মৈনাকের সাথে ব্যাঙ্গালোরে কাটানোর শেষ দিনই জানতে পেরেছে। মৈনাক ওর ফোনটা রিসিভ করতেই, বেশ উদ্বেগের সাথে বলে উঠল সূর্য,
–“কি রে, বাড়ি পৌঁছেছিস? খোঁজ খবর পেলি কিছু বৌদির?”
মৈনাক উদভ্রান্তের মত কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে উঠল,
–“না রে সূর্য…স্বাগতাকে কোথাও পাচ্ছি না…কোথাও না…বাড়ির সদর দরজাটা বাইরে থেকে তালা না দিয়েই বন্ধ করা ছিল…সারা বাড়ি খুঁজলাম, কোথাও নেই সে!”
ফোনের ওপার থেকে সূর্য বলে উঠল,
–“সে কি! তুই আত্মীয় স্বজনদের কাছে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিস, সে তাদের কারোর কাছে আছে কি না?”
মৈনাক অধৈর্য হয়ে বলে উঠল,
–“সে তো ব্যাঙ্গালোরে থাকতে তোর সামনেই চেনা জানা সবাইকেই ফোন করে দেখলাম, ভাই…কেউ তো কিছুই বলতে পারল না ওর সম্বন্ধে!”

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সূর্যর কন্ঠ, তারপর সে দৃঢ় গলায় বলে উঠল,
–“মৈনাক, আমার মনে হয় আর দেরি করা ঠিক হবে না…আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি তোর কাছে…তারপর আমাদের দুজনকে একবার থানায় যেতে হবে…বৌদিকে যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এই ব্যাপারে তাদেরকে জানাতে হবে…শোন, তুই টেনশন নিস না বেশি…আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি তোর ওখানে…রাখছি!”
সূর্যর সাথে কথা বলা হয়ে গেলে, দুশ্চিন্তায় কাঁপা কাঁপা হাতে আবার ফোনটা নিজের পকেটে ভরে রাখল মৈনাক!

সূর্যর দমদম থেকে হাওড়ায় আসতে প্রায় এক দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে, এই কথা মৈনাক জানে। এই সময়টুকু এই বাড়িতে এই ভাবে একা বসে থাকতে খুব অসহায় লাগছিল তার। সন্ধ্যার অন্ধকার অনেক আগেই নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে…স্বাগতাকে ছাড়া পুরো বাড়িটাই যেন কোন প্রেত পুরীর মত খাখা করছে মৈনাকের চোখের সামনে। রোজকার সন্ধ্যা বেলার সাথে আজকের এই সময়টার এই বাড়ির চেহারায় কত পার্থক্য! আজ এই বাড়ির কোন ঘরে কোন আলো জ্বলে ওঠেনি, শোনা যায়নি কোন শঙ্খের ধ্বনি, আসছে না এই সময় টিভিতে অনুষ্ঠিত হওয়া কোনো মেগা সিরিয়ালের আওয়াজও! কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে মৈনাক বুঝতে পারল যে এখনও অবধি সে ফ্লাইটে পরে আসা পোশাকই পরে রয়েছে!

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সোফা থেকে উঠে পড়ল মৈনাক। তারপর নিজের বেডরুমে গিয়ে অন্য পোশাক খোঁজার উদ্দেশ্যে সুইচ অন করল সেই ঘরের লাইট। কিন্তু ঘরের লাইট জ্বলল না। সে আরো এক দুই বার চেষ্টা করল সুইচ অন-অফ করে, কিন্তু তাও জ্বলল না লাইট। হয়তো এখন কারেন্ট নেই, লোড শেডিং চলছে, ভাবল মৈনাক। সে এই অন্ধকার ঘরের মধ্যে কোনরকমে তার বিছানার পাশের একটি টেবিলের ড্রয়ার থেকে বার করল একটি মোমবাতি আর দেশলাই। তারপর মোমবাতিটাকে জ্বালিয়ে, টেবিলে দাঁড় করিয়ে, সেই আলোতেই অসুবিধাজনক ভাবে বদলে নিল নিজের পোশাক।

ওদের বিছানার সামনেই দেওয়ালে লাগান রয়েছে একটি বিশাল বড় আয়না। বিয়ের পর পরই মৈনাক নিজেই কিনে এনেছিল সেটাকে, মূলত স্বাগতার সাজ গোজ করার জন্যই। মোমবাতির আলোটা সেই আয়নার সামনে আসছিল না বলে, সেটাকে হাতে করেই, মৈনাক এসে দাঁড়াল আয়নাটার সামনে, শুধুমাত্র চুলটা একটু আঁচড়ানোর অভিপ্রায়ে।

কিন্তু এতদিনের পরিচিত এই আয়নাটার সামনে আসতেই কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল মৈনাকের। সে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে যে আয়নাটার ভেতর থেকে কার একটা নিঃশ্বাস নেওয়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। সে আয়নাটার আর একটু কাছে আসতেই, সেই মোমবাতির আলোতে দেখতে পেল যে আয়নার মাঝে তার নিজের চেহারাটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এল!…ঠিক যেন কারোর নিঃশ্বাস ত্যাগের বাষ্পতে ভরে উঠেছে গোটা কাঁচটাই! মৈনাক অবাক হয়ে চেয়ে রইল সেই দিকে…দেখতে দেখতে, সেই কাঁচে জমা বাষ্প যেন একটি পুরুষের মূর্তি ধারণ করল…সেই অশরীরি পুরুষ যেন আয়নার ভেতর থেকে বড় বড় চোখ মেলে চেয়ে আছে মৈনাকের দিকে! মৈনাক আতঙ্কে শিউরে উঠে ছুটে দুই পা পিছিয়ে এল সেই আয়নার কাছ থেকে…ওর কম্পিত হাত থেকে মোমবাতিটা ঘরের মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে দপ করে গেল নিভে!

পর্ব-২

মৈনাক রুদ্ধশ্বাসে সেই ঘর থেকে ছুটে বেরোতে গেল, কিন্তু দরজার সামনে আসতেই হঠাৎ দরজার দু’টো পাল্লা সজোরে এসে বন্ধ হয়ে গেল ওর মুখের সামনে! সে আছড়ে পড়ল বন্ধ দরজার গায়ে, নিজের সর্বশক্তি দিয়ে টেনেও আলাদা করতে পারল না দরজার দু’টি পাল্লা। সে আর্তচিৎকার করে দুই হাত দিয়ে বাড়ি মারতে থাকল দরজার গায়ে! তীব্র শব্দে কেঁপে উঠতে থাকল দরজা তথা তার পুরো বেডরুমটাই সেই আঘাতের চোটে, কিন্তু সেই দরজা খুলতে পারে কার সাধ্য! মোমবাতির আলো নিভে যাওয়ার পর পুরো ঘর জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজমান, শুধু পেছনের জানলা থেকে এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে সেই অভিশপ্ত আয়নার বুকে। অবশেষে, দরজা খোলার বৃথা প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়ে, মৈনাক কোন মতে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার গায়ে পেছন দিয়ে সেঁটে দাঁড়িয়ে আবার তার ভয়ার্ত দৃষ্টি রাখল সেই আয়নার প্রতি। সে এবারও স্পষ্ট দেখতে পেল, সেই ছায়ামূর্তিটা যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আয়নার ভেতর থেকে। এবার সে যেন হেলান দিয়ে দাঁড়াল, তার দুই হাত দিয়ে আয়নাটার কাঁচের বিপরীত পৃষ্ঠতলে স্পর্শ করে! এই হালকা চাঁদের আলোয়, মৈনাক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সেই অশরীরির দুই হাতের পাঁচটি করে আঙুলের ছাপ!

মৈনাক চাইল চিৎকার করতে, কিন্তু কোনো আওয়াজই সৃষ্টি করতে পারল না তার কণ্ঠের স্বরযন্ত্র। ঠিক এমন সময় ঘরের বাইরে, দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ আসতে লাগল! সে শুনতে পেল তার বন্ধু সূর্যর পরিচিত কণ্ঠস্বর,
–“মৈনাক…এই মৈনাক…তুই কি বৌদিকে খুঁজে না পেয়ে পাগল হয়ে গেছিস! বাড়ির সদর দরজা হাট করে খুলে রেখে এখন বেডরুমের দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসে আছিস!”
ঠিক তখনই অদৃশ্য হয়ে গেল আয়নার মধ্যে থাকা সেই ছায়ামূর্তি! আবার আয়নার মধ্যে নিজের স্বাভাবিক প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল মৈনাক…আর সূর্যর ধাক্কায়, এক ঝটকায় খুলে গেল ঘরের দরজাটা।

মৈনাক ছুটে গিয়ে আতঙ্কে খামচে ধরল সূর্যর জামার কলার, তারপর সে হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে বলে উঠল,
–“সূ…সূর্য…এই ঘরে…এই আয়নাটার মধ্যে কেউ আছে সূর্য…কেউ একটা আছে!”
সূর্যর বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল মৈনাকের কথাটা বুঝতে, তারপর সে অবিশ্বাস ভরা কণ্ঠস্বরে বলল,
–“হয়, হয়…এই রকম পরিস্থিতিতে মানুষ একটু ভুল ভাল দেখেই ফেলে!”
মৈনাক তীব্র প্রতিবাদের সুরে চিৎকার করে বলে উঠল,
–“তোর কি মনে হচ্ছে, আমি ভুল ভাল দেখছি? আমি তোকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছি?…না সূর্য, না…আমি সত্যিই এই আয়নার মধ্যে একটা ছায়া মূর্তিকে দেখেছি!”
সূর্য আবার বিরক্তি মেশান গলায় বলল,
–“আর সে তোর স্ত্রী স্বাগতা, তাই তো?”

এবার সূর্যকে অবাক করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মৈনাক, সে চিৎকার করে বলল,
–“তুই এখনো কেন বিশ্বাস করছিস না আমার কথা? ওটা একজন পুরুষের চেহারা ছিল, কোন মহিলার নয়!…আমি তোকে মিথ্যা কথা বলছি না রে, সূর্য!”
সূর্য এবার বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল,
–“ঠিক আছে, বুঝলাম…তবে এই কথাই পরে আসছি…আগে যে কাজে তোর কাছে এসেছি, সেই কাজ মেটাতে হবে। শোন তোর মোবাইলে বৌদির ছবি আছে নিশ্চয়? ব্যাস, আর দেরি না করে এখনই আমাদের একবার থানায় যেতে হবে…তুই কিছুক্ষণের জন্য এই সব ভাবা বন্ধ কর, নাহলে পুলিশের লোকেদের সামনে এই সব বলে ফেললে কিন্তু ওরা তোকে পাগল ভাববে, আর আমাদের সমস্যায় দৃষ্টিপাতই করবে না!”
মৈনাক কিছুক্ষন ধাতস্থ হলে, ওরা দু’জনেই ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল থানার উদ্দেশ্যে।

থানাতে গিয়ে বিশেষ কোন উল্লেখ্য ঘটনা ঘটল না। সেখানকার দীর্ঘদেহী একজন অফিসার তাদের কাছে আসা হাজারো এমন নিরুদ্দেশের ঘটনা লেখা একটি খাতার প্রায় শেষের দিকের পাতায় লিপিবদ্ধ করলেন মৈনাকের স্বাগতাকে না পাওয়ার আকুল অভিযোগ। ফটো নিয়ে তার সম্পর্কে হাজারো কথা জিজ্ঞাস করে, নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেই তিনি বললেন,
–“ঠিক আছে, আমরা আপনার স্ত্রীর কোন খোঁজ খবর পেলে অবশ্যই জানাব…এখন তাহলে আসুন।”
প্রতিনমস্কার করে বেশ নিরাশ চিত্তেই থানা থেকে বেরিয়ে এসেছিল মৈনাক আর সূর্য। ওরা আবার ফিরে এসেছিল মৈনাকের বাড়িতে।

মৈনাকের বেড রুমে ওরা এক সাথে কথা বার্তা বলছিল। সূর্য মৈনাককে জিজ্ঞাসা করল,
–“এই আয়নাটাতো এতদিন ধরে তোদের বেডরুমে আছে, এর আগে কি তোর এটাকে নিয়ে এমন কোন ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে?”
মৈনাক উদাসীন স্বরে বলল,
–“কই, না তো!”
এবার সূর্য বেশ গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
–“তুই যদি আমাকে সত্যি কথাই বলে থাকিস যে তুই ওই আয়নাটার মধ্যে কোন অতি প্রাকৃত-শক্তিকে উপলব্ধি করেছিস, তাহলে তোকে একটা কথা বলি…শুধু আমাদের ভারতবর্ষেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই আয়নাকে অশরীরি শক্তির বাসস্থান বলে মনে করা হয়! এর পেছনে কিন্তু কারণ আছে…বিভিন্ন প্যারানর্মাল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যে আত্মা হল আলোর মতই একটি শক্তি…আলো যেভাবে আয়নার ভেতরে ঢুকে তার পৃষ্ঠতল থেকে প্রতিফলিত হয়, ঠিক সেভাবেই এই বিদেহী আত্মাদেরও আয়নার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ থাকে। সেই জন্য মনে করা হয়, যে ঘরে কোন মুমূর্ষ রোগী আছে বা কেউ মারা যাচ্ছে, সেই ঘরে আয়না রাখা উচিত নয়, আর তা রাখলেও সেটাকে যেন দেওয়ালের দিকে ঘুরিয়ে রাখা হয়…নাহলে সেই রোগীর বা যার মৃত্যু হচ্ছে, তাদের আত্মার বিশাল সম্ভাবনা এই আয়নার ভেতর প্রবেশ করে তার মধ্যেই বাস করার! এছাড়াও, কেউ কেউ তো আয়নাকে “পোর্টাল”-ও মনে করেন, অর্থাৎ অশরীরি শক্তিদের তাদের দুনিয়া থেকে আমাদের দুনিয়ায় যাওয়া আসার সংযোগস্থল!”

এতক্ষন মৈনাক স্তব্ধ হয়ে শুনছিল সূর্যর কথা, এবার সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,
–“তার মানে বুঝতে হবে যে এই আয়নার মধ্যেও কারোর প্রেতাত্মা লুকিয়ে আছে!…কিন্তু এতদিন তো সে কোন ভাবে আমাদেরকে দেখা দেওয়ার চেষ্টা করেনি!”
ওর কথা শেষ না হতেই সূর্য অধৈর্য স্বরে বলে উঠল,
–“তার কারণ এতদিন এই আত্মার তোর সাথে যোগাযোগ করার কোন প্রয়োজন হয়নি…কিন্তু এখন হয়েছে! কিন্তু কেন? কেন সে চাইছে তোর সাথে কথা বলতে? কি এমন ঘটনা ঘটেছে এখন যে…”
ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মৈনাক বলে উঠল,
–“ঘটনা তো ঘটেছেই, সূর্য…এই যে স্বাগতা নিখোঁজ হয়েছে!”

ব্যাপারটাকে আন্দাজ করে সূর্যও হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মৈনাকের দিকে। তারপর দৃঢ় স্বরে তাকে বলে উঠল,
–“তার মানে…হোক না হোক….এই আত্মার বৌদির নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সাথে কোন সম্পর্ক আছে….হয়ত সেই ব্যাপারেই সে কোন কথা তোকে বলতে চেয়েছিল!”
মৈনাক আতঙ্কে শিউরে উঠে একবার তাকাল সেই আয়নাটার দিকে। কিন্তু এখন তার মধ্যে যেন অস্বাভাবিকতার লেশ মাত্র নেই। এবার সূর্য মৈনাককে ঝাঁকিয়ে ধরে চিৎকার করে বলে উঠল,
–“শোন মৈনাক, শোন…আমাদের সকলের আগে জানতে হবে, যে এই আয়নাটার মধ্যে কার প্রেতাত্মা বাস করছে…তারপরই আমরা বুঝতে পারব যে তার কি সম্পর্ক আছে বৌদির নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সাথে!…আর জন্য তোকে বলতে হবে তুই কোথা থেকে এই আয়নাটা কিনেছিলিস…ভালো করে ভেবে বল, মৈনাক…আমাদের হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই!”

মৈনাক তার মস্তিষ্কে জোর দিয়ে ভাবতে লাগল এই প্রশ্নের উত্তর…

পর্ব-৩

মৈনাকের কিছুক্ষণ ভেবেই মনে পড়ে গেল এই আয়নাটা কেনার ঘটনার কথা। সে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল,
–“বিয়ের পরেই একবার আমি আর স্বাগতা বড়বাজারের একটা মার্কেটে গিয়েছিলাম কিছু কেনাকাটা করার উদ্দেশ্যে। সেখানেই একটি কিউরিও-র দোকানে এই আয়নাটাকে দেখে খুব পছন্দ হয় স্বাগতার, সে ওটা কেনার কথা বলে। আমি গিয়ে দোকানদারের সাথে কথা বলে জানতে পারি, স্থানীয় কোন এক সাহা বাড়ি থেকে নিলামে এই আয়নাটা কিনেছে সে! আমি খুব একটা রাজি চিলাম না এটা কিনতে, স্বাগতাকে বলেছিলাম যে যদি বাড়িতে আয়নার দরকারই হয়, তাহলে নতুন আয়না কিনে দিচ্ছি…এরকম একটা ব্যবহার করা, নিলামে বিক্রি হওয়া আয়না কিনে কি লাভ? কিন্তু স্বাগতা নাছোড়বান্দা, তার নাকি এই সব এন্টিক জিনিসই বেশি পছন্দের! তাই সেদিন বাধ্য হয়ে এই আয়নাটা কিনে এনেছিলাম। পরে বাড়িতে মিস্ত্রি ডেকে এটা আমাদের বেডরুমের দেওয়ালের সাথে আটকে নিয়েছিলাম।”

সূর্য ওকে থামিয়ে উত্তেজিত স্বরে চিৎকার করে বলে উঠল,
–“এক মিনিট মৈনাক, সেই দোকানদার তোকে কি বলেছিল, সে এই আয়নাটাকে যেন কোথা থেকে কিনেছে?”
মৈনাক বিরক্ত হয়ে বলে উঠল,
–“ওফ বললাম তো, বড়বাজারের কোন এক সাহা বাড়ি থেকে…ও হ্যাঁ, দোকানদার এই কথাও বলেছিল যে ওটা নাকি সেই অঞ্ছলের এক বিখ্যাত বনেদি বাড়ি, বেশ বড় পারিবারিক ব্যাবসা ছিল ওদের আগে সেই ব্রিটিশদের সময় থেকে…কিন্তু এখন ওদের ওই বাড়িটা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। ব্যাবসা তো অনেক আগেই উঠে গিয়েছে এবং এখন খুব খারাপ আর্থিক অবস্থা ওই পরিবারের, তাই তো তারা বাধ্য হয়েছে বাড়ির পুরনো এন্টিক জিনিসগুলোকে পয়সার জন্য এভাবে নিলামে বিক্রি করে দিতে!”

মৈনাকের এই কথাগুলি বলার সাথে সাথেই হঠাৎ যেন একবার কেঁপে উঠল আয়নাটা! ওরা দু’জনেই চমকে উঠে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল সেটার দিকে…আর ঠিক তেমনই সময় সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল সেই ঘরের সমস্ত জানালা দরজা। ওরা শিহরিত হয়ে দেখল, যে আয়ানার কাঁপুনি যেন ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলেছে… মনে হচ্ছে যেন এখনই সেটা দেওয়াল থেকে খুলে নিচে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে!…তবে তা কিন্তু হল না। হঠাৎ কোনো এক ক্ষুব্ধ অশরীরি পুরুষ কণ্ঠের গুরুগম্ভীর আর্তচিৎকারে পুরো বাড়িটাই যেন কেঁপে উঠল। আবারও আয়নার কাঁচটা ঝাপ্সা হয়ে এল, কিন্তু এবার আর কোন পুরুষের মূর্তি তার মধ্যে দেখা গেল না। সূর্য ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,
–“কে আছে আয়নার মধ্যে…কে?”
কিন্তু সেই প্রশ্নের কোন উত্তর এল না, তার পরিবর্তে, সেই অদৃশ্য অশরীরির পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল,
–“স্বাগতাআআআআ…”
এই নাম শুনে, আর উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না মৈনাক, সে ধপ করে বসে পড়ল ঘরের মেঝের ওপর। কিন্তু সূর্য যেন এখনও বেশ শক্ত হয়ে আছে, সে আবার সেই কম্পিত আয়নাটার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠল,
–“কি হয়েছে স্বাগতা বউদির? বল কি হয়েছে তার? কোথায় চলে গিয়েছে সে?. ..বল… আমার কথার জবাব দাও…”

কিন্তু এবারও তার প্রশ্নের কোন জবাব এল না, তার পরিবর্তে আবার গর্জে উঠল সেই ভৌতিক আয়ানা,
–“সুনীতিইইইই…”
এবার বেশ অবাক হয়ে গেল ওরা দু’জনেই! “সুনীতি” বলে তো ওরা কাউকে চেনে না, তাহলে এ কার কথা বলছে এই আয়নার ভেতর বসবাসকারী ওই প্রেতাত্মা! সূর্য আবার কিছু বলতে চলেছিল, কিন্তু তার আগেই, এবার তৃতীয় বার শোনা গেল সেই অশরীরির হাড় হিম করা কণ্ঠস্বর,
–“অবিনাশশশশশ…”
এবার আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে থাকার চেয়ে আর কোন উপায় ছিল না ওদের দু’জনেরই, কারণ, যথারীতি এই “অবিনাশ” বলেও কাউকে ওরা চেনে না! কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঁপা বন্ধ হয়ে গেল সেই আয়ানাটার, স্বাভাবিক হয়ে গেল তার কাঁচের প্রতিফলন ক্ষমতা, আর খুলে গেল সেই ঘরের সমস্ত জানলা দরজা। কিন্তু মৈনাক আর সূর্যর বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় ফিরে আসতে আরো বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল।

কিছুক্ষণ পর সূর্য বলে উঠল,
–“শোন মৈনাক, ওই ‘আয়না’ কিন্তু আমাদের যথেষ্ট ‘ইঙ্গিত’ করে দিয়েছে, তবুও আমরা এখনও জানি না যে বৌদির সাথে আর কাদের দু’জনের নাম এই প্রেতাত্মা আমাদের বলতে চাইল, আর বৌদির নিখোঁজ হওয়ার সাথে এদের দু’জনের কি সম্পর্ক আছে… তবে এখানে এভাবে বসে থাকলে কিন্তু আমরা আমাদের কোন প্রশ্নেরই উত্তর পাব না!”
ওর কথা শেষ না হতেই মৈনাক অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,
–“তাহলে কে বলবে আমাদের এই কথাগুলো…কোথায় গেলে পাব আমরা আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর?”
সূর্য এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল,
–“যেখান থেকে এই আয়নাটা নিলামে বিক্রি করা হয়েছিল…আমাদের যেতে হবে সেই বড়বাজারের সাহা বাড়িতে!”

ওরা সেই রাতটা কোন রকমে কাটিয়ে পরের দিন সকালেই রওনা হল সেই সাহা বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওদের ভাগ্য ভালো ছিল, বড়বাজারের সেই কিউরিওর দোকানটা তখনও সেখানে খোলাই ছিল। সেই দোকানের মালিককে জিজ্ঞাসা করতেই ওরা পেয়ে গেল সাহা বাড়িতে যাওয়ার পথ নির্দেশ। ওরা সেখান থেকে আন্দাজ দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিল সেই বাড়ির সামনে। এক কালে যে এই পরিবারের বেশ ভালো আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল, তা এখনও এই ভাঙ্গা চোরা সুবৃহৎ পুরনো আমলের তৈরি বাড়িটাকে দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু এখন যে তাদের সুখের দিন শেষ হয়েছে তা প্রমাণ করে দিচ্ছে এই এত বড় সম্পত্তির নিদারুন দেখাশোনার অভাব। ওরা আর বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখে বেশি সময় নষ্ট না করে সোজা গিয়ে বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ল। একটু পরেই সাধারন লুঙ্গি আর ফতুয়া পরিহিত, একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক ওদের সামনে দরজা খুলে দাঁড়াল। দেখেই বোঝা যায় যে তিনি একসময় বেশ সুদর্শন চেহারার অধিকারী ছিলেন, কিন্ত এখন ক্রমাগত অভাব অনটনে বেশ ভেঙ্গে পড়েছে তার স্বাস্থ্য। তাছাড়া, মৈনাক আর সূর্যর মত তাকেও বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছে দেখে।

ওদের কিছু বলার আগে, স্বয়ং সেই ভদ্রলোকই যেন বেশ উদ্বেগের সাথে বলে উঠলেন,
–“আপনারা কি আজকের খবরের কাগজটা পড়ে তারপর এখানে এসেছেন?”
ওরা দু’জনেই অবাক হয়ে গেল এই কথা শুনে। মৈনাক বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল,
–“মানে?”
সেই ভদ্রলোক ওদেরকে অবাক করে দিয়ে অধৈর্য গলায় বলে উঠলেন,
–“আজকের খবরের কাগজেই তো বেরিয়েছে খবরটা…গত পরশু দিন থেকে আমার দাদার মেয়ে সুনীতিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! পুলিশকে জানানোর সাথে সাথে আমি খবরের কাগজেও এই নিরুদ্দেশের কথাটা জানিয়েছিলাম…আপনারা কি সুনীতির কোন খোঁজ খবর পেয়ে আমাকে জানাতে এসেছেন? বলুন…দয়া করে বলুন…আপনারা কি দেখেতে পেয়েছেন মেয়েটাকে কোথাও?”

ওরা দু’জনেই অবাক হয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল সেখানে, বিস্ময়ে ওদের বাকশক্তি যেন লোপ পেয়েছে! এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন সেই ভদ্রলোক, তার পর হতাশা ভরা কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
–“হায় ঈশ্বর, কত বার করে আমি মেয়েটাকে বলেছিলাম, ওই অবিনাশ ছেলেটার সাথে না মিশতে! ও মটেই ভালো ছেলে নয়… প্রেমের নাটক করছে সে ওর সাথে! কিন্তু মেয়ে শুনলে তো আমার কথা…কে জানে, ছেলেটা যে ওকে কোথায় নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে! সুনীতির মতই অবিনাশকেও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ওই একই দিন থেকে!”

এবার যেন আরো বড় ঝটকা খেল ওরা দু’জনে…স্বাগতা, সুনীতি আর অবিনাশ…এই তিন জনেরই নাম নিয়েছিল মৈনাকের বাড়ির আয়নায় থাকা সেই প্রেতাত্মা! আর এখন ওরা জানতে পারল যে এই তিনজনেই নিখোঁজ হয়েছে! এ কোন রহস্যের গোলোকধাঁধায় ফেঁসে গেল ওরা, এই কথা ভেবে যেন ওদের মাথা ঘুরতে লাগল!

পর্ব-৪

সেই ভদ্রলোক আপন মনে কত কি বলে চললেন, কিন্তু সে সব আর মৈনাক আর সূর্যর কানেই ঢুকল না। পরমুহূর্তেই কথার ঘোর কেটে গেল ভদ্রলোকের, এবার তিনি বেশ সন্দিগ্ধ গলায় বলে উঠলেন,
–“সুনীতির কোন খবর যখন আপনাদের কাছে নেই, তাহলে আপনারা কারা? আর আমার কাছে আপনাদের কি দরকার?”
কিছুক্ষণ তো ওরা দু’জনে ভেবেই পেল না, যে কোথা থেকে শুরু করবে! সবার প্রথমে সূর্যই মুখ খুলল, সে তার আর মৈনাকের পরিচয় সেই ভদ্রলোককে দিয়ে বলল,
–“কি ভাবে যে আপনাকে সব কিছু বলব, তা বুঝে উঠতে পারছি না…শুধু এইটুকু জেনে রাখুন, আপনি যেমন সুনীতি আর অবিনাশের খোঁজ পাচ্ছেন না, ঠিক তেমনই…এই যে আমার বন্ধু মৈনাক..সে তার স্ত্রী স্বাগতাকেও খুঁজে পাচ্ছে না!…আর আশ্চর্যজনক ভাবে, এই তিনজনই কিন্তু নিখোঁজ হয়েছে একই দিন থেকে!”

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ বিহ্বল চোখে চেয়ে রইলেন ওদের দিকে। যেন বিশ্বাসই করতে পারলেন না ওদের কথা। তারপর এতক্ষণ পর ওদেরকে নমস্কার জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
–“নমস্কার, আমার নাম অম্লান সাহা…বুঝলাম আপনাদের কথা, কিন্তু আপনারা এখানে কি মনে করে আসছেন?”
মৈনাক বেশ দৃঢ় গলায় বলে উঠল,
–“শুধু একটা কথা জানার জন্য, আপনারা কি এই বাড়ির কোন আয়না কখনো নিলামে বিক্রি করেছিলেন?”
অম্লান বাবু বেশ বিরক্ত হলেন এই কথা শুনে, তিনি বলে উঠলেন,
–“এই সব কথা জানার কি আপনারা আর সময় পেলেন না মশাই, বাড়ির একটা মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে…আর আপনারা পড়ে আছেন কোন এক আয়না নিয়ে!”
তার কথা শেষ না হতেই সূর্য চিৎকার করে বলে উঠল,
–“সম্পর্ক আছে, অম্লান বাবু!…ওই আয়নার এই তিনটি মানুষের নিখোঁজ হওয়ার সাথে সম্পর্ক আছে…আর এই কথা আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে, কারণ আজ ওই “আয়নার ইঙ্গিত”-কে অনুসরণ করেই আমরা এখানে আসতে পেরেছি!”
এই বলে বিস্ময়ে হতবাক অম্লান বাবুর কাছে ওরা বলে গেল সেই আয়নাকে কেন্দ্র করে ওদের একটার পর একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা!

অম্লান বাবু এই কথাগুলো সম্পূর্ণ রূপে বিশ্বাস করলেন কিনা কে জানে, কিন্তু সমস্ত ঘটনা শোনার পর, তিনি বেশ আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন,
–“আ…আমার মনে পড়েছে….ওই আয়নাটা এই এই বাড়িতেই আমার দাদার ঘরের দেওয়ালে আটকানো ছিল!”
তার কথা শেষ না হতেই মৈনাক বলে উঠল,
–“বেশ, তাহলে হঠাৎ ওটা নিলামে বেচতে গেলেন কেন?”
অম্লান বাবু বেশ করুণ কণ্ঠে বললেন,
–“আসলে সেই সময় পয়সার বেশ টানাটানি যাচ্ছিল তাই ভাবলাম যে…আর তাছাড়া দাদার মৃত্যুর পর তো ওই আয়নাটা আর কেউ ব্যবহারও করত না!”
সূর্য এবার তীক্ষ্ণ স্বরে তাকে জিজ্ঞাসা করল,
–“আপনার দাদা কি ভাবে মারা গিয়েছিল, অম্লান বাবু?”
একটা দীর্ঘনিঃস্বাস ফেলে অম্লান বাবু বলতে লাগলেন,
–“দাদার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছিল…আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম তাকে বাঁচানোর, কিন্তু পারলাম না…হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে আনার পর এই বাড়িতেই তার ঘরে তার জীবনের শেষ মুহূর্ত কাটে, এখানেই মৃত্যু হয় দাদার!…কিন্তু জানেন, দাদা এত তাড়াতাড়ি মরতে চায়নি…সে আরো কিছুদিন বাঁচতে চেয়েছিল…বাঁচতে চেয়েছিল!”

এই বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন অম্লান বাবু। সূর্য তার মানসিক অবস্থার দিকে কোন দৃষ্টিপাত না করেই আবার তাকে প্রশ্ন করে উঠল,
–“ভালো করে ভেবে বলুন, অম্লান বাবু…যে সময় আপনার দাদার এই বাড়িতে মৃত্যু হয়, সেই সময় কি সেই ঘরের দেওয়ালে ওই আয়নাটা লাগানো ছিল?…বলুন অম্লান বাবু…”
অম্লান বাবু হঠাৎ কান্না থামিয়ে তাদের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে, অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন,
–“হ্যাঁ…হ্যাঁ ছিল!”
মৈনাক আর সূর্যর মনে হল, ওদের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল! ওদের আর বুঝতে বাকি রইল না, যে ওই আয়নার ভেতর বসবাসকারী প্রেতাত্মা আর কেউ নয়…সে হল এই অম্লান বাবুর দাদা তথা সুনীতির বাবা!

ওরা আর এক মিনিটও সেখানে অপেক্ষা না করে ফিরে এল মৈনাকের বাড়িতে। এখন নিজের বাড়ির, এই অতি পরিচিত ঘরে ঢুকতেই কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগল মৈনাকের। সে ভেবেই শিউরে উঠতে লাগল, যে এতদিন সে আর স্বাগতা একজন তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির মাঝেই এই ঘরে এক সাথে রাত্রিবাস করেছে! কিন্তু এখন এই সব কথা ভেবে কোনো লাভ নেই, কারণ এখনো অবধি তারা শুধু এইটুকু বুঝতে পেরেছে, যে একজন পিতার আত্মা তার মেয়ে এবং মেয়ের প্রেমিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে থাকা কোন কারণের কথা তাদের বলতে চেয়েছে…কিন্তু স্বাগতা! স্বাগতার নামও কেন নিল সেই প্রেতাত্মা? তার মানে কি স্বাগতারও এই সুনীতি আর অবিনাশের নিখোঁজ হওয়ার সাথে কোন সম্পর্ক আছে?

মৈনাকের চিন্তার ঘোর কেটে গেল সূর্যর তীব্র গলার আওয়াজে,
–“শোন মৈনাক, এবার এই সমস্ত রহস্যের জট খোলার একেবারে শেষ চেষ্টা করতে হবে আমাদের!”
মৈনাক আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল সূর্যর দিকে, সে বলেই চলল,
–“যেভাবেই হোক, এই আত্মাকে ডেকে পাঠাতে হবে আমাদের আবার…তাকে বার করতে হবে এই আয়নার কারাগার থেকে!…তারপর যা করার সেই করবে…সেই হবে আমাদের এই রহস্য ভেদ করার পথ নির্দেশক!”
মৈনাক অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,
–“কিন্তু কি ভাবে তাকে বার করব আয়না থেকে?”
সূর্য দৃঢ় গলায় বলে উঠল,
–“তাকে ওই আয়না থেকে বার করতে গেলে লাগবে একজন “মিডিয়াম”…আয়না থেকে বেরিয়ে যার শরীরের ভেতর সে প্রবেশ করে তার কর্তব্য পালন করবে…আর আমিই হব সেই মাধ্যম!”
মৈনাক প্রতিবাদী কণ্ঠে বলে উঠল,
–“না ভাই সূর্য, তুই এমনিতেই আমার জন্য অনেক করেছিস…আর তোকে আমি বিপদের মধ্যে ফেলতে পারব না! ওই মিডিয়াম হব আমি…যা হবার আমার হবে!”
অনেক চেষ্টা করেও এই ব্যাপারে মৈনাককে রাজি না করতে পেরে, অগত্যা সূর্য শুরু করল তার পরবর্তী কাজ!

সেই ঘরের সমস্ত জানলা দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। তারপর একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে, সূর্যর কথামত মৈনাক সেটাকে হাতে করে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সেই আয়নাটার সামনে। সেই আয়না আর মৈনাকের চারিপাশে সূর্য ছড়িয়ে দিল নুনের ছিটে! তারপর, শুধুমাত্র একটি মোমবাতির দ্বারা আলোকিত সেই অন্ধকার ঘরের ভয়াবহ পরিবেশের মধ্যে ওরা কিছুক্ষণ আয়নাটার দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর আবার সূর্যর কথামত, মৈনাক একটা ধারালো চাকু দিয়ে তার ডান হাতের এক অংশে হালকা চির লাগিয়ে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা রক্তের ফোঁটাগুলিকে ছিটিয়ে দিল সেই আয়নার গায়ে!

আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না তাদের!…আবার কেঁপে উঠল সেই আয়না…ঝাপসা হয়ে এল তার কাঁচ…আবার একটা বিকট আর্তচিৎকার করে আয়নার কাঁচের বিপরীত পৃষ্টতলে নিজের দুই হাত ঠেকিয়ে দৃশ্যমান হল সেই ছায়ামূর্তি! সূর্যর কথামত মৈনাকও তার কম্পিত হাত দু’টিকে নিয়ে গেল আয়নার কাছে…খুব কাছে…সে তার দুই হাতের পাঁচটি করে আঙ্গুল রাখল আয়নার ঠিক সেই জায়গায়, যার অপর দিকে হাত রেখেছে সেই প্রেতাত্মা!…সূর্য স্পষ্ট চেয়ে দেখল, আয়নার ভেতরের সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে এক ঝটকায় ঢুকে গেল মৈনাকর দেহে!…একটা তীব্র চিৎকার করে আয়না থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে তার দিকে পেছন ফিরে ঘুরে গেল মৈনাক…তার চোখ দু:টি হয়ে উঠেছে রক্তের মত লাল! মৈনাক উন্মাদের ভঙ্গিতে এক ছুটে সেই ঘরের দরজা খুলে অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরের পথে!

শেষ পর্ব

সোনাগাছির নিষিদ্ধ পল্লীর একটি ছোট ঘুপচি ঘরে দুই দিন ধরে আটকে রাখা হয়েছিল মেয়েটাকে। শুধু দু’বেলা করে দু’টো শুকনো রুটি আর আলু চচ্চড়ির থালা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তার সামনে, ঘরের দরজাটাকে অল্প ফাঁক করে। তারপর আবার বাইরে থেকে সজোরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সেই ঘরের দরজা। চোখের জল যেন শুকিয়ে গিয়েছিল মেয়েটার, চিৎকার করে গলাও গিয়েছিল বসে, বার বার বন্ধ দরজায় বারি মেরে তার দুই হাতও করছিল টনটন। সে কোনো মতে পড়ে ছিল সেই ঘরে রাখা ময়লা চাদরে আবৃত ছোট একটা খাটিয়ার ওপর। নিজের করা ভুলের জন্য আফসোসে তার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু এই ঘরে না তো আছে কোন দড়ি, না এক শিশি বিষ, না এক টুকরো ধারালো কাঁচ!

ঠিক সেই সময় হঠাৎ খুলে গেল ঘরের দরজা…সেই ঘরে প্রবেশ করল উগ্র সাজ পোশাকে বেষ্টিত মুর্তিমতী দানবীর মত চেহারার এক মাঝ বয়সী মহিলা। আর তার পেছনে পেছনে এল, সেই অসহায় মেয়েটির দিকে কামোত্তেজিত দৃষ্টিতে চেয়ে, অগুন্তি সোনার হার আর আংটি পড়া এক মদ্যপ ধনীর দুলাল! মেয়েটি ছুটে গেল সেই মহিলার কাছে, তারপর তার দুই পা জড়িয়ে ধরে আকুল কণ্ঠে বলল,
–“আ…আমায় ছেড়ে দাও মাসী…যেতে দাও আমায়…তুমি তো আমার মায়ের মত…আমার এতবড় সর্বনাশটা করো না, মাসী…করো না!”
সেই নিষ্ঠুর মহিলা এবার চুলের মুঠি ধরে সেই মেয়েটিকে তুলে তাকে আবার বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
–“আয় হায়, জানিস এই বাবু তোর সাথে এক রাত বিতানোর জন্য, হামাকে কত রূপিয়া দিয়েছে…বিশ হাজার!…আর তু বোল রহি হে কি তুই চলে যাবি, হ্যাঁ? কভি নেহি!”
তারপর সে সেই মদ্যপ যুবকের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল,
–“যান বাবু যান, পুরো ফ্রেশ মাল আছে…অভি তক নত ভি উতড়ি নেহি!…আপনা সুহাগ রাত মানিয়ে নিন!”

মেয়েটা আরো একবার চিৎকার করে কিছু একটা বলতে চাইল, কিন্ত সেইদিকে কোন দৃষ্টিপাতই করল না সেই “মাসী”, সে তাড়াতাড়ি সেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল। এবার সেই মদ্যপ যুবক এক মুহূর্তের মধ্যে খুলে ফেলল তার পরনের পোশাক…অর্ধনগ্ন অবস্থায় সে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটির গায়ের উপর…একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে উঠল অসহায় মেয়েটি!

এমন সময় হঠাৎ সেই ঘরের বন্ধ দরজার দুই পাল্লা সশব্দে ভেঙে পড়ল ঘরের মেঝের ওপর। আর সেই ঘরে রক্তের মত রাঙা চোখ নিয়ে প্রবেশ করল আরেকজন পুরুষ…সে আর কেউ নয়, মৈনাকের দেহে ভর করা সেই আয়নার অশরীরি আত্মা!…এক ঝটকায় মৈনাক ঘাড় ধরে তুলে নিল ওই ধর্ষণ ক্রিয়ায় মত্ত মদ্যপ যুবকটিকে সেই মেয়েটির শরীরের ওপর থেকে…তারপর সে ছুঁড়ে মারল ছেলেটির শরীরটাকে সেই ঘরের দেওয়ালে থাকা টিউব লাইটের দিকে…সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের দাপটে জ্বলন্ত মুখ ঢেকে একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে, ঘরের মেঝের ওপর পড়ে গেল সেই অর্ধনগ্ন মদ্যপ যুবকের দেহ। এর পর দুই জন গুন্ডা গোছের ছেলেকে সেই ঘরে নিয়ে প্রবেশ করল সেই “মাসী”…মৈনাক এবার ছুটে গেল সেই মহিলার দিকে, তারপর সেই মুহূর্তে একটা কষিয়ে চড় লাগাল তার গালে…নাক মুখ দিকে রক্ত বেরিয়ে তখনই একটা চিৎকার করে ঘরের মেঝের ওপর পড়ে গেল সেই মহিলা!…এবার বাকি ছেলে দু’টো তেড়ে আসল মৈনাকের দিকে…মৈনাক যেন তাদের পাত্তাই দিল না…সে দুই হাত দিয়ে দু’জনের গলা চেপে ধরে তাদের কিছুক্ষণ শূন্যে ঝুলিয়ে রেখে তারপর তাচ্ছিল্যের সাথে তাদের দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল!

এতক্ষণ ধরে আতঙ্কে স্তম্ভিত হয়ে অসহায় মেয়েটি পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছিল এই সমস্ত ঘটনা। এবার মৈনাক রুপী সেই প্রেতাত্মা তার কাছে এল ধীরে ধীরে…তারপর মৈনাকের গলা থেকে কোন এক অজানা কণ্ঠস্বরে সেই অশরীরি তাকে বলে উঠল,
–“সুনীতি!…সুনীতি, মা আমার….আমি তোকে এই নরক থেকে উদ্ধার করতে এসেছি মা…চল আমার সাথে…”
কিন্তু মেয়েটি ঠিক চিনতে পারল সেই কন্ঠস্বর, সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলে উঠল,
–“বাবা…বাবা তুমি!…তুমি এসেছ বাবা!”

এর কয়েক ঘন্টা পর স্থানীয় থানায় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল! কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ সেই থানার ওসির চেম্বারে তার সামনে সুনীতির হাত ধরে প্রবেশ করল মৈনাক…এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল থানার সকলেই! কিন্তু কারোর কিছু বলার আগেই, একবার নিজের লাল চোখের করুণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখল সেই প্রেতাত্মা সুনীতির দিকে, তারপর একবার সেই বিস্ময়ে স্তব্ধ মেয়েটির মাথায় আলতো হাতের স্পর্শ করে হঠাৎ কেঁপে উঠল মৈনাকের শরীর। একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে মৈনাকের শরীরটা লাফিয়ে উঠে গেল শূন্যে…সুনীতির যেন মনে হল যেন একটা উজ্জ্বল আলোর গোলক…কোন একটা অস্বাভাবিক তেজস্বী শক্তি যেন বেরিয়ে গেল মৈনাকের শরীর থেকে….তারপর সে তার একমাত্র মেয়েকে সারা জীবনের জন্য বিদায় জানিয়ে উঠে গেল ওপরে…আরো ওপরে…ওই দূর আকাশের বুকের মাঝে! এই দৃশ্য কিন্তু থানার আর কোনো লোক দেখতে পেল না, তারা শুধু বুঝল, যে মৈনাক অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল নিচে! চিৎকার করে বললেন সেই থানার ওসি,
–“এই, কেউ জল নিয়ে আসো…তাড়াতাড়ি!”

মৈনাকের জ্ঞান ফিরল পরের দিন অনেক বেলার দিকে। সে চোখ মেলে চেয়ে দেখল, সে নিজের বেডরুমের বিছানার ওপর শুয়ে আছে। তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে সূর্য, সে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে.. এছাড়াও ঘরে উপস্থিত অম্লান বাবু, যিনি বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন সুনীতিকে…তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন পুরো টিম সহ থানার ওসি…কিন্তু তারা হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে যাদের ধরে রেখেছেন, তাদের দেখে চমকে উঠল মৈনাক!…তাদের মধ্যে একজন অচেনা সুদর্শন যুবক, এবং আরেকজন হল স্বয়ং মৈনাকের হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী, স্বাগতা!

মৈনাকের কিছু বলার আগেই বলে উঠলেন ওসি সাহেব,
–“আপনি তো কামাল করে দিলেন, মৈনাক বাবু!…আজ আপনার জন্য বেঁচে গেল সুনীতির ইজ্জত, এবং আমরা ধরতে সক্ষম হলাম একটি বড় নারী পাচার এবং মধুচক্রের কেন্দ্রবিন্দুকে!”
তারপর তিনি গ্রেফতার হওয়া স্বাগতা আর সেই অচেনা যুবকটির দিকে চেয়ে বললেন,
–“কি স্বাগতা দেবী…কি অবিনাশ বাবু…একবার আপনাদের কুকর্মের কথাগুলো বলুন মৈনাক বাবুকে!”
ওরা দু’জনেই মাথা নিচু করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

অগত্যা, ওসি সাহেবই বলে চললেন,
–“মৈনাক বাবু, আপনার স্ত্রী স্বাগতার পিরিত ছিল অবিনাশের সঙ্গে, ওরা দু’জনে এক সাথে পালিয়ে গিয়ে সংসার পাততে চেয়েছিল…কিন্তু তার জন্য লাগত অনেক পয়সা। তাই ওরা দু’জনে একটা প্ল্যান করল…অবিনাশের প্রতি সুনীতির একটা দুর্বলতা আগে থেকেই ছিল। সেটাকে কাজে লাগিয়ে, মিথ্যা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার অছিলায়, অবিনাশ সুনীতিকে এই বাড়িতেই তুলেছিল যখন আপনি ছিলেন ব্যাঙ্গালোরে!…ও সুনীতিকে মিথ্যা করে বলেছিল যে এটা তার এক বান্ধবীর বাড়ি, এখানে একটা রাত কাটিয়ে ওরা পরের দিনই কলকাতার বাইরে রওনা দেবে…সেই রাতেই স্বাগতা আর অবিনাশ সুনীতিকে এই বেডরুমেই প্রথমে ফ্রুট জুসের মধ্যে ঘুমের ওষুধ খায়িয়ে অজ্ঞান করে, তারপর আগে থেকেই বলে রাখা, সোনাগাছির এক নিষিদ্ধ পল্লীর দালালের গাড়িতে তার অজ্ঞান দেহটা তুলে দেয়…আর এর জন্য ওরা সেই দালালের কাছ থেকে পায় দুই লক্ষ টাকা!”

–“অবিনাশ পারলে লোক দিয়ে সুনীতিকে রাস্তা ঘাট থেকেই কিডন্যাপ করাতে পারত, কিন্তু সেখানে আছে মেয়েটার চিৎকার চেঁচামেচিতে লোক জানা জানি হওয়ার ভয়, যা আপনার এই বাড়িতে একটুও নেই!…এরপর সেই টাকা নিয়ে আর নিজেদের মোবাইলে অন্য সিম কার্ড পুরে গা ঢাকা দিল স্বাগতা আর অবিনাশ…কিন্তু ওরা ভুলে গিয়েছিল, যে ওদের মোবাইলের আই.এম.ই.আই নাম্বার ট্র্যাক করে আমরা ইচ্ছা করলেই ওদের ধরতে পারি, যা আমরা পেরেছি কয়েক ঘন্টা আগে! ওরা হয়তো কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল, কিন্তু তার আগেই হাওড়া স্টেশন চত্বর থেকে ওদেরকে আমরা এরেস্ট করি!…তবে মৈনাক বাবু, একটা কথা বলুন…আপনি কি ভাবে জানলেন, যে ওরা সুনীতিকে সেই নিষিদ্ধ পল্লীর ওই ঘরটাতেই রেখেছে?”

মৈনাক এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুনছিল ওসির সমস্ত কথা। যে স্বাগতাকে এতক্ষণ ধরে হন্যে হয়ে সে খুঁজে চলেছিল, তার প্রতি বিতৃষ্ণায় ভোরে উঠলো তার মন। সে নিজের নজর ফিরিয়ে নিল স্বাগতা আর অবিনাশের দিক থেকে, তারপর আরেকবার তাকাল তার ঘরের দেওয়ালে আটকান সেই আয়নাটার প্রতি। সে জানে যে আর সেটা কোনো দিন কেঁপে উঠবে না, তার কাঁচটা ঝাপসা হয়ে গিয়ে তার মধ্যে কোন ছায়ামূর্তিকেও কখনো দেখা যাবে না আর…সে বুঝেছে, সেই আয়নার ভেতর থেকে সুনীতির বাবার প্রেতাত্মা পুরোটাই দেখেছিল যে এই ঘরের ভেতরই তার একমাত্র মেয়ের সাথে কি অন্যায় কাজ করা হচ্ছে, তাই তাকে বাঁচানোর জন্যই সে এইভাবে ক্রমাগত ইঙ্গিত করে গিয়েছে মৈনাক আর সূর্যকে!…ওসি সাহেবকে বলতে হবে সব কথা, তিনি বিশ্বাস করুন বা না করুন।

(সমাপ্ত)

Exit mobile version