উপহার
– পারমিতা ভট্টাচার্য
তন্দ্রা মাহাতো…..খুব গরীব ঘরের মেয়ে। বাবা ডমরু মাহাতো ক্ষেত মজুরের কাজ করে সংসার চালায় খুবই কষ্টে শিষ্টে।সংসারে খেতে পড়তেই সব পয়সা শেষ হয়ে যায়। তবু মেয়ে তন্দ্রাকে একটু বেশীই ভালোবাসতো ডমরু। কারণ পড়াশোনায় তন্দ্রা ছিল ভীষণ ভালো। ক্লাসে সে হতো দ্বিতীয়। একটা মাস্টারও দিতে পারেনি কখনও ডমরু। স্কুলের দিদিমনিরাও খুব সাহায্য করত তন্দ্রাকে। কিন্তু পোড়া কপাল হলে যা হয় আর কি! হঠাৎ দু’দিনের জ্বরে ডমরু মারা গেলো। ঘোর অন্ধকার নেমে এলো তন্দ্রাদের জীবনে। ওর মা লোকের বাড়ী বাসন মেজে পাঁচজনের পেট চালাতে পারতো না। তাই অনিচ্ছা সত্বেও তাকে তার মামার বাড়ী চলে যেতে হলো। মামারা তাকে লেখাপড়া শেখানোর থেকে সংসারী করতে বেশী উদ্যোগী ছিল। ঘাড় থেকে নামতে পারলে বাঁচে তারা। তন্দ্রা খুব ভালো কবিতা লিখতো। ছোটো হলেও তার লেখার হাত ছিল। সাথে বই পড়তেও খুব ভালোবাসত।অনেক কাকুতি মিনতি করেও কোনো লাভ হলোনা। কেউ তার কথায় কর্ণপাতই করলোনা। মামীরা ব্যাঙ্গের সুরে বলতো “ওসব কাব্যি করে পেট চলবেনা। সংসারের কাজ শেখো। কাজে দেবে।” যন্ত্রণা বুকে চেপেই একদিন তার থেকে বয়সে দ্বিগুণ একটা লোকের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পরও সে লেখাপড়া চালিয়ে যাবার অনুরোধ জানিয়েছিল তার স্বামীর কাছে।কিন্তু বছর ঘুরতেই তার কোলে এলো সৌম্য।এরপর আর কি? সংসার সমুদ্রে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিলো তন্দ্রা নিজেকে। তন্দ্রার স্বামী মনে করতো মেয়েরা সংসার করার জন্যই পৃথিবীতে আসে। তাই তন্দ্রার লেখাপড়া বা ওর লেখা কবিতা নিয়ে কোনোদিনই তার মাথা ব্যাথা ছিলো না। নিজের গোপন ডায়েরি গোপনেই পড়ে থাকতো তার। সবার কথাই মাথা পেতে নিয়েছিল তন্দ্রা নিজের সব আকাঙ্ক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে। কখনো লেখার জন্য সংসারকে অবহেলা করেনি সে।স্বামীর চাহিদা পূরণ করে, সংসারের চাহিদা পূরণ করে যেটুকু সময় সে পেত সে লিখতো। লেখা সে ছাড়তে পারেনি। শুধু তার লক্ষ্য ছিল ছেলেটাকে নিজের মনের মতো করে মানুষ করার, পেরেছে সে। ছেলে সৌম্য এখন বাংলার প্রফেসর। সৌম্যর বরাবরের খুব প্রিয় ছিল ওর মায়ের লেখা।
কত জায়গায় যে মায়ের লেখা কবিতা আবৃত্তি করে ও পুরস্কার পেয়েছে। তন্দ্রা সৌম্যকে তার জীবনের সবটুকু দুঃখের ইতিহাস বলেছে। যাতে সে মাকে বুঝতে শেখে। বেশ কিছুদিন একটা ঘটনা তন্দ্রাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। সেটা হলো সে তার কবিতার ডায়েরিটা হঠাৎ করেই খুঁজে পাচ্ছেনা। যেটা কেউ কোনোদিনও খুলেও দেখেনি সেটা এতো বছর পর কার কোন প্রয়োজনে লাগলো সেটাই সে বুঝতে পারছেনা।
একদিন তন্দ্রার জন্মদিনে সৌম্য কলেজ থেকে ফেরার পথে একটা বার্থ ডে কেক নিয়ে বাড়ী ঢুকলো। তন্দ্রা দেখলো কেক ছাড়াও সৌম্যর হাতে আর একটা প্যাকেট। যাই হোক, কেক কাটা হলো, সৌম্য মায়ের হাতে সুন্দর প্যাকিং করা একটা প্যাকেট দিয়ে খুলতে বললো। তন্দ্রা সেটা খুলে তো অবাক। স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি সে এটা। দু’চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো। তার লেখা কবিতার বই বের করেছে সৌম্য…….”দিগন্তের কবিতারা”। সার্থক আজ তার ছেলে মানুষ করা। সার্থক তার লেখা কবিতারা। যে লেখাকে কেউ কোনোদিন খুলেও দেখেনি, পড়া তো দূরের কথা সেই কবিতারা আজ বইয়ের পাতায় উঠে এসেছে। এটা ভেবেই রোমাঞ্চে আনন্দে সে বইটা খুলে সারারাত তার গন্ধে বুঁদ হয়ে রইলো। আজ একটা নতুন সকাল এলো তার জীবনে।