গল্প- দুই পৃথিবী

দুই পৃথিবী
– রাখী চক্রবর্তী

 

 

আগে থেকেই বলে দিলাম হ্যাঁ, ছেলে হলে চল্লিশ আর মেয়ে হলে ত্রিশ হাজার বুঝলি, হাজার।
এর এক টাকা কম নেব না, হ্যাঁ,এই বলে দিলাম।

তোর বাচ্চার বাপকে ডাক। সে কোথায় মুখ লোকালো। এই তোরা ঢোল বাজারে, মেয়ে হয়েছে।

“রাজদুলালি এসেছে ঘরে
শত্রুর মুখে ছাই পড়ে,
নাচব আমরা খুকি হাসবে
জীবনের পথ ওর সুগম হবে “।

কিরে খুকিকে নিয়ে আয়। অনেক তো নাচ গানা হল।

– তোমাদের পায়ে পড়ি। এত টাকা আমরা দিতে পারব না।
– এত্তো বড়ো বাড়িতে থাকিস আর ন্যাকা কান্না করে বলছিস টাকা দিতে পারবি না। এমন অভিশাপ দেবো তোর মেয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না কোনদিন।
– দোহাই তোমাদের এমনটি করো না। মেয়ে আমার প্রাণ। আমি মেয়েকে ছাড়া বাঁচব না।অভিশাপ দেওয়ার আগে আমাকে শেষ করে দাও তোমরা।
আমি আর আমার স্বামী এই বাড়ি দেখাশোনা করি। মাস মাইনে নিয়ে। সাহেব বিদেশে থাকে।ছুটিতে এখানে আসে। দোতলা, তিনতলা ভাড়া দেওয়া আছে। আমাদের সামর্থ্য নেই গো তোমাদের এতো টাকা দেওয়ার। দোহাই তোমাদের, অভিশাপ দিও না।

কুসুমকে আমি যেতে দেব না। আমার প্রাণ থাকতে আমি কুসুমকে তোমাদের হাতে দেব না।
কি গো তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কিছু তো বলো। কুসুম আমাদের কাছে থাকলে ওদের কি অসুবিধা হবে! আমরা এ বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাব। কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না।

– এ হয় না মা। এতো কষ্ট করে বাবা বাড়ি বানিয়েছে শুধু বোনের জন্য তা ছেড়ে যেতে হবে! কখনোই হয় না। বোনকে ওদের হাতে তুলে দাও।

– না, মা আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না।আমি তোমাকে জড়িয়ে বসে থাকব। দেখি কে তোমার থেকে আমাকে আলাদা করতে পারে।
মা ..মা .. আমি যাব না। আমি মরে যাব মা…

এই হতচ্ছাড়ি চম্পা কি বিড়বিড় করছিস। মার কথা মনে পড়ছে? না রে শালি..

– না রে খুকির মার কান্না দেখে মার কথা ভাবছি।আমার মা’ও তো এই ভাবে..

– আমাদের জীবন এই রকমই রে। চোখের জল মুছে নে হতচ্ছাড়ি।

ঠিক আছে খুকির মা। খুকিকে নিয়ে আসো।চম্পার কোলে দাও। চম্পা তোমার মেয়েকে আশীর্বাদ করবে।
– তোমরা খুব ভালো। আজ দুপুরে এখানে খাবে তোমরা।
চম্পা বলল, না খুকির মা আজ অনেক বাড়ি যেতে হবে। অন্য একদিন আসব। খুকি মানুষের মতো মানুষ হোক।

হিজড়ের দল এ বাড়ি ও বাড়ি যেতে লাগলো।

এই বাড়িতে ছেলে হয়েছে। পঞ্চাশের নিচে যাবি না। বিশাল বাংলো।

এই দোর খোল। দোর এঁটে রেখেছিস কেন? তালি মার তোরা। ঢোল বাজা। কানে কালা নাকি এরা।বেল বাজালাম তাও দোর খুলছে না।

অনেকক্ষণ পরে এক মহিলা দোর খুলে বললেন এখানে বসো, ওরা আসছে। চম্পা ঐ ভদ্রমহিলাকে দেখে চমকে গেল। চোখের কোনে কালি, হাতে কালশিটের দাগ। হলুদ বর্ণ গায়ের রঙে শ্যাওলা পড়ে গেছে যে। চম্পার নিজের মাকে দেখে চিনতে পারবে না, তা তো হওয়ার না। রোজ মাকে স্বপ্নতে দেখবেই চম্পা‌। যখন কুসুম ছিল তখনও আবার কুসুম থেকে চম্পা হল তখনও। মার মাথায় সিঁদুর আছে। তাহলে বাবা কোথায়? এটা কার বাড়ি?আমাদের বাড়ি তো হলদিয়ায় ছিল। বারাসাতে মা এল কি করে? বাবাও কি এখানে থাকে?

একটু জল দেবে মা?
বলতেই ভদ্রমহিলা পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো, আনছি বাবা।
মার সেই বাবা বলার অভ্যাস এখনও আছে!

এর মধ্যে দু’হাতে দু’টো ব্যাগ নিয়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফওয়ালা পাগলা ধরনের একটা বয়স্ক লোক বারান্দায় বসে হাঁপাচ্ছে আর বলছে, একটু জল দাও সুবলের মা।

বাবার এই দশা কি করে হল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতে বাবা কত ভালবাসতো।
এই বাড়িতে কার বাচ্চা হল। তবে কি এটা দাদার বাড়ি?

না ..না ..দাদা মা ও বাবাকে যত্ন করে রাখবে।আমার দাদা খুব ভালো।
দাদা সবসময় বলতো “পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমং তপঃ”
মা ছাড়া তো দাদা অন্ধ ছিল। বাবা যদি কখনও মাকে মুখ ঝামটা করতো দাদা সেদিন না খেয়ে থাকত। দাদা এমন কাজ করতে পারে না। তবে দাদা কি নেই এ পৃথিবীতে। চম্পা ভেবেই চলেছে নানান রকম কথা।
এর মধ্যে ছেলেকে কোলে নিয়ে ছেলের মা বাবা এসে দাড়াল হিজড়েদের সামনে ।

সেই ছোটবেলায় দাদাকে দেখে ছিলাম তখন আমি দশ, দাদা পনেরো। মুখের আদলটা একই রকম আছে। তবে হিসাব মিলছে না কেন আমার!

এই চম্পা মুখপুড়ি দর হাঁকা, ষাট বল। মালদার আছে এরা।

চম্পা চিৎকার করে বললো, সত্তর হাজার দাও, তা না হলে এমন অভিশাপ দেবো যে মৃত্যুকালে ছেলের সঙ্গ পাবে না। মুখে জল দেবে না ছেলে।

– না না অভিশাপ দিও না। যা চাও তাই দেবো।

চম্পা নিজের ভাইপোকে কোলে নিয়ে নাচছে আর বলছে, ঠাকুরমা কোথায় তোমার? ঠাকুরদা কোথায় তোমার ?
বাচ্চার মা বলে উঠল। ওকে আশীর্বাদ করো। ওর ঠাকুরমা ,ঠাকুরদা নেই ।
– ও তাই বলো, আমি ভাবলাম এরাই বোধহয় বাচ্চার ঠাকুরদা, ঠাকুরমা।

দাদা ভেতরে চলে গেল। মা মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাঁদছে। বাবা বারান্দায় বসে তখনও হাঁপাচ্ছে।

সত্তর হাজার টাকা নিয়ে আমরা হিজড়ের দল বের হতে যাব ঠিক তখনই বাংলোর ভেতর থেকে দাদার চিৎকার শুনতে পেলাম। একশো টাকার হিসাব দাও। তা না হলে দু’জনকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেব।

আমি বেল বাজালাম। দাদা দরজা খুলল। মা, বাবা চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম, তোমার বাড়ির চাকর বুঝি এরা?
বৌদি বলল, হ্যাঁ।
আমি বললাম, ওদের বারান্দাটা পরিষ্কার করতে বলো। আমরা নোংরা করে দিয়েছি।
– হ্যাঁ.. হ্যাঁ ওরা সব ধুয়ে পরিষ্কার করে দেবে আমার টম(কুকুর) সোনা বিকেলে বারান্দায় ঘোরাফেরা করে।

মা বাবা দু’জনেই ঝাঁটা, বালতি জল নিয়ে বাইরে আসতেই চম্পা ওদের জড়িয়ে ধরে বললো আমি কুসুম। আমাকে তোমরা চিনতে পারলে না! আজ থেকে তোমরা আমার কাছে থাকবে। চলো আমার সাথে।
-তুই আমাদের কুসুম! কেমন আছিস বাবা? কতদিন পর তোকে দেখলাম।

– শেফালি এই সত্তর হাজার টাকা তোরা ভাগ করে নে। এই টাকার ভাগ আমি নিতে পারব না।
কি করে এসব হল মা? তোমার নিজের বাড়ি থাকতে তোমরা এখানে কেন এলে?
-পাঁচ বছর আগের ঘটনা, তোর দাদা একদিন বললো, বারাসতে একটা বাংলো কিনব যদি তোমরা অনুমতি দাও। আমি আর তোর বাবা বললাম, বেশ তো ভালোই হবে। মাঝে মধ্যে তোর ওখানে গিয়ে ক’দিন থেকে আসবো। কুসুম চলে যাবার পর আমাদেরও ভালো লাগে না এই বাড়িতে থাকতে।
তখন তোর দাদা বললো, এই বাড়িটা রেখে লাভ নেই মা। বরঞ্চ এই বাড়িটা বিক্রি করে পাকাপাকি ভাবে বারাসতে থেকে যাব। সুবল তখনও বিয়ে করেনি। ব্যবসা করছিল।
আমরা রাজি হয়ে গেলাম সুবলের প্রস্তাবে। চার বছর হল সুবল বিয়ে করেছে। অত্যাচার শুরু তখন থেকে। নাতিকে আমাদের কোলে একবারও দেয়নি রে। কুসুম আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না রে। তোর বাবার মুখে দু’বেলা খাবার দিতেও পারিনি আমি।কি হাল হয়েছে ওর, দেখ।

আমি আছি তো মা। হিজড়ে বলে ভেবো না আমরা খারাপ। এক ভালো পৃথিবীতে এতদিন ছিলে তোমরা। আজ না হয় আমার সাথে এক অন্য অজানা পৃথিবীর মুখ দেখবে তোমরা।
সকাল বেলায় সূর্য ওঠার সাথে সাথে দেখবে ঢোল বাজিয়ে গান করতে করতে এক এক করে সব হিজড়ে রওনা হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করবে বলে। খিদের জ্বালা মিটাবে বলে ট্রেনে, নবজাতকদের ঘরে হাততালি দিয়ে দু’টো কটু কথা বলে বা আশীর্বাদ দিয়ে রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে যে যার ঘরে চলে যাবে। তোমাদের আর আমাদের পৃথিবী আলাদা মা। তোমাদের পৃথিবীতে বাবা মার অনাদর হয়। আমাদের পৃথিবীতে মা বাবার
জন্য রোজ রাতে আমরা চোখের জল ফেলি। সেই চোখের জল দেখার কেউ নেই যে মা।
শেফালি, করবী, জুঁই কাল আমরা উৎসব করবো।সবাইকে দেখিয়ে দেব। মা বাবাকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়। কিভাবে ভাল রাখতে হয়। অনাদরে অবহেলায় পড়ে থাকা যত বাবা, মা আছো সবাই আমাদের পৃথিবীতে একবার এসে দেখো ভালবাসার বন্যা বয় গো এখানে ভালবাসার বন্যা বয়।

Loading

Leave A Comment