গল্প – মোতি

মোতি
– অমরেশ কুমার

 

 

বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে মোতি। সঙ্গে রয়েছে তার দুই ছেলে কিরণ আর মনি। দু’দিন খাওয়া হয়নি, অনাহারে পেট পুরো ঢুকে গেছে, আর হাঁটতে পারছে না ছোট ছেলে মনি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে খাবার খুঁজছে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না মোতি, তার ছেলেদের জন্য।
সামনে একটা রুটির দোকান, মোতি ভাবল একটা রুটি না নিলে আর উপায় নেই। কিন্তু এইভাবে সে মানুষ হয়নি, দোকান থেকে চুরি করা, তার মন সায় দিচ্ছে না, চুরি করতে বিবেকে লাগে। কিন্তু এদিকে বাচ্চা যে মারা যাবে, সে বাধ্য হয়ে ছোঁ মেরে তুলে নিল একটি রুটি। দোকানের মালিক একটা জুতো ছুঁড়ে মারলো। মোতির মুখে গিয়ে লাগলো, তাও সে খাবার ছাড়েনি বাচ্চার কথা ভেবে।
মোতি খাবার নিয়ে গিয়ে দেখে কিরণ ডাকছে, তার দুই চোখ বেয়ে জল টপ টপ করে পড়ছে। মা খাবারটা মনির সামনে রাখলো। মনি আর দাঁড়াতে পারছে না, শুয়ে রয়েছে। বুকটা ধুক ধুক করছে। মা, রুটি নিয়ে মনির মুখে দেয়। খাওয়ার ক্ষমতা মনির মধ্যে আর নেই, মুখ দিয়ে লালা ঝরছে; সে দাদা আর মাকে যেন বিড়বিড় করে কি সব বলছে। মায়ের দুই চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। চোখের সামনে খাবারের অভাবে তার মনি মারা যাচ্ছে, অথচ খাবার মায়ের কাছে রয়েছে তাও কিছু করতে পারছে না মা ।

ধীরে ধীরে মনির চোখ ঘোলা হয়ে আসে, মনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
মোতি হাঁটু গেড়ে বসে জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকে ।
কিরণ মনির বুকে মুখ রেখে চুপ করে ভাইয়ের পাশে শুয়ে থাকে ।

মতি খুব ভালো করে জানে, এটা তার এলাকা নয়; তাই এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। চারদিক থেকে ঘিরে ধরবে। তার আগেই এখান থেকে চলে যেতে হবে।কিরনকে ইশারা করে এগিয়ে যেতে বলে।

কিরণ মুখে করে রুটি নিতে যাবে, মোতি তার দিকে তাকায় । কিরণ রুটি রেখে দেয় যথাস্থানে। মা ছেলে সোজা হাঁটা আরম্ভ করে ।

মোতি কি এই ভেবে রুটি রেখে গেল, যদি ঈশ্বর কখনো তার মনির ঘুম ভাঙ্গায়, তার মনি যেন ঘুম থেকে উঠে দেখে তার মা তার জন্য খাবার রেখে গেছে। মনি খিদেতে যেন কষ্ট না পায় ।

রাস্তায় চলার পথে কত কুকুর তার দিকে চেয়ে রয়েছে। কেউ চিৎকার করে ছুটে আসছে, এই না প্রাণে মেরে দেয়। মোতি ভয়ে ভয়ে কিরণকে পাশে নিয়ে চলতে থাকে। কত কুকুরের কত কটুক্তি। কিন্তু, মা কারো কথায় কান দেয়নি, আপন মনে হেঁটে চলেছে।

শেষ পর্যন্ত, ঝুপড়ি বস্তি এলাকায় একটা আস্তানা বেছে নিলো মতি। ছেলেকে নিয়ে সেখানেই থাকা শুরু করলো। রাস্তায় যা পায়, যা জোটে, তাই খায়। এই দুঃখের দিনে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হল না। পাড়ার এক দাদা মোহিত, মোতির পিছনে পড়েছে। মোহিত মোতিকে জীবন সাথী করতে চায়। মোহিত, মোতিকে প্রস্তাব দেয়। অসুবিধার কথা বলে না করে দেয় মতি।

মোহিতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে মোহিত কাউকে সহ্য করে না। কিরণকে মেরে ফেলে পথের কাঁটা সরাতে চায় মোহিত।
ভয়ে শিউরে থাকে মতি। কিরণ তার চোখের মণি। মনি মারা যাওয়ার পর থেকে কিরণ তার একমাত্র হীরে। কিরণকে নিয়ে পালিয়ে যায় মতি।

মোহিত, মতির পিছু ছাড়েনি চুপিচুপি ওদের পিছন পিছন যেতে থাকে। নতুন পরিবেশ আবার, নিজেকে মানিয়ে নেওয়া কষ্টকর, কিন্তু কিরণের জন্য তার এই কষ্ট করতেই হব। সে যে মা, সে না পারলে কে পারবে কষ্ট করতে?

নতুন এলাকায় অনেকে মিলে তাদের ঘিরে ধরে। মোহিত ক্ষতবিক্ষত হয়ে লড়াই করে মা ছেলেকে রক্ষা করে। এইরকম একবার, দু’বার নয়; বহুবার তাদেরকে রক্ষা করেছে মোহিত। তারা যেখানেই যায় মোহিত তাদের সাথে সাথে যায়। একদিন কিরণ খেলা করছে ঠিক তখন মোহিত কিরণের দিকে ছুটে যায়, মতি দেখতে পেয়ে মোহিতের দিকে ধেয়ে যায় কিরণকে বাঁচাতে। শুরু হয় মোহিত-মোতির লড়াই। মতি কিছুতেই মোহিতকে আটকাতে পারছে না। মোহিত, মতির চোখে জল দেখে কিরণকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় ।

কিরণ পায়ে গুরুতর চোট পায়। মা আবার জায়গা পরিবর্তন করবে বলে ঠিক করে । কিন্তু কিরণের হাঁটার অবস্থা নেই, এখান থেকে না পালাতে পারলে কাল আবার মোহিত আসবে । কাল কিভাবে কিরণকে বাঁচাবে মোতি ভেবে পাচ্ছেনা ।

মোতি বসে বসে ভাবছে, মোহিতের প্রস্তাবে রাজি না হলে কিরণকে বাঁচাতে পারবে কি না । এখনো পর্যন্ত যত বিপদ এসেছে সব থেকে মোহিত তাদের বাঁচিয়েছে। তার একার পক্ষে এই সমাজে চলা অতি কষ্টকর, সে একটা মেয়ে, তার কতটুকু আর ক্ষমতা সমাজের সাথে লড়াই করার, জীবনে পুরুষের যে খুব প্রয়োজন, অন্তত বারেবারে কেউ আঙ্গুল তুলে পণ্যের মতো কিনে নেওয়ার চেষ্টা করবে না। দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন হয়তো জুটে যাবে কিন্তু মান সম্মান ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিতে হবে না।

পরদিন, মোহিত আসছে দেখে মোতি নিজে মোহিতের কাছে গেল। মোহিতের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় মোতি। মোতি, মোহিতের জীবন সাথী হয়ে যায়। মোহিতও কিরণকে মেনে নেয়। তারা একসাথে দিন কাটাতে থাকে। কেউ এখন আর মোতির দিকে ছুটে আসে না ষ, মতির পিছু করে না।

এইভাবে তাদের আট মাস কেটে যায়, আট মাস পরে মোতির চারটে বাচ্চা হয়। তারা সবাই মিলে, পুরোপরিবার খুশিতে দিন কাটাতে থাকে।

কিন্তু, কে এই মোতি? মোতি আর কেউ না, একটা কুকুর। বাড়ির মালকিন দ্বারা বিতাড়িত, বর্তমানে রাস্তায় তার সুখের সংসার। মোতির উপলদ্ধি হয়েছে অট্টালিকায় আবদ্ধ রাজভোগের সুখের তুলনায় রাস্তার ফুটপাথের আবর্জনা মিশ্রিত নোংরা খাবার অমৃতসম। সম প্রজাতির মধ্যে পরিবারসহ থাকার সুখই হলো আসল স্বর্গ।

Loading

Leave A Comment