গল্প- আংটি

আংটি
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

সেই কোন ভোরবেলায় দীপ্ত তিতলিকে নিয়ে বেরিয়েছে অফিস পিকনিকে। তারপর শ্রী আবার একঘুম দিয়ে উঠে অলসভাবে এক কাপ চা নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসলো…আজ আর সেরকম কোন কাজের তাড়া নেই ওর।

এই দু’কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটটা ওরা কিনেছে এক বছর হলো। এমনিতে খুব শান্ত, নির্জন পাড়া…তবে সকালবেলায় ঠিক উল্টোদিকে বাচ্চাদের স্কুলটাতে কচিকাঁচাদের একটু কলকাকলি শোনা যায়। তবে আজ রবিবার, ছুটি। স্কুলের ছোট্ট মাঠটার চারদিকে শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার গাছ। একমনে বারান্দায় বসে খোলা আকাশ, গাছপালা, পাখি দেখে শ্রী। মিঠে রোদেভেজা বাতাস গায়ে মাখতে বড় ভালো লাগছে ওর।

যৌথ সংসার ছেড়ে আলাদা হয়ে এই ফ্ল্যাটে এসে এটুকু বুঝেছে শ্রী, যে স্বাধীনতা মানে আসলে কি! এখানে যা খুশী..যখন খুশী কাজ নিজের ইচ্ছেমত গুছিয়ে করলেই হয়—কোন নিয়ম নেই। আর শ্বশুর বাড়িতে? একটু পান থেকে চুন খসার আগেই তটস্থ থাকতে হবে…সবসময় সবজায়গায় যেন সিসিটিভি লাগানো আছে!

শ্রী মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে…দাদু-ঠাকুমা-বাবা-মা-ভাইবোন নিয়ে সুন্দর শান্তির পরিবার ছিলো ওদের।হয়তো বিরাট শখ- আহ্লাদ ছিলোনা কিন্তু খাওয়া-পরার অভাব ছিলোনা কোনোদিন। মা খুব শান্ত, চুপচাপ, সাদাসিধে…কোন চাহিদা ছিলোনা কখনো…সামান্য কিছু নিয়েই সবসময় স্মিতহাস্যে মা যেন অসামান্য।কখনো কোন ছোটখাটো অন্যায় বা দোষ করলে মা সবার সামনে নয়…পরে আড়ালে ডেকে ভুল শুধরে দিতেন…সবার সামনে অসম্মানিত হতে হতোনা…নিজের ভুল বুঝে নিজেরই লজ্জাবোধ হতো তখন।

আর শ্বশুরবাড়িতে ছোটখাটো ত্রুটি বিচ্যুতিতে শাশুড়িমা সবাইকে শুনিয়ে চিৎকার করতেন…যেটা ঘটেনি সেটাও বলতেন…খুব খারাপ লাগতো শ্রী’র।ওর সম্মানবোধ দেখে শাশুড়িমা অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন—তোমার সম্মান একদিন ধূলোয় লুটোবে।খুব দুঃখ পেয়েছিলো শ্রী। সে তার শাশুড়িমার কাছ থেকে টাকাকড়ি, গহনা-শাড়ী কিছুই তো চায়নি…শুধু একটু ভালোকথা, ভালোবাসা, আশীর্বাদও কি তিনি দিতে পারতেননা? সে তো শ্বশুড়বাড়িতে একটু শান্তির পরিবেশই চেয়েছিলো…আর কিছুই না।

দীপ্ত চাকরী করে যা পেতো তার বেশীরভাগটাই সংসারে মায়ের হাতে তুলে দিতো…তাও মাকে খুশী করতে পারতোনা। বড় ভাসুর আর বড়জা দু’জনেই চাকরী করতো কিন্তু সংসারে একই টাকা দিতো। তাদের ছেলেকে শাশুড়িমাই দেখাশুনো করতেন। তার বদলে বড়জা মাঝেমধ্যে কিছু টাকা গুঁজে দিতো ওনার হাতে…তাতেই তিনি মহাখুশী। সবসময় ওদের দিক টেনেই কথা বলতেন।

তারমধ্যে শ্রী’র মেয়ে হ’লে শাশুড়িমা অখুশী হলেন…ওকে একটুও আদর দিতেন না। তখন মেয়ের বয়স একবছর… সলিড ফুড খেতেই চাইতো না…খুব রোগা ছিলো…শুধু দুধ খেতে ভালোবাসতো…তাই সকালে আর রাতে বোতলে করে দুধ দিতো। ওর জন্য আলাদা করে হাফ লিটারের এক প্যাকেট গরুর দুধ আনতো দীপ্ত…তাই নিয়েও কত কথা! একদিন শ্রী শুনতে পেলো প্রতিবেশীর সাথে শাশুড়িমায়ের আলোচনা চলছে—এক প্যাকেট দুধ একটা বাচ্চা কি করে খায়?নিশ্চয়ই ওর মা লুকিয়ে খেয়ে নিচ্ছে দুধ। অবাক হয়েছিলো শ্রী! একটা ছোটবাচ্চার একটা ছোট প্যাকেট দুধ খাওয়া নিয়েও এত কথা চলতে পারে! মুখ বন্ধ করে নীরবে সরে এসেছিলো সে। শান্ত শ্রী কখনো বেশী কথা বলতোনা…ঝগড়া তো নয়ই।শুধু মনে মনে কষ্ট পেতো আর চোখের জল ফেলতো।

ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে একতলার ঘরে তিতলির খুব ঠান্ডা লাগতো। ডাক্তার বলেছিলেন ড্রাই জায়গায় ওকে রাখতে। কিন্তু সবাই বলতো—একে তো মেয়ে, তার আবার যত আদিখ্যেতা।

দীপ্ত সবই বুঝতো। তাই লোন নিয়ে এই ফ্ল্যাটটা কেনে মেয়ের জন্যই। মাকেও আসতে বলেছিলো ওদের সাথে। কিন্তু মা বড়ছেলে-বৌ-নাতিকে ছেড়ে আসতে মোটেও রাজী নয়। উলটে শ্রীকে কথা শোনালেন—এটাই তো তোমার ইচ্ছে…তুমি একলা থাকো…একলা খাও…একলা পরো…একলা ভালো থাকো। শ্রী মনে মনে ভাবে—কিইবা এমন খাই…কিইবা তেমন পরি…কোনরকম কোন চাহিদাই তো তার নেই….তাও!

ডিং ডং…ডোরবেলটা বাজতেই চমক ভাঙলো শ্রীর। এতোক্ষণ কি সব আজেবাজে চিন্তা করছিলো সে! ওই পুতুল এলো বোধহয়…আজ সময় নিয়ে ওকে দিয়ে ঘরদোরটা ভালোভাবে ঝাঁট দিয়ে মুছিয়ে নিতে হবে…প্রতিদিন যা ফাঁকি দেয়!

পুতুল ঘরে ঢুকেই বলে —বৌদি, তোমার কথামতো ওই বাড়ির দাদার কাছে কুড়িহাজার টাকা চাইলাম।
-কি বললো?
-আর কথা বলে? বাজে লোক…মুখ ঘুরিয়ে পালালো। বৌদির সামনে মুখ খারাপ করেনা পুতুল।
আগেরদিন ও-ই শ্রীকে বলেছিলো—ওই বাড়ির দাদা খুব মেয়ে ঘেঁষা, কাজ করতে অসুবিধা হয়, গায়ের উপর এসে পড়ে। সেদিন আবার বৌদির অবর্তমানে খারাপ ইঙ্গিত করেছিলো।
অথচ কাজটা খুবই দরকার পুতুলের…মাইনেও বেশ ভালো….আর ও বাড়ির বৌদিও ভালোমানুষ…প্রাণে দয়ামায়া আছে। তাই শ্রীকে এসে বলেছিলো—কি করবে? শ্রীই শিখিয়ে দিয়েছিলো টাকা চাইতে…ব্যাস সরল সমাধান।

শ্রী বলে, ঠিক আছে…আজ একটু ভালো করে খাটের তলা, সোফার তলা ঝাঁট দিয়ে মুছে নে…আমি ততক্ষণে আরেকবার চা বানাই।

বিকেলে বন্ধু পর্ণা এসেছিলো…কাছেই না’কি ওর মাসীর বাড়ি। ফোনে ঠিকানা আর ডিরেকশন নিয়ে হাজির হলো ও মস্ত এক নতুন গাড়ি চড়ে….গাড়িটা এই মাসেই কিনেছে ওরা। নতুন কিছু কিনলে বা দেশেবিদেশে ঘুরতে গেলে তা শোনাবার ইচ্ছে হয় ওর আর তখনই খোঁজ পরে শ্রীর। ছবি তুলে পাঠাবে নয়তো ফোনে শোনাবে আর আজতো একেবারে চাক্ষুষ দেখাতে নিয়ে এসেছে। শ্রীর আবার এসবে নজর কম। কারুর কিছু দেখলে চোখও টাটায় না…হিংসা-ফিংসাও হয়না…সাথে সাথে পাবার বা কেনার ইচ্ছেও হয়না…শুধু দেখানো স্বভাব দেখলে খুব হাসি পায়।

যাইহোক একটুবাদেই পর্ণা যাই যাই করতে শুরু করলো…কফি, চিপস আর মিষ্টি দিলাম।

পর্ণা নাক কুঁচকে বললো—তোদের ফ্ল্যাটটা খুবই ছোট দেখছি…আরো একটু বড় নিলি না কেনো?

মিচকি হেসে শ্রী বললো—এটাই ঠিক আছে রে…জায়গা যত বড় হবে ততই পরিষ্কার করার ঝামেলা।

পর্ণা চলে গেলো।দীপ্ত আর তিতলি ফিরলো রাতে। অল্প একটু দুধ-কর্ণফ্লেক্স খাইয়ে দিতেই মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো…বড্ড ক্লান্ত আজ।

– জানো আজ পর্ণা এসেছিলো কি বিশাল গাড়ি চড়ে।
-কি গাড়ি?
-খুব সুন্দর। আমি অত নাম জানিনা। আদার ব্যাপারীর আবার জাহাজের খোঁজ।
– সত্যিই তো…তোমার বন্ধুর বর কত্ত বড়োলোক। তোমার ভাগ্যটাই খারাপ।
– হিংসা করোনা…তোমারও হবে…বলে ভেংচি কাটলো শ্রী।

দীপ্ত শুতে গেলো। শ্রী প্রতিদিনের মত ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে নাইট ক্রিম মাখছিলো। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো—আমার আংটি?
দীপ্ত লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে বললো—কি হলো?
– আমার আংটিটা আঙুল থেকে খুলে পড়ে গেছে।
– সে তো যাবেই। আরেকটু কম কম খাও।

-কি ঘটনার কি রিঅ্যাকশান! রাগে গা জ্বলে উঠলো শ্রীর। বিয়েতে তোমার দেওয়া প্রথম আংটি…আমার সবচেয়ে প্রিয় একটা জিনিষ।

– ঠিক আছে খেয়েদেয়ে আঙুল মোটা করো আরও একটা কিনে দেবো।
– আরো জ্বলে উঠলো শ্রী—হ্যাঁ টাকার গাছ লাগিয়েছো তো!
– হয়তো কালকে তিতলিকে নিয়ে যাওয়া আসার সময় পড়ে গেছে।আজকে খেয়াল করলে।
– না, না, কালকেও ছিলো হাতে আর আজতো কোথাও যাই নি সারাদিন…ঘরেই ছিলাম।
– তা’লে তো ঘরেই আছে। চলো, চলো খুঁজি।

দু’জনে মিলে ঘরবারান্দা, বাথরুম, খাটবিছানা সোফা, টেবিলচেয়ার, সোফার তলা মায় ডাস্টবিনের ময়লা উপুড় করে খুঁজলো। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলো না।

– কমোডে ফেলে আবার ফ্ল্যাশ টেনে দাওনি তো?
– উফফফ…এইসময়ও ইয়ার্কি?
– না,সত্যি বলছি।
– আজকেই আমি পুতুলকে দিয়ে ভালো করে ঝাঁট দিইয়েছি।
– পুতুল খুব বিশ্বাসী। ও কেনো নেবে? পেলে ঠিক দিয়ে দিতো।
– হ্যাঁ, টুকটাক সেফটিপিন, পাথরের দুল, কয়েন পেলে দেয় ঠিকই কিন্তু হীরের আংটি?
– মিছিমিছি অবিশ্বাস করোনা শ্রী। তুমি ওকে কিছু বোলোনা। ওরা গরীব বলেই আমাদের যত অবিশ্বাস।আর বড়লোক হলে মন আর অবিশ্বাস করতে চায়না।আজ তোমার বন্ধুও তো এসেছিলো।
– একদম বাজে কথা বলবেনা। ওরা কত্ত বড়োলোক জানো? বিশাল বাড়ি-গাড়ি। গলায়-হাতে-পায়ে সোনা-হীরের গয়নার ছড়াছড়ি।
– না,না আমি কাউকেই দোষ দিচ্ছিনা। হয়ত ওটা আছে কোথাও লুকিয়ে, আবার পরে পাওয়া যাবে।
আমি তোমাকে বোঝাবার জন্য বললাম –জানোতো “ক্লেপ্টোম্যানিয়া” বলে একটা অসুখ আছে তাতে মানুষ চুরি করে। আমাদের কলেজে একটা বন্ধু ছিলো…খুব বড়োলোকের ছেলে…যা ওর ভালো লাগতো চুরি করে নিয়ে নিতো। তবে দামী জিনিষ নয়… অনেক তুচ্ছ জিনিষ নিতো। ওর কোন বইএর অভাব ছিলোনা তাও বন্ধুদের বই নিয়ে নিতো। আমরা জানতাম ওই নিয়েছে। তাই ওর বাড়ি গিয়ে কাকীমার কাছে চাইতেই কাকীমা ওর আলমারী খুলে সবার সবকিছু জিনিষ ফেরত দিয়ে দিতেন। খুব লজ্জা পেতেন উনি। ওর কিন্তু এসব মনেও থাকতোনা…খেয়ালও করতো না।

– না,আমার বন্ধুর ছোটবেলায় এরকম কোন অসুখ ছিলোনা। তবে অসুখ নয়…অনেকে স্বভাবে চুরি করে আর তারা তুচ্ছ নয়, দামী জিনিষই চুরি করে। তুমি আমায় এসব বোলোনা তো…আমার নিজের মাথাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
—তাই তো, তুমিই তো এখন রোগী…মাথা পুরো খারাপ…আমার একটা পাগলী। এখন ঘুমোও তো।

শ্রী জানে, যাকে নিজে চোখে নিতে দেখিনি তাকে সন্দেহ করাও অন্যায়। আর তাছাড়া জিনিষটা কোথায় পড়েছে তারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তাও পরেরদিন পুতুলকে ভালো করেই বলল —জানিস পুতুল,আমার বিয়ের আংটি…তোর দাদার দেওয়া প্রথম উপহারটা হারিয়ে ফেলেছি। ঘর ঝাঁট দেওয়ার সময় পেলে দিস তো।

ও কেমন থতমত খেয়ে তাকালো…মুখটা কেমন কালো হয়ে গেছে। হয়তো ভাবছে, শ্রী ওকে সন্দেহ করছে।তাড়াতাড়ি বললো, আমি যা কিছু কুড়িয়ে পাই তোমাকেই তো দিই বৌদি। ঠিক আছে খুঁজে দেখবো বলে সন্তর্পণে ঝাঁট দিতে লাগলো। শ্রী’র সন্ধানী চোখ ওকে নজরে রাখলো।

এমনি করেই অনেক অনেক দিন পেরিয়ে গেলো। পরের বছর বিবাহবার্ষিকীতে দীপ্ত ঠিক ওইরকমই একটা হীরের আংটি দিলো। কিন্তু মনের দুঃখ কি তাতে কমে? উলটে দীপ্ত বললো, এটাও হারিও।
শ্রী বলল, আমি হারাইনি…ওটা নিজে থেকেই হারিয়ে গেছে।

সে যাইহোক এমনি করেই দিন কাটছিলো। একদিন সিটি মলে গিয়েছিল শ্রী, ঢোকার মুখেই দেখে পর্ণা, ডাকতে যাবো… এমন সময় দেখে, গাড়ীর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছে।শ্রী’কে দেখেনি বোধহয়। হঠাৎ শ্রী -এর মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো… সে দেখল গাড়ীর দরজায় পর্ণার আংটি পরা হাত আর  সেটা সম্পূর্ণ শ্রী’র হারানো আংটিটার মত একই ডিজাইন!

Loading

Leave A Comment