গল্প- ম্যানেজ (রুপক )

ম্যানেজ (রুপক )
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

 

গুরু , আর কতদিন বিদেশে পড়ে থাকবে ? এবার ঘরওয়াপসি করো বাপধন। ইন্ডিয়ান পলিটিক্স একটু রপ্ত করো। ঘরবাড়ি পরিজন বন্ধুবান্ধব ছেড়ে আর কতদিন মুখ গুঁজে হংকং ব্যবসা চালাবে ? সুবুদ্ধি দিচ্ছি , একদম ফ্রী। এখানে চলে এসো , মারকাটারি ব্যাবসা , নো রিস্ক ,

বিবেক, বেশ কয়েক বছর যাবৎ হংকং বাসী। ওর মামা যৌবনের গোড়াতেই মায়াপুর বেড়াতে গিয়ে , এক হংকং সুন্দরীর প্রেমে হাবুডুবু খায়। যাইহোক, মামার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তারপর মামা তার হংকং সুন্দরী বউ এর সাথে ওখানে চলে যায়, ব্যবসা পত্তর শুরু করে। সে অন্য এক কাহিনী।পরে কোনও এক সময় বলা যাবে। সেই মামার দৌলতেই বিবেকের হংকং যাত্রা, ব্যবসা, সব কিছুই। এখন বলতে নেই , হংকং লক্ষ্মীর কৃপায় , বিবেক টু পাইস কামিয়েছে।

চাঁদু , বিবেকের ছোটবেলার বন্ধু। বিবেক লেখা পড়ায় একেবারেই ভালো ছিল না। চাঁদুও একই দলের দলি। মামার কৃপায় বিবেক তরে গেল। কিন্তু চাঁদু , এক্কেবারে জিরো। মাঝেমাঝে চাঁদু কপাল চাপড়ায়, হায় রে, মামা হো তো এইসা। জিও মামা।

বিবেকের কিন্তু এই বিদেশে পড়ে থাকা পছন্দ নয়। আড্ডাবাজ ছেলে। বারোয়ারী পুজো, ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প, কফিহাউস, সবকিছু ফেলে শুধু পয়সা রোজগারের জন্যে এই বাইরে থাকা একেবারেই ভালো লাগেনা। চাঁদুকে কয়েকবার বলেছে সে কথা। চাঁদুরও তাতে সায় আছে। থাকবারই কথা। গাছ আর পাতার সম্পর্ক। বেশি দিন আলাদা থাকা অসম্ভব। কিন্তু উপায় নেই। এবার একটা যেন আলো দেখা যাচ্ছে।

কি ব্যাপার ভাই , একটু গুছিয়ে বল। আমি তো পা বাড়িয়েই আছি। বিশ্বাস কর ভাই , দেশ ছেড়ে বিদেশে পড়ে থাকতে একটুও ভালো লাগে না। নেহাৎ নিরুপায় বলেই না,, ব্যবসা গেলে খাবো টা কি ?

বিবেক, দিন কয়েক এর জন্য কোলকাতায় এসেছে। আসে, বছরে দু একবার। সবাই তো এখানেই থাকে। মা বাবা, চাঁদু , কফিহাউস। ঘরে থাকার মজাই আলাদা।
চাঁদু , ব্ল্যাক কফিতে হালকা চুমুক দিয়ে বললো,,,

বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাবসা হেব্বি চলছে বস। গঙ্গার ধার ঘেঁষে একটা জম্পেশ বাড়ি হলেই কেল্লাফতে। খদ্দের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে গুরু। শুধু দরজা খোলার অপেক্ষা। দলে দলে অবহেলিত সিনিয়র সিটিজেন।
আগেকার দিনে ছিল , বাপে খেঁদানো মায়ে খেঁদানো ছেলেপুলে। এখন যুগের তালে কেস পুরো উল্টো গুরু।
এখন ছেলেপুলেদের তাড়া খেয়ে বাপ মা, বৃদ্ধাশ্রম খুঁজছে।

সেকিরে, তাহলে আমাদের বাঙালি কালচার , যৌথ পরিবার ?

সেসব চৌপাঠ। বুড়ো-বুড়ির যা আছে , সব হাতিয়ে নিয়ে ফুট লাস করে দেওয়াই এখন দস্তুর বস। যাক, মারো গুলি । অত সেন্টু নেবার দরকার নেই। আশ্রম হাঁকাও ব্যবসা চালাও। সিওর শট। হানড্রেড পারসেন্ট।

বিবেক একটু চুপ করে থেকে বললো ,,,
ব্যাপারটা কিরকম আনফেয়ার লাগছে , অন্য কিছু ভাবতে,,,,,,,,,
চাঁদু ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,,,,
আবারও সেই সেন্টু কেস। আরে বাবা আমরা তো চুরি করছি না। কাউকে ঠকাচ্ছি না। বরঞ্চ উপকার করছি। হ্যাঁ , বলতে পারিস টাকার বিনিময়ে। টাকা ছাড়া কিছু হয়না গুরু। বলতে পারিস , ওই আধমরা মানুষ গুলো কে ফ্রেশ অক্সিজেন সাপ্লাই দিচ্ছি। বেঁচে থাকার রসদ। কি আছে ওই হতভাগ্য মানুষ গুলোর জীবনে , চোখের জল ছাড়া ?

বিবেক থেমে গেল। চাঁদুর কথায় যুক্তি আছে। ব্যবসা ইজ ব্যবসা। ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। এই স্বার্থপরের দুনিয়ায় কেউ কারুর নয়। নইলে বাবা মা কে সন্তান ফেলে দেয়?

ঠিক আছে , তুই তাহলে একটা বাড়ি দ্যাখ, গঙ্গার ধারে। হ্যাঁ রে, গঙ্গার ধারে কেন রে?

নিরিবিলি বস, স্রেফ নির্ঝঞ্ঝাট টাইমপাস এর সেফ প্লেশ। বহুত ঝড়ঝাপটা পেড়িয়ে এখানে ওরা আসে তো, একটু শান্তি ফান্তি চাই ওস্তাদ। নইলে ওরা বাঁঁচবে কি নিয়ে। সারা জীবন খেটেখুটে ছেলেপুলে বড় করে , লেখাপড়া শিখিয়ে, নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে, বিয়ে সাদি দিয়ে লাস্টে কপালে ঝাড়।
দ্যাখো গুরু , আমি বেশি লেখাপড়া শিখিনি জানিনা । কিন্তু, মা কালির দিব্বি , মা কে প্রাণ থাকতে ছাড়বো না।
কি বলবো গুরু, মোটা মোটা টাকা রোজগার করে। মাক্কিচুস নম্বর ওয়ান। শালা, শ্বশুর বাড়িতে ফাঁট দেখাবে কলার তুলে। বুড়ো বাপ মা ফালতু। ওদের দিতে গেলেই গায়ে ফোস্কা। মার হারামিদের।

চাঁদুর মন পরিস্কার। প্যাঁচ বোঝেনা। মা আর চাঁদু। ব্যাস , এইটুকুই চাঁদুর সংসার। তবে , পুতলী আসবো আসবো করছে। মেয়েটা পাশের পাড়ায় থাকে। একটু মুখোরা। তবে চাঁদুর সঙ্গে মানিয়ে যাবে। ভয় মা কে নিয়ে। মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। তবে চাঁদুর বুদ্ধিশুদ্ধি আছে, ম্যানেজ করে নেবে।

আরে ধুস। ঠিকই আছে। এরা আছে বলেই না, এই ব্যবসা টা আছে , তবে? ওরা লক্ষ্মী রে চাঁদু , ওরা লক্ষ্মী। প্রার্থনা কর , এইরকম শুভবুদ্ধির লোক যেন বেশি বেশি জন্মায়। আরে ভুলে যাচ্ছিস কেন , ওদেরও তো ছেলেপুলে হবে না কি ?

ঠিক হ্যায় গুরু , কোনও টেনশন নিও না। সব গোছ করে সাজিয়ে দেব। অকেশনে সেলিব্রিটি আনবো, প্রেস মিডিয়া কে খবর দেবো। সন্ধ্যেবেলা টিভিতে ব্রেকিং নিউজ। বড়ো বুড়ির ফোকলা হাসির ছবি , সঙ্গে নায়ক নায়িকার চাঁদপানা মুখের ফুটফুটে হাসি। একটু মনভুলানো ডায়লগ ,,,,,,
আমি আমার হারানো দাদু দিদা কে খুঁজে পেলাম। ছলছল চোখ। হা হা হা হা,,,,
দিনে রাতে সাতাশ বার একই ছবি , ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। সুপার হিট , মার কৈলাশ।
থাকা খাওয়া ডাক্তার কীর্তন , দুর্গা পুজো , তোফা লাইফ। আর কি চাই ? লেগে পড়ো গুরু ।

হ্যাঁ রে, তোলাবাজির ঝামেলা নেই তো? তাহলে কিন্তু আমি নেই , আগেই বলে দিলুম। আই হেট পলিটিক্স। ওখানে এসব ঝামেলা নেই। আরাম সে ব্যবসা করো,,,,, খাওদাও মস্তি করো।

একটু বিশ্বাস করতে শেখো দাদা। এটা ব্যবসা কাম সোসাল ওয়ার্ক। খাওদাও মস্তি করো।

কি যা-তা বলছিস , মাথা খারাপ নাকি? ব্যাবসা আর সোস্যাল ওয়ার্ক একসাথে হয় নাকি , পাগল।

হয় হয়, আমাদের দেশে সব হয়। গরুর দুধে সোনা বেড়োয়।
বিশ্বাস করো গুরু , একসাথে টাকা ইজ্জৎ দুই পাবে। হেব্বি সম্মান। নেতাদের পাশে নিয়ে ফটফট সেলফি। টিভি খবরের কাগজ , মানে ফাটাফাটি কেস। মনেরেখ, তুমি অবহেলিত লাঞ্চিত মানুষের সেবায় নিয়োজিত প্রাণ। তুমি মহান।

ঠিক আছে ঠিক আছে , বলছিস যখন , তাহলে ব্যবস্থা কর। টাকা যা লাগে দেবো।

সব হয়ে যাবে গুরু। শুধু একটা রিকোয়েস্ট আছে ওস্তাদ। বলো রাখবে ?

কি , বলনা !

আমি খুব শিগগির পুতলী কে বিয়ে করবো।

খুব ভালো , করনা,,

একটা মুশকিল হচ্ছে গুরু। পুতলী কিছুতেই আমার মা টা কে সহ্য করতে পারছেনা। এখনো বিয়েই হয়নি , তাতেই এই ! তাহলে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে গেলে কি অবস্থা হবে , একবার ভাবো।
তাই বলছিলুম , আমার বুড়ী মা কে তোমার জিম্মায় রেখে দেবো। মানে বৃদ্ধাশ্রমে ।

আরে এই শয়তান, এই বললি, প্রাণ থাকতে মা য়ের কাছ থেকে কেউ তোকে আলাদা করতে পারবে না !

পারবে না ই তো। আমি তো তোমার আশ্রমের দেখাশোনার কাজ করবো। কেয়ার টেকার, ম্যানেজার যা বলো সব। মা আশ্রমেই রইল। সারাদিন আশ্রমের কাজ করে রাতে পুতলীর কাছে চলে যাবো।একটা চাকরিও হলো, বিয়েও হলো, মায়ের হিল্লে হলো, পুতলীও খুশ। সবদিক ম্যানেজ। এবার বলো, প্ল্যান টা কেমন।

ওরে ব্যাটা , তাই তোমার এত আগ্রহ । শোন, আজ থেকে আর আমাকে গুরু , ওস্তাদ কিচ্ছু বলবিনা।
তোর কাছে আমি শিশু রে চাঁদু শিশু । ওফ,,,,,,

Loading

One thought on “গল্প- ম্যানেজ (রুপক )

  1. আলাপীমনএরসকলশুভানুধ্যায়ীবন্ধুদেরজানাইআমারআন্তরিকশুভকামনা।

Leave A Comment