মাতৃভাষা
– বিশ্বদীপ মুখার্জী
আগেই বলে দিই, গল্পটা লেখার উদ্দেশ্য কোনও ভাষাকে অপমান করা নয়, বরং নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা। ভাষা নিজেই এত মহান হয় যার অপমান হতেই পারে না।
— — — — — — — — —
জয়ন্ত সেই চেহারাটাকে খুব ভালো করে চিনতো। বেলঘরিয়া থেকে বিধাননগর রোড স্টেশন যাওয়ার সময় প্রায় রোজই তার সাথে দেখা হতো। না, কোনও দিনই তার সাথে কথা হয়নি। রোজ যাতায়াত করতে গিয়ে মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল আর কি। ছেলেটার বয়স আন্দাজ তিরিশের কাছাকাছি। মাথায় চুল কম, গায়ের রঙ বেশ ময়লা। বিধাননগর রোড স্টেশনে নেমে তাকে আর দেখতে পেতো না জয়ন্ত। হয়তো হারিয়ে যেত ভিড়ের মধ্যে।
জয়ন্তর বাড়ি নবদ্বীপে। রাস পূর্ণিমার উপলক্ষ্যে সে ছুটি নিয়েছে নিজের অফিস থেকে। ব্যান্ডেল স্টেশনে সে বসে আছে নবদ্বীপের ট্রেন ধরার জন্য। হঠাৎ একজন এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলো – ‘ভাই সাহেব, মিথিলা এক্সপ্রেস কিতনে নম্বর প্ল্যাটফর্ম পর আয়েগী?’
একটা বেঞ্চিতে বসে আছে জয়ন্ত। ঘাড় হেঁট করে একাগ্রচিত্তে দেখে যাচ্ছে নিজের মোবাইল। প্রশ্নটা কানে আসতে ঘাড় উঠিয়ে দেখলো সে। এ তো সেই ছেলে যাকে প্রায় বেলঘরিয়া স্টেশনে দেখে সে। সেই ছেলেটা হয়তো জয়ন্তকে চিনতে পারেনি। এর আগে কোনও দিন জয়ন্তকে লক্ষ্যই করেনি হয়তো।
ছেলেটা আবার সেই প্রশ্নটা করলো। জয়ন্ত একটু আগেই শুনেছে যে মিথিলা এক্সপ্রেস দু’ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে। কিন্তু সে চুপ করে থাকলো।
‘আপকো পতা হ্যায় য়া নেহি?’ ছেলেটা বেশ বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞাসা করলো এবার।
জয়ন্ত দেখলো তার হাতে একটা ট্রলি ব্যাগ। মিথিলা এক্সপ্রেসে চড়ে কোথাও যাবে হয়তো।
‘নিজের পিছন দিকের প্ল্যাটফর্মে যান, গাড়ি ওখানেই আসবে।’ জয়ন্ত বলল তাকে।
‘মতলব? ম্যায় কুছ সমঝা নেহি।’ সে হয়তো বাংলা জানে না।
ইতিমধ্যেই ট্রেন ঢুকে গেছে প্ল্যাটফর্মে। জয়ন্তর পাশে একজন দাঁড়িয়েছিলেন। তিনিই উত্তর দিলেন – ‘মিথিলা এক্সপ্রেস দো নম্বর পর আ গয়ি হ্যায় ভাই সাহেব।’
ছেলেটা পিছন দিকে তাকালো। জয়ন্তকে এক অশ্রাব্য গাল দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়লো দু নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। জয়ন্ত পুনরায় নিজের মোবাইলে মনোনিবেশ করলো।
খানিক পর সেই ছেলেটিকে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করা ভদ্রলোকটি জয়ন্তর পাশে এসে বললেন – ‘আপনাদের মতো লোকেদের জন্যই পশ্চিমবঙ্গের অন্য রাজ্যে এতো বদনাম।’
জয়ন্ত লোকটার দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বলল – ‘আমার নাম জয়ন্ত হালদার। আপনার?’
‘আমার নাম? আমার নাম জেনে কী করবেন?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।
‘আপনার উত্তরটা আপনাকে দেবো।’
‘আমার নাম বিপ্লব চক্রবর্তী।’ ভদ্রলোক নিজের নাম বললেন।
জয়ন্ত ভালো করে তাকে দেখলো। মাঝ বয়সী লোক। ভদ্র বাড়ির বলেই মনে হলো জয়ন্তর।
জয়ন্ত বলল – ‘আপনি তো বাঙালি। শিক্ষিত বলেই মনে হচ্ছে। আপনার কি মনে হয় সেই ছেলেটিকে হিন্দীতে উত্তর দেওয়াটা ঠিক হতো? ছেলেটাকে আমি বহুবার দেখেছি। তার বাড়ি যেখানেই হোক না কেন, থাকে এখানেই। হয়তো কোলকাতায় কোথাও কাজ করে সে। সে আমাকে বাংলাতে প্রশ্নটা করতে পারলো না? এখানে থেকে কাজ করবে, অথচ এখানকার ভাষা শিখবে না। সেটা কি সম্ভব? দেখুন, আমি কোনও ভাষার অপমান করতে চাই না। ভাষা নিজেই এত মহান হয়, যার অপমান সম্ভব না। ব্যাপার হলো নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা। আমরা বাঙালি হয়ে যদি নিজের ভাষাকে বাঁচাবার চেষ্টা না করি, তাহলে কি অন্য কেউ করবে?’
খানিক বিরতি নিয়ে জয়ন্ত আবার বলল – ‘আপনি অন্য কোনও রাজ্যে গিয়ে বাংলাতে প্রশ্ন করুন তো.. জবাব পাবেন? এমন কি দক্ষিণ ভারতে নাকি কেউ হিন্দীতেও আপনাকে উত্তর দেবে না। কোনও এক মহাপুরুষ বলে গেছেন মশাই, “কোনও জাতিকে শেষ করতে গেলে সব থেকে আগে তার ভাষাকে শেষ করতে হয়”। আপনি পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গা ঘুরে আসুন। দেখবেন আস্তে আস্তে বাংলা ভাষা সেখান থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষাকে জীবিত রাখার কর্তব্য শুধুমাত্র আমার নয়, আপনারাও, সমস্ত বাঙালির। নাতো সে দিন দূর নয় মশাই, যে দিন পশ্চিমবঙ্গে থেকে আমাদের অন্য ভাষায় কথা বলতে হবে। এখানে থাকতে গেলে অল্প হলেও বাংলা শিখতে হবে.. এই কথাটা কি খুব ভুল? যদি নিজের মাতৃভাষাকে বাঁচাতে চান, তাহলে এগিয়ে আসুন, সাহসী পদক্ষেপ নিন। না হলে হারিয়ে যাবে আমাদের মাতৃভাষা, যার স্থান আমাদের জীবনে আমাদের মায়ের তুল্য। চলি, আমার ট্রেন আসছে।’
কথা শেষ করে জয়ন্ত নিজের ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল নিজের গন্তব্যের দিকে। বিপ্লব চক্রবর্তী অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সমাপ্ত।