খোলা চিঠি
-পারমিতা ভট্টাচার্য
শ্রীচরণেষু
মা,
অনেক দিন হলো তোমাদের কোনও খবর পাইনি। আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় তোমাদের সব খবরই কুশল। বাবার বুকের ব্যথাটা কেমন আছে মা? পরান বাবু দাদার চাকরিটা করে দিয়েছে? মিলি এখন কত বড় হয়েছে মা? কত দিন হয়ে গেল তোমাদের দেখিনি। জানো মা, শহরে যখন তুমুল বৃষ্টি নামে আমি জানালার ধারে বসে তখন ছোট বেলার বৃষ্টি ভেজার দিনগুলোর কথা মনে করি। শ্রাবণের ধারা তখন গড়িয়ে পড়ে আমারও গাল বেয়ে। মনে আছে মা, বৃষ্টিতে ভেজার পর তুমি তোমার আঁচল দিয়ে আমার গা, মাথা মুছিয়ে দিতে। জ্বর হলে সারা রাত মাথার কাছে জলপট্টি আর পাখা নিয়ে বসে থাকতে জেগে। তোমার গায়ের গন্ধ কত দিন পাইনি মা। খুব লোভ হয় জানো সেই গন্ধটার। তাই কালীপুর যাওয়ার সাহস না হলেও স্টেশনে গিয়ে বসে থাকি। তখন দূর থেকে দেখি দাদা স্টেশনে বাপি, ছটুদের সাথে তাস খেলছে, মদ খাচ্ছে, খিস্তি দিচ্ছে মুখে। আমি একদিন কিছু টাকা তোমাকে দিতে গিয়েছিলাম মা। কিন্তু দাদা কিছুতেই আমায় বাড়ি যেতে দিলো না। বলল, ‘নষ্টা মেয়ে! তুই গেলে আমাদের বাড়ির মান সম্মান সব মাটিতে মিশে যাবে।’ কিন্তু টাকাটা ছিনিয়ে নিলো আমার হাত থেকে। আমি নষ্টা মেয়ে আর আমার রোজগারের টাকাটা খুব প্রয়োজনীয়…. তাই না? আমি প্রতি মাসে আমার গতর বেচে তোমাদের যে টাকা পাঠাই, তা দিয়ে তোমাদের মুখে অন্ন জোটে। এক বারও ভেবে দেখো ওই টাকাতে কতটা চোখের জল, হৃদয় নিংড়ানো কষ্ট মিশে আছে?
মাত্র ওই কটা টাকার জন্য তোমার সনাতন বাবুর মত পিশাচের হাতে আমায় তুলে দিয়েছিলে। আর পিশাচটা লোক দেখানো আমায় বিয়ে করে এনে তোলে এই বেশ্যাখানায়। আমাকে বেচে দেয় মোটা টাকার বিনিময়। আমাকে বেচা টাকাতে তোমরা কোঠা দালান বাড়ি তুলেছিলে। সাজিয়ে ছিলে নিজেদের সংসার। আমি জানি মা, আমার মত সমত্ত মেয়ের বাড়িতে থাকার জ্বালা। প্রতিবেশীদের, আত্মীয় স্বজনের নজর এড়াতে তাই আমায় বাড়ি থেকে একেবারেই নিকেশ করে দিলে। জানো মা, আমার আজ আর কোনও দুঃখ নেই। কোনও অভিযোগও নেই তোমাদের বিরুদ্ধে। এখন আমি আর কাঁদি না। শরীরে – ব্যথা – যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি এটা বুঝি যে আমি তোমাদের গলায় কাঁটার মত আটকে ছিলাম। আর আমার মত উঠতি বয়সের মেয়েকে খাওয়ানো পরানো অনেক ঝামেলার ব্যাপার। মা, আমার মত অতি সাধারণ একটা মেয়েকে বেচে দালান কোঠা তোলায় কোনও অপরাধ নেই। কিন্তু ওই মেয়েটা সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তার ছায়া মাড়ালেও অপবিত্র হতে হয়। পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখাতেও লজ্জাবোধ হয় তোমাদের।
তোমায় তো মা বলে ডাকার আরও কেউ আছে, মা। কিন্তু আমি কাকে মা বলে ডাকি বলো দেখি? মা তো একটাই হয়, তাই না? তোমরা কি পারতে না একটা গরীবের ছেলে দেখে আমার বিয়ে দিতে, সংসার করে দিতে? আমি ভালো আছি মা এখানে। রোজ খাটে শুই। ভালো ভালো খাবার খাই, সুন্দর সাজগোজ করি। আমার কোনও কিছুর অভাব নেই মা। অভাব শুধু তোমাদের, অভাব একটা সংসারের, অভাব একটা নিজের মনের মানুষের। একটা অনুরোধ রাখবে মা আমার? আর কখনও কোনও অনুরোধ তোমার কাছে করবো না। তোমরা মিলির একটা বিয়ে দিও। গরীব ঘরের ছেলে হলেও দেখে ওর একটা সংসার করে দিও। ওর একটা সংসার হোক, মনের মানুষ হোক, মা বলে ডাকার কেউ থাকুক ওকে। আর যদি একান্তই বিয়ে দিতে না পারো তাহলে ওকে তোমরা ওর ভালোবাসার মানুষের কাছে চলে যেতে দিও। ও তার সাথে সংসার করুক। আমাকে তোমরা কৌশিকদা’র সাথে যেতে দাওনি। কারণ ও নিচ জাতের ছিলো। আমিও সে দিন তোমাদের কথা অমান্য করতে পারিনি। তার ফল আমাকে জীবন দিয়ে চোকাতে হচ্ছে মা। এতটা ভালো আমার নাও করতে পারতে তোমরা। তোমাদের মতই না হয় আমিও খুদ কুঁড়োর অভাবের সংসার করতাম। তবুও তো বাঁচতাম। এখন যে প্রতিনিয়ত মরি আমি। মিলির বিয়ের জন্য টাকা জমিয়ে আমিও রাখছি। তোমায় পাঠাবো। আজকাল তোমাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। এ জীবনে কি সেটা আর সম্ভব হবে? আজ এই পর্যন্তই থাক। তোমরা সবাই খুব ভালো থেকো। তুমি, বাবা ও দাদা আমার প্রণাম নিও। মিলিকে আমার ভালোবাসা দিও। আর মনে মনে ভেবো তোমার বড় মেয়ে মরে গেছে তোমাদের জীবন থেকে।
ইতি,
তোমার একান্ত অভাগী