রুবি রায়
– পারমিতা চ্যাটার্জী
অতনুর আজ একজনের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা। এখন সে দিল্লি নিবাসী, কলকাতায় এসেছে কয়েকদিনের জন্য, তারমধ্যে প্রধান আকর্ষণ বইমেলা, এবারের তার দুঊটো বই বার হচ্ছে, একটা গল্পের আর একটা কবিতার।
ঠিকানাটা হাতে নিয়ে দেখে অবাক হয়ে গেলো যেখানে তার যাবার কথা, সেটাতো তার ছোটবেলার পাড়া।
গাড়ি থেকে একটু আগেই নামলো, হেঁটে হেঁটে চলে এলো চেনা সেই গাছতলার কাছে।
এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো, অনেকদিন আগের একটা মিষ্টি অনুভূতি মনকে এক সুন্দর আবেশে ভরিয়ে দিল।
ঠিক এইখানেই স্কুলবাস থেকে সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়া দু’টো লম্বা বিনুনি দু’দিকে ঝুলিয়ে একটা ফুটফুটে মেয়ে স্কুলবাস থেকে নামতো।
সবে কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র অতনুর ওই মেয়েটিকে গাছতলার থেকে একটু দেখার আকর্ষণে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো।
এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একদিন সুগায়ক অতনু গান গেয়ে ফেললো, “মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে একদিন কতো করে ডেকেছি, আজ হায় রুবি রায় ডেকে বল আমাকে, তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি… “
মেয়েটির ছদ্ম কপট ভ্রূকুটির মধ্যে ছিল প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত।
না না মেয়েটির সাথে আলাপ হওয়া তো দূরের কথা তার নামটাও জানা হয়নি, তাই সেই মেয়েটি তার হৃদয়ের গোপন কোণে আজও রুবি রায় হয়েই থেকে গেছে।
সে আজ প্রায় পঁচিশ বছর আগেকার কথা। এখন সে পৃথিবীর কোনখানে বা কোন দেশে আছে তার কিছুই সে জানেনা, আজ হয়তো দেখলেও তার সাধের রুবি রায়কে সে চিনতে পারবেনা। কিন্তু সেদিনের সেই রুবি রায়ের দুষ্টুমিষ্টি মুখচ্ছবি আজও ভুলতে পারেনি, পথ চলতি ওই বয়েসের কোন মহিলা দেখলেই সে ফিরে তাকায়, মনে হয় এই সেই রুবি রায় নয়তো!
একবার দোলের দিনের কথা মনে পড়ে গেলো অতনুর, নিজের অজান্তেই গাল দু’টো লাল হয়ে গেলো। সেবার পাড়ায় সবাই সবাইকে আবীর মাখাচ্ছে, রুবি রায়ের বাবা খুব কড়া ধাঁচের মানুষ ছিলেন বলে ও পাড়ায় বিশেষ মেলামেশা করার সুযোগ পেতোনা, একটাই ওর বন্ধু ছিল তার সাথে বাড়িতে বসে গল্প করতো তা নইলে ও বন্ধুর বাড়ি যেত তাও বাড়ির গাড়ি করে। তাই ওর নামটার সাথে কেউ পরিচিত ছিলোনা, সবার কাছে ওই রুবি রায় নামটাই অতনুর কল্যাণে চালু হয়ে গিয়েছিল।
সেবার দোলের দিন শিকে ছেঁড়ার মতন পাশের বাড়ির একটি মেয়ের ডাকে যে একসাথে ওর সঙ্গে মাধ্যমিক দেবে, তার সাথেই যা একটু ভাব হয়েছিল, আসলে রুবি রায় পাড়ায় নতুন এসেছিল, নিজেও লাজুক প্রকৃতির বিশেষ মিশুকে ছিলোনা। হঠাৎই সেদিন টুটুর ডাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আবীর হাতে নিয়ে, সবার অলক্ষ্যে সেদিন অতনু ওর দু’গালে বেশ করে আবীর মাখিয়ে দিয়েছিল, মেয়েতো লজ্জায় লাল, আর মুখ তুলতেই পারেনা, অতনু তখন নিজেই উপযাচক হয়ে নিজের মুখটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “আজকের দিনে আমাকে একটু আবীর দেবেনা?” সে কোনরকমে ওর কপালে একটু আবীর ছোঁয়ালো কি ছোঁযালো না, ওইটুকু করতেই ঘেমে উঠলো। এরমধ্যে টুটু একটা গোপন কথা ফাঁস করে দিল যে রুবি রায় নাকি খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়, ব্যাস আর যাবে কোথায়, বিকেলে পাড়ার গানের আসর বসে প্রতি দোলের সন্ধ্যায়, বিকেলে ওকে আসরে গাইতে হবে বলে সবাই চেপে ধরলো, টুটু বললো, “আমি মেসোমশাইকে রাজি করিয়ে ওকে ঠিক নিয়ে আসবো” আরও একটা কথা সেদিন জানা গেলো ও নাকি খুব ভালো লেখে, স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রতিবার লেখে এবং বাংলায় খুবই দক্ষতা আছে, অতনুর তো আরও মুগ্ধ হবার পালা। লেখা আর গান যে তারও নেশা, সেও তো কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক, আর কলেজে গাইয়ে হিসেবে তারও বেশ সুনাম আছে।
সেদিন অবশ্য ওর নামটা জানা গিয়েছিল কিন্তু ওই রুবি রায় নামটা সবার মনে এমন ঢুকে গিয়েছিল যে ওর আসল নামটা সবাই ভুলেই গিয়েছিল।
সেদিন বসন্ত সন্ধ্যায় অতনু একটা রবীন্দ্রসংগীতই গেয়েছিল, যদিও সে সবরকম গানেই অভ্যস্ত, তবে সেদিন তার রবীন্দ্রসংগীতটা খুব ভালো হয়েছিল, সে গেয়েছিল, “একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনে” এরপরই রুবি রায়ের পালা, সেও কম যায়না। সে গাইলো, “তোমার বীণায় গান ছিল, আর আমার ডালায় ফুল ছিল ” ওর শেষ লাইনটা অতনুর মনে এখনও দাগ কেটে আছে, শেষ লাইনটা ছিল, “ফাগুন বেলায়, মধুর খেলায়, কোনখানে হায় ভুল ছিল গো ভুল ছিল… “
সত্যি সেদিন ফাগুনবেলায় জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মতন একটু মধুর খেলা হয়েছিল, তারপর আর সুযোগ হয়নি।
সেও দিল্লিতে চলে গিয়েছিল জে এন ইউ-তে মাস্টার্স করতে, শেষ হবার সাথে সাথেই পি এইচ ডি আরম্ভ করেছিল। যাবার সময়ও দেখা করার সুযোগ হয়নি, টুটু মারফত জানতে পেরেছিল, রুবি রায়ের নাকি সে চলে যাওয়াতে মনটা খুব খারাপ, দু’জনেই দু’জনকে ভালোবেসে ফেলেছিল প্রায় কোন কথা না বলেই। টুটুর হাতেই আসার সময় একটা ছোট্ট চার লাইনের চিঠি দিয়ে এসেছিল।
তাতে লিখেছিল, ভালোবাসা যে এতো সুন্দর মাধুর্য থাকে তা তোমার সাথে দেখা না হলে বুঝতে পারতামনা। আমি আশা করবো আমি ফিরে আসা অবধি তুমি অপেক্ষা করবে।
সেও একটা উত্তর দিয়েছিল, চিঠিটা বিষাদে ভরা।
চিঠিটা ছিল এইরকম,
“আমার বাবা রিটায়ার করবেন, তাই হয়তো খুব বেশিদিন অপেক্ষা করবেন না। আমি বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারিনা, তাই জানিনা আপনার অনুরোধ আমি রক্ষা করতে পারবো কি না।
আমার এই অক্ষমতাকে আপনি ক্ষমা করে দেবেন। কিছুদিনের জন্য এই ভালোলাগার সম্পর্কটুকু আমার জীবনে চিরকাল সঞ্চিত হয়ে থাকবে। আমার জন্যে গাওয়া আপনার গলায়, মনে পরে রুবি রায় গানটি আমার পাওয়া এক শ্রেষ্ঠ উপহার হয়ে থাকলো। খুব ভালো থাকবেন, আর অনেক সাফল্যে আপনার জীবনকে ভরিয়ে তুলুক এই কামনাই করি।
ইতি আপনার
রুবি রায় “।
চিঠিটা পেয়ে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল অতনুর, একবার ভাবলো যাবেনা দিল্লিতে, কলকাতা ইউনিভার্সিটিতেই পড়বে, সেইমত চিঠিও দিল কিন্তু উত্তর এলো,
“জীবনে সুযোগ বারবার আসেনা, আমার জন্য এই সুযোগ ছেড়ে দিলে, আমি নিজেকে নিজেই ক্ষমা করতে পারবনা। আপনার উন্নতি আমার পাথেয় হয়ে থাকবে।”
এরপর আর যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা, ভেবেছিল মাস্টার্সটা ওখান থেকে করে এসে, পি এইচ ডি যাদবপুর থেকে করবে, যা স্টাইপেন পাবে তাই দিয়েই রুবি রায়কে নিয়ে সংসার আরম্ভ করবে।
এরপর তার মাস্টার্সের ফাইনাল ইয়ারে এসে সে জানতে পারে তার বিয়ে হয়ে গেছে।
ও নাকি অনেক চেষ্টা করেছিল, বাবাকে বলেও ছিল যে,”বাবা আমার রেজাল্ট তো বেশ ভালো হয়েছে, কলেজের প্রফেসররা বলছেন, এখনি বিয়ে কেন! এম এ পড়বেনা”? কিন্তু তার বাবা বলেছিলেন, মা, আমারও তো ইচ্ছে ছিল যে তোমাকে আরও পড়াই, পড়াতামও যদি আমার আর তোমার মায়ের শরীর ভালো থাকতো, আমরা দু’জনেই হার্টের পেশেন্ট, তাছাড়া রিটায়ারমেন্টরও সময় হয়ে এসেছে তাই আর রিস্ক নিতে পারছিনা, আমার কিছু হয়ে গেলে তো তোমার মা অসুস্থ শরীর নিয়ে সবদিক সামাল দিতে পারবেনা। তাছাড়া তোমার যেখানে বিয়ে দিচ্ছি তারা আমায় কথা দিয়েছে যে তোমাকে পড়াবে, আর ওরা না পরালেও আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমায় পড়িয়ে যাবো”। এরপর আর সে কিছু বলতে পারেনি।
বিয়ের দিন টুটুকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ কেঁদেছিল, আর বলেছিল, তাকে বলে দিস, তার রুবি রায় কতটা অক্ষম, কিন্তু কোনদিনই সে আমার মন থেকে মুছে যাবেনা, আমার প্রথম ভালোবাসার ফুলটা যা অসময়ে ঝরে গেলো, সেই ঝরা ফুলের পাপড়িগুলো আমি চিরকাল বুকে আঁকড়ে রেখে দেবো।
অতনু আর তারপর কলকাতায় ফিরে আসেনি, পি এইচ ডি কমপ্লিট করে জে এন ইউয়ের প্রফেসর হয়েছে। অনেকদিন পর কলকাতায় এসে শুনেছিল ওর বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। বাবা মাও মেয়ের সাথে এই প্রবঞ্চনা মেনে নিতে না পেরে এক বছরের মধ্যে দু’জনেই মারা যান হার্ট অ্যাটাকে। ওর স্বামী নাকি খুবই দুশ্চরিত্র ছিল, ও বেরিয়ে এসে পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে স্বাধীন ভাবে একটা স্কুলে কাজ নিয়ে আছে আর লেখালিখি করে গানও গায়। টুটুর সাথে দেখা হবার পর ম্লান হেসে বলেছিল বেশ আছি এখন সেও প্রায় ১৮/১৯ বছর আগে। তারপর তার আর কোন খবর জানেনি।
আজ এই পুরানো গাছতলাটায় এসে অতনুর চোখে জল এসে গেল, “কোথায় আছে সে, কেমন আছে! সে কি জানে আমিও ঘরভাঙা এক পথিক হয়ে আছি, হয়তো আমার মনে তুমি আছো বলেই আর কাউকে মন দিতে পারিনি, ঘর বেঁধেও ঘরটা তাই ভেঙে গেছে।”
পাড়ায় ঢুকতে টুটুর সাথে দেখা, টুটু তার চিরাচরিত স্বভাবের উল্লসিত হয়ে উঠলো, অতনুদা তুমি!
– হ্যাঁ রে এ পাড়ায় একটা কাজে এসেছিলাম,
– জানি কাজ ছাড়া তো তুমি এখানে আসবেনা,
– দূর পাগলি, তুই এখনও একইরকম আছিস,
তারপর তোর কি খবর বল? তুই তো ডাক্তার হয়েছিস এখন-
– হ্যাঁ গো, আমার আর কি খবর হবে, এই ছেলে নিয়ে এখানেই থাকি,
– মানে! তোরও কি —
– না অতনুদা আমার বর খুব ভালো ছিলেন, তাই বোধহয় কপালে সইলো না – একদিন হঠাৎ বুকে ব্যথা বলতে বলতে আমার কোলের ওপরই ঢোলে পড়লো, কিছু সুযোগ দিলো না আমাকে –
– কতদিন হল?
– প্রায় দশ বছর কেটে গেলো দেখতে দেখতে।
অতনু কিছু বলতে পারলোনা, কেউ সুখ পায়না, কেউ সুখী হয়েও হারিয়ে ফেলে ভালোবাসার মানুষটাকে।
আচ্ছা অতনুদা আজ খবরের কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে, তুমি দেখেছ না কি?
– কি বলতো?
– পরিচারিকাকে রেপ করার জন্য শহরের নামকরা ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
– হ্যাঁ পড়েছিলাম, আবার সেই খবরে এইকথাও লেখা ছিল যে, তার প্রাক্তন স্ত্রী শ্রীমতী অনুমিতা মুখার্জি কোর্টে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন যে, এই ঘটনায় তিনি কিছু আশ্চর্য হন নি কারণ তিনি বিয়ের পরই বুঝতে পেরেছিলেন যে তার স্বামী একজন চরিত্রহীন বর্বর, তাই বিয়ের মাত্র তিন বছরের মাথায় ডিভোর্স নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় তাকে।
-না রে পড়িনি, বোধহয় ভেতরের পাতায় ছিল, অত খবর আমি পড়িনা, ভালো লাগেনা, তা তুই এই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস কেন!
– কারণ আছে অতনুদা, অনুমিতা নামটা আমরা রুবি রায়ের আড়ালে রেখে দিয়েছিলাম তাই,
– তুই কি মনে করছিস…?
– হ্যাঁ অতনুদা অনেকটা মিলে যাচ্ছে যে..
– ভদ্রমহিলা এখন কোথায় থাকেন কি করেন, সেসব কিছু লেখা নেই?
– না অতনুদা, তা থাকলে তো আমি চলে যেতাম, কিন্তু এই বিশাল শহরে সে কোথায় আছে, কোথায় খুঁজে বেড়াবো তাকে?
অতনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, কিন্তু আমাকে যে তাকে খুঁজে পেতেই হবে, আমি ঘর বেঁধেও ধরে রাখতে পারিনি শুধু ওই একজন আমার মনে এখনও বাসা বেঁধে আছে বলে।
– কিন্তু কোথায় খুঁজবে তাকে?
– দেখি, এখনও কিছু মাথায় আসছেনা, শুধু জানি খুঁজে তাকে পেতেই হবে, প্রথম লগনে যে ফুল ফুটেও ঝরে পড়ে গেছিল, গোধূলি লগনে তাকে যদি আবার নতুন করে ফোটানো যায়।
যে ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতে এসেছিল তার সাথে কাজটা সেড়ে নিতে হবে, অতনু হাতের ঘড়িটা দেখলো।
টুটু বললো, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বোধহয়?
– না রে এখানে একজন প্রফেসর এসেছেন তন্ময় লাহিড়ী নামে। উনি আমার প্রফেসর, পি এইচ ডির সময় অনেক সাহায্যে পেয়েছি ওঁর কাছ থেকে তাই কলকাতায় এলাম যখন ভাবলাম একবার দেখা করে যাই।
– ও ওই যে সোমাদিদের বাড়িটা ভেঙে যে ফ্ল্যাট বাড়িটা তৈরি হয়েছে ওইখানে থাকেন –
– তুই চলনা আমার সাথে, কতদিন পর দেখা একটু কথা বলি, পুরানো কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তোদের সাথে, তোর জন্যেই রুবি রায়ের ভালোবাসা তো পেয়েছিলাম।
– কাকীমা, কাকু কেমন আছেন?
কেউ নেই রে, আমিও ওর মতন একা এখন, এ সময়ে দু’জনের দেখা হওয়া খুব দরকার, একদিন যে ভালোবাসা আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম আজ হয়তো তার পূর্ণতা দিতে পারতাম।
– পারতাম মানে! পারতেই হবে, দেখি না কি হয়। আজ আমার চেম্বার আছে গো, আজ হবেনা, কাল বা পরশু আমরা একদিন বসবো কোথাও। আজ তুমি যাও ডঃ লাহিড়ীর কাছে,
– হ্যাঁ, কাল পরশুর বেশি দেরি করিস না আমাকে সামনের সপ্তাহে দিল্লি ফিরে যেতে হবে।
– সামনের সপ্তাহে দিল্লি যাচ্ছ? ওখানে তো এখন একাই থাকো তাই না?
– হ্যাঁ রে, ঘর তো বেঁধেছিলাম, ভেঙে গেলো, এখন আমার খালি বাড়ি।
– ঠিক আছে গো দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমার আবার চেম্বার আছে। আমি কাল পরশুর মধ্যেই তোমাকে ফোন করবো, নাম্বারটা দাও।
– হ্যাঁ, এই নে, ফোন করিস কিন্তু..হ্যাঁ রে তুই বইমেলা যাস না?
– না গো সময় পাইনা, অনেক দায়িত্ব যে আমার, তার ওপর হসপিটাল, চেম্বার তো আছেই, আর একজন তো সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে চলে গেলো।
অতনু ওর মাথায় একটা হাত রাখলো, তারপর বললো, আসিস কিন্তু ।
অতনু তার প্রফেসরের সাথে দেখা করে, কিছুক্ষণ কথা বললো, চা খেলো তারপর ওঁকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলো।
বইমেলার উদ্দেশ্য ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে নির্দেশ দিল।
এই নিয়ে তার সাত নম্বর বই বার হচ্ছে, প্রত্যেকটি বইতে কখনও রুবি রায়কে নিয়ে কবিতা, কখনও বা গল্প লিখেছে।
আজ যে তারজন্য এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্য প্রস্তুত ছিলো না।
দূর থেকে দেখতে পেলো তার বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছে এক মহিলা, মহিলার মুখটা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু পেছন থেকে অতনুর চোখে পড়লো, পরণে হালকা গোলাপি রঙের তাঁতের শাড়ি পরা, লম্বা দীঘল চেহারা, উজ্জ্বল গৌরবর্ণা, ঘাড়ের কাছে একটা এলো খোঁপা। অতনুর বুকটা ধক করে উঠলো, কিরকম যেন চেনা লাগছে পেছন থেকে, এ সে নয়তো!
দুরুদুরু বক্ষে কাছে এলো কি এক অমোঘ আশা নিয়ে। কাছে আসতেই সে মুখ ফেরালো, অতনুর মনে হল ঈশ্বর আছেন, এই তো তার রুবি রায়, একটু গায়ে মেদ লাগলেও মুখের ভাব একইরকম আছে, অতনুর উজ্জ্বল চোখ দু’টো যেন কি এক হঠাৎ পাওয়ার আনন্দে ভেসে যাচ্ছে, তার চোখে জল এসে যাচ্ছে, সে কিন্তু কৌতুক করে সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “তোমাকে কোথায় যেনো দেখেছি…”
অতনু তার দু’ কাঁধটা শক্ত করে ধরে বললো আর তোমাকে হারিয়ে যেতে দেবোনা, আমার ভাঙা ঘর শুধু তোমার পথ চেয়েই আছে।
– আমাকে তুমি খুঁজেছিলে?
ওরা মেলার প্রাঙ্গণ থেকে একটু একধারে সরে এলো, তারপর অতনু বললো, যেদিন থেকে টুটুর কাছে জানতে পারলাম যে তুমি একা হয়ে গেছো, সেদিন থেকে শুধু তোমাকেই খুঁজে গেছি। মা বাবার জবরদস্তিতে বিয়ে একটা করেছিলাম কিন্তু ভালোবাসতে পারিনি, তাই সে আমাকে মুক্তি দিয়ে চলে গেছে। আর আমি পাগলের মতন তোমাকে খুঁজে গেছি।
বই বেরোবার সময় হয়ে গেছে, তার ডাক পড়লো, প্রধান অতিথিরা সব এসে গেছেন।
কোনরকমে মোড়ক উন্মোচন করে অতনু চলে এলো তার রুবি রায়ের কাছে, হাতে কয়েকটা নতুন প্রকাশিত বই নিয়ে, এসে তাকে বললো আমার নতুন বইয়ের নামটা দেখ..
– হ্যাঁ সেটা দেখেই তো দাঁড়িয়ে গেলাম, তাছাড়া শুনলাম তুমি এখনই আসছো, মনে একটু সংশয় থাকলেও পেছনে তোমার ছবি আর পরিচিতি দেখে আর কোন সংশয় রইলো না।
চল এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি-
– কোথায় যাবে?
– যেদিকে দু চোখ যায়, এখন কোন বাধা নেই
– এবার আমরা মুক্ত বিহঙ্গ, কিন্তু কতক্ষণ?
– মানে?
– মানে সময় তো কমে এসেছে,
– না না এতদিনের অপেক্ষা আমাদের সময় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে –
অতনু উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করলো, “ওরে বিহঙ্গ তবু বিহঙ্গ মোর এখনি অন্ধ বন্ধ কোর না পাখা”
অনুমিতা হেসে বললো চলো যাই ।
ওরা চলে এলো গঙ্গার ধারে। তখন গঙ্গার ধার এতো সাজানো গোছানো ছিলোনা।
এলোমেলো ছিল। রেললাইন পার হয়ে যেতে হত, তা হয়তো এখনও হয়, কিন্তু সাজানো গোছানোর চেয়ে এলোমেলো গঙ্গাধারটাতেই যেন প্রকৃতিকে বড়ো নিবিড় করে পাওয়া যেতো।
পারে দাঁড়িয়ে আছে একটা ফেরি, দূর আকাশে উজ্জ্বল চাঁদের আলো।
অনুমিতা বললো- আজ পূর্ণিমা দেখ, কেমন সুন্দর চাঁদ –
– হ্যাঁ দেখেছি, সেদিনও পূর্ণিমা ছিল –
– কবে?
– মনে নেই? দোল পূর্ণিমার দিন। যেদিন তোমাকে আবীর মাখানোর ছলে প্রথম স্পর্শ করেছিলোম আর আজ প্রায় পঁচিশ বছর পর আবার তোমাকে স্পর্শ করলাম।
– অনুভবটা একইরকম আছে শুধু সময়টা পেরিয়ে গেছে, বলে অনুমিতা হাসলো সুন্দর করে।
– এই সেই টোল ফেলা গালের মিষ্টি হাসি, অতনু নতুন করে আবেগে ভেসে গেলো।বললো আমার ইচ্ছে করছে এখনি গঙ্গা পার হয়ে দক্ষিণেশ্বরে চলে গিয়ে মায়ের মূর্তির সামনে সিঁদুর পড়িয়ে তোমাকে নিজের করে নি, তারপর ভেসে বেড়াই দু’জনে বাঁধা বন্ধনহীন এক ভালোবাসার সাগরে।
অনুমিতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা কবিতা মনে মনে তৈরি করে বলে উঠলো,
” দেখো তো চেনো কি আমায়!
আমি তোমার সেই রুবি রায়,
রাস্তায় যার জন্য থাকতে অপেক্ষায়।
কতো যুগ গেলো কেটে
এতোদিনে সেই অপেক্ষার সুতোটা গেলো ছিঁড়ে।
এলো সেই মিলনের ক্ষণ,
মিলিত হোক দু’টি অপেক্ষারত প্রাণ।
অতনু এগিয়ে এসে দু’ হাতে ওর মুখটা তুলে ধরে গভীর চুম্বন এঁকে দিল ওর ঠোঁটে, মুখে, গালে গলায়, কেঁপে উঠলো অনুমিতার দেহ নিজেকে সঁপে দিল অতনুর বুকে, ওকে জড়িয়ে ধরলো অতনু। তারপর বললো, চল এবার যাওয়া যাক,
– কোথায়?
– কোথায় মানে দক্ষিণেরশ্বর, ঘর বাঁধবো না এবার। হ্যাঁ, বহু প্রতীক্ষিত আমাদের ভালোবাসার ঘর।
চাঁদটা আকাশে জ্বলজ্বল করছে, ওরা দু’জন ফেরিতে উঠলো মন্দিরে যাবে বলে।
গঙ্গবক্ষের উত্তাল হাওয়ায় অনুমিতার আঁচল চুল সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অতনু ওর আঁচলটা টেনে নিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে গাইলো, “মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে একদিন কতো করে ডেকেছি, আজ হায় রুবি রায় ডেকে বলো আমাকে, এবার অনুমিতা গাইলো, তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি।