Site icon আলাপী মন

গল্প – আগমনী

আগমনী
-অঞ্জনা গোড়িয়া

 

আলমারিতে তুলে রাখা কাপ প্লেটটা ভালো করে আজ পরিস্কার করিস রমলা। আর ওই হারমনিয়ামটা। মনে আছে তো? “ও” ফিরছে বিদেশ থেকে।
রমলা- জানি গো মা। সব জানি। তোমাকে এ নিয়ে একদম ভাবতে হবে না। আজ মহালয়ায় বাড়ির লক্ষ্মী বাড়ি ফিরছে। সব মনে আছে। তাই তো দিদিমনির প্রিয় জিনিসগুলো তকতকে করে রেখেছি। আয়নার মতো মুখ দেখা যাচ্ছে। তুমি এবার নিজের দিকে খেয়াল করো দেখি। কি হাল করে রেখেছ? দিদিমণি এসে দেখলেই আমাকে খুব বকাবকি করবে। এসো শ্যাম্পু করিয়ে দিই আজ। ভালো করে ফিটফাট হয়ে থাকবে। কেমন?
কাকিমা- সে আর বলতে, এমন অবস্থা দেখলেই রেগে ক্ষেপে যাবে।
রমলা- আজ আর রান্না ঘরে যেতে হবে না। আমিই সব করে রাখব।
-কি যে বলিস রমলা! তুই পারিস এত সব!আর আমার হাতের রান্না না খেলে, ওর মনই ভরে না। এতদিন পর ফিরছে, আর আমি রাঁধব না? তা কি হয়? সব নিজে হাতে করব। তুই হাতে হাতে যোগান দিস একটু।
যেদিন ম্যাসেজটা এলো, সেদিন থেকে কাকিমার আনন্দ আর ধরে না। দীর্ঘ দশ বছর পর বিদেশ থেকে ফিরছে একমাত্র মেয়ে সুনীতা। প্রতিবছরই আসব আসব বলে আর সময় করে উঠতে পারে না। তবে খুব খেয়াল রাখে কাকিমার। রোজ ভিডিও কলে কথা বলে। কত গল্প করে। খুব ভালোবাসে মা’কে। ও আর সবাই এর মতো নয়। বিদেশ গিয়ে মা’কে ভুলে যাবে।
রমলা বলল, তাই তো কাকিমা। দিদিমনি কত খেয়াল রাখে তোমার। কত কষ্ট করে মানুষ করেছো তুমি। তা কি বৃথা যেতে পারে?
হুইল চেয়ারে বসে বসে, পুরানো সেই এলব্যামটায়, হাত বুলিয়ে আদর করছে ছোট্ট মেয়ে সুনীতাকে।
মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সব দিনগুলির কথা। সুনীতা তখন বছর পাঁচেক। ওর বাবা তখন বিদেশে থাকত। প্রচুর ইনকাম করতো। তবে দায়িত্বে কর্তব্যে কোনো ত্রুটি রাখত না। সংসার খরচ বাবদ টাকা মাসের চার তারিখ হলেই ঠিক পৌঁছে দিত। আসার কথা বললেই বলতো, প্রচুর কাজের চাপ। আর যাওয়া মানে অনেক খরচ। আর কটা বছর যাক। বিদেশের চাকরি একেবারে ছেড়ে দেশে ফিরে আসব।
একবছর যায় দু’বছর যায়। আর সময় হয় নি ফেরার।আস্তে আস্তে সব সম্পর্কগুলো ফিকে হয়ে গেল। আর ফোন করতো না। টাকাও কোনো মাসে দিত আবার কোনো মাসে আসত না।
সুনীতাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল কাকিমা। ভালো স্কুলে পড়াতে অনেক খরচ। এত টাকা পাবে কি করে?
কাকিমা, কাজের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ল। বেশ শিক্ষিত ছিলেন, তাই বড়ো কোম্পানিতে কাজ পেয়ে গেলেন।সুনীতা যখন ১৪ বছরের। বিদেশ থেকে খবর এলো, সুনীতার বাবা হার্ট অ্যাটাক এ মারা গেছে। যা কিছু সম্পত্তি, বিদেশে থাকা ওর দ্বিতীয় পত্নীর হাতেই চলে গিয়েছে। কাকিমা, সবকিছু চুপচাপ মেনে নিয়েছিল।সুনীতাকে নিয়ে হেসে খেলে দিন চলে যেত। হঠাৎ একদিন সুনীতা এসে বলে, সে একজনকে ভালোবাসে। তাকেই বিয়ে করবে। ছেলেটি বিদেশে থাকে। সোস্যাল নেটওয়ার্কে আলাপ।
কাকিমা চুপচাপ তাও মেনে নিল। কোনো দিনই সুনীতাকে কোনো ব্যাপারে জোর করে নি। বিয়ে হয়ে গেল সুনীতার। চলে গেল বিদেশ। মা দেশে একা। তবে সুনীতা কোনোদিনও তার কর্তব্য দায়িত্ব ভোলে নি। অনেক বার বলেছে মাকে, বিদেশে চলো মা। আমাদের সঙ্গে। একা একা এখানে থেকো না।
কাকিমা স্বামীর বাস্তু ভিটে ছেড়ে কোনো মতেই যেতে চাইলো না। সুনীতার একবছরের মধ্যে ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো। ছবি পাঠিয়েছে মায়ের কাছে। কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে। ঠিক যেন ছোট সুনীতা। দেখার খুব ইচ্ছে সামনাসামনি। কি করে আসবে এত ছোট মেয়ে নিয়ে? তাই কাজের মেয়ে, রমলার ওপরই মায়ের দেখাশোনার সব দায়িত্ব। সুনীতা প্রতিদিন খোঁজ রাখে মায়ের। টাকা পাঠিয়ে দেয় মানি অর্ডারে।
একদিন হঠাৎ ডিউটি থেকে ফিরেছে। রমলা তখন বাইরে ছিল। জল খেতে রান্না ঘরে যেতেই হার্ট এট্যাককে আক্রান্ত হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও পা দু’টো অবশ হয়ে যায়। সেই থেকেই হুইল চেয়ারে বসে। তবু মেয়ে আসতে পারে নি। এর জন্য খুব দুঃখ প্রকাশ করেছে। হুইল চেয়ারটা পাঠিয়ে দিয়েছে। আর রমলাকে সব দিকে খেয়াল রাখতে বলেছে। কাকিমার কাজটা বন্ধ হয়ে গেল। একাকীত্ব গ্রাস করল কাকিমাকে।
এদিকে প্রতিবছরই বরের অফিসে কাজের চাপ পড়ে যায় সুনীতার। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কেমন অভ্যাস হয়ে গেছে। একা থাকতে। এবছর সুনীতা কথা দিয়েছে, সে আসবেই। স্বামীর কাজ থাকলেও একাই মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসবে। তাই সেদিন থেকে সারা বাড়ি পরিস্কার করছে।
রমলাকে দিয়ে সুনীতার প্রিয় জিনিসগুলো পরিস্কার করে রাখছে। ওর ঘরটা চাবি দেওয়া ছিল এতদিন। আজ খুলে দিয়েছে। সুনীতার জন্য। ওর পছন্দের সকল খাবার তাই নিজে হাতে রান্না করছে। আজই মহালয়া। ও আসছে দেবী পক্ষে। কত দিন নিজের চোখে দেখে নি মেয়েকে। সেই যে বিয়ে করে চলে গেল, আর আসা হয় নি। ওর কাপ প্লেটটায় কাউকেই খেতে দেয় নি। ওর বড়ো প্রিয়। দরজায় বেলের আওয়াজে চমক ফিরলো কাকিমার।

রমলা একবার দেখে আয় তো, কে এলো?
রমলা, দরজা খুলে দিল। ভেবেছিল দেখতে পাবে, সুনীতার হাসি মুখটা। না,সুনীতা আসে নি। এসেছে পোস্ট মাস্টার। হাতে টেলিগ্রাম। sms —ma,i am not coming. Next year sure come. Sorry ma.
টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে কাকিমা, চুপ করে বসে রইল।রমলা, সান্ত্বনা দিতে গেল। নিশ্চয় খুব কাজের চাপ কাকিমা। চিন্তা করো না। সামনের মহালয়ায় ঠিক আসবে দিদিমণি।
রমলাকে কাছে টেনে নিল কাকিমা। আজ থেকে তুই সুনীতার ঘরেই থাকবি। ওর কাপ প্লেটে চা খাস। আর হারমোনিয়ামটায় গান ধরিস। কাল থেকে তোকে ভালো করে গান শেখাব।
রমলার দু’চোখ জলে ভরে গেল। মা বাপ মরা মেয়ে। সেই ছোট বেলা থেকে আছে এই বাড়ি। কেউ ওর দায়িত্ব নিতে চাইলো না। তখন থেকেই এই কাকিমা কাছে টেনে নিয়েছিল। তবে কোনো দিন মেয়ের আসন দিতে পারে নি। মেয়ের ব্যবহার করা জিনিসে হাতও দিতে দেয় নি।
আজ সে অধিকার দিল। মেয়ের আসনে রমলাকে বসতে দিল। মহালয়া শুরু হলো। দেবীপক্ষে, দেবীর আগমন।

Exit mobile version