না বলা কথা
-পারমিতা ভট্টাচার্য
‘বাড়িতে এক ঘেয়ে বসে থাকতে আর ভালো লাগে না আমার। মাঝে মাঝে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে সুদূর দিগন্তের দিকে। খোলা আকাশের নিচে বসলে নিজের কষ্টকে কিছুটা হলেও ভোলা যায়। নিজেকে অনেক প্রাণবন্ত লাগে।’ এসব কথাই অপু বলছিল ভাই সঞ্জুকে। সঞ্জুও তাই বাড়ির পারমিশন নিয়ে দাদাকে একটু ঘুরতে নিয়ে বেরিয়েছিল। অপুর অশক্ত, দুর্বল শরীর তাই বেশি দূর যেতে পারেনি। বাড়ির কাছেই মালিয়া স্টেশনের বেঞ্চেই বসেছিল ওরা দু’জন। এই স্টেশনটি একটু নির্জন। দু’ দিকে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমাহার। মাথার উপর খোলা আকাশ। এই পরিবেশে বসে অপুর আরও অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছে করছে। উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে প্রকৃতির এতো রূপ। ঠিক তখনই সে দেখে উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে নীলা। সাথে স্কুলের আরও শিক্ষক, শিক্ষিকা ও এক ঝাঁক শিশু। নীলার সাথে একটু কথা বলার জন্য ছটফট করে উঠল অপুর মন। কিন্তু চিরকালের মত সে দিনও সে গুটিয়ে রাখলো নিজেকে। বাড়িতে বসে অপু ভাবতে লাগলো নীলা এখন নিজেকে অনেক শক্ত করে নিয়েছে। যদিও এখনও সে বাচ্চাদের মতই ছটফটে প্রাণবন্ত আছে। সে দেখতে যতই বিকৃত হয়ে যাক, আজও সে অপুর চোখে স্বর্গের অপ্সরী। অপু মনে মনে ভাবলো, তার হতে সময় খুব কম। যে কথা সে এত ধরে বুকে জমিয়ে রেখেছে, মুখ ফুটে তার সামনে বলে উঠতে পারেনি.. সে কথা একটা চিঠি লিখে নীলাকে জানাবে। নিজের খুড়তুতো বোন ঈশিতার হাতে চিঠিটা দিয়ে নীলাকে দিতে পাঠালো। ঈশিতা নীলার হতে চিঠিটা দিয়ে বলল – ‘এখন নয়, রাতে পড়িস।’
রাতে শোবার সময় নীলা তার অতি ক্ষীণ দৃষ্টি দিয়ে চিঠিটা পড়তে লাগলো।
” প্রিয়তমাষু,
আজ যখন তোমায় মালিয়া স্টেশনে দেখলাম তখন একটা অদ্ভুত ভালোলাগা মনে জুড়ে আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছিল। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার। কন্ঠ থেকে কিছুতেই কোনো শব্দ স্বর হয়ে বেরোতে চাইল না আজ। শুধু মনে হলো দু’ চোখ ভরে দেখে যাই তোমায়। তুমি এখনও সেই অষ্টাদশীর মতই সুন্দর, প্রাণবন্ত আছো। মনে আছে নীলা, আমি তোমার সামনে গেলেই কেমন ক্যাবলা হয়ে যেতাম। তুমি সারাক্ষণ কত কথাই না বকবক করে যেতে। আর আমি? দূর থেকে তোমার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম। কখনও তোমাকে কোনও চিঠি লেখার ইচ্ছে বা সাহস কোনওটাই আমার হয়নি। আমি সারা জীবন তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রাবস্তীর কারুকার্য খুঁজে যেতাম। ভেবেছিলাম তোমার হাতটা হাতের মধ্যে রেখে কাটিয়ে দেবো সারা জীবন। আমৃত্যু তোমার চোখে খুঁজে নেবো জীবনের মানে। এখন হাসি পায় সে সব কথা ভাবলে। আজ কোথায় তুমি আর কোন অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া আমি। তোমার মনে আছে নীলা, ঈশিতার হাত দিয়ে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলাম তোমায়। তখন আমার মাঝে মাঝেই জ্বর আসতো। কলেজ যেতে পারতাম না। তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করতো তখন। কিন্তু তখন তুমি রাজেশের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো। সে চিরকুটখানা তুমি খুলে দেখার প্রয়োজনও বোধ করলে না । রাজেশ তখন নিজের লাল্টুস রূপ নিয়ে তোমার মত সহজ সরল মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে সর্বনাশ করে যাচ্ছে। তোমাকে সাবধান করতেই লিখেছিলাম সেই চিরকুট। তারপর যা হওয়ার হলোই। তুমিও রাজেশকে ভালোবেসে ঠকে গেলে। বলতে গেলে একেবারেই শেষ হয়ে গেলে। আমি তখন রোগশয্যায়। সদ্য ধরা পড়েছে আমার বোন ক্যান্সার। কলেজ তো একেবারেই প্রায় বন্ধ। তবুও যেন এমন একটা দিন যায় না যে দিন আমি তোমার কথা ভাবি না। তোমার উপর যখন রাজেশ অ্যাসিড এট্যাক করে তখন আমি ব্যাঙ্গালোরে। বাড়ি ফিরে সব শুনে মাথার রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল আমার। কিন্তু আমি নিরুপায় একটা মানুষ। বাবা, মা তখন আমার চিকিৎসা করাতে প্রায় নিঃস্ব। ওদের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুই করতে পারিনি। তুমি যখন হসপিটালে অ্যাডমিট ছিলে, আমি প্রায়ই যেতাম তোমায় দেখতে। তুমি কিচ্ছুটি জানতেও পারতে না। তোমার মত সুন্দর মন আমি আর কোত্থাও পায়নি নীলা। তুমি যে আজ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছো, স্কুলে পড়াচ্ছ, বাচ্চাদের মত খিলখিলিয়ে হাসছো, আনন্দে আছো এই দেখে আমি আজ ভাবি, আমি হয়তো এবার মরেও শান্তি পাবো। তোমাকে সারা জীবন দূর থেকেই দেখতে চেয়েছি। কিন্তু তাই বলে ছুঁয়ে দেখতে মন যে কখনওই চায়নি, তা নয়। কিন্তু মনকে বারবার বুঝিয়েছি তুমি হলে ফুলের সুগন্ধ, পূর্ণিমা চাঁদের জ্যোৎস্না। তোমাকে শুধুই অনুভব করা যায়, ছোঁয়া যায় না। নীলা, এই চিঠি তোমাকে লেখা প্রথম ও শেষ চিঠি আমার। তুমি এই চিঠি যখন পাবে আমি তখন হসপিটালের বেডে হয়তো মৃত্যুর অপেক্ষা করবো। একটা শেষ অনুরোধ তোমার কাছে নীলা। রাখবে? তোমার কাছে আমি কোনও দিন কোনও দাবী করিনি, আজ করছি। আসবে হসপিটালে একটিবার আমাকে দেখতে? তুমি আজও আমার কাছে সেই একই আছো যাকে আমি সারা জীবন ভালোবেসে এসেছি। ঈশিতার হাত দিয়ে চিঠিটা পাঠালাম। এবারটা অন্তত পড়ো চিঠিটা। তোমাকে অনেক কথা যে আমার বলার ছিল নীলা। পরশু আমার অপারেশন। হয়তো আর বাঁচবো না। শরীর আর অপারেশনের ধকল নিতে পারে না। একটিবার – শুধু একটিবার তোমায় হাতে হাত রেখে বলতে চাই নীলা, আমি এ জীবনে শুধু তোমারই ছিলাম। সেই সুযোগটুকু পাওয়ার ভাগ্যও কি আমি করিনি নীলা? অপেক্ষা করবো তোমার।
ইতি ভাগ্যহীন,
অপু। “
সে দিন রাত থেকেই অপুর শরীর খুব খারাপ হতে থাকে। ডক্টর এসে বলে হসপিটালে অ্যাডমিট করাতে। অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার সময় নীলাদের বাড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখে অপু। নীলা দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পথেই অপু শেষ হয়ে যায়। অপুর না বলা কথা গুলো আজ মহাশূন্যে ঘুরপাক খেয়ে শেল হয়ে বেঁধে নীলার বুকে।
হঠাৎই অপুর মা আসে নীলাদের বাড়ি। নীলার বাবাকে তিনি বলেন যে, তাঁর ছেলে মৃত্যু সময় তার বাবাকে বলে গেছে তার চোখ দু’টো যেন নীলাকে দেওয়া হয়। কারণ, অ্যাসিড এট্যাকে নীলার একটা চোখ একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে, আর একটা চোখেও দৃষ্টি ক্ষীণ।
নীলা আজ বাড়ি আসছে, দু’ চোখে দৃষ্টি নিয়ে। অপুর ভালোবাসা বিফলে যায়নি। সারা জীবন অপু তার সাথেই থাকবে, চোখের মণি হয়ে।
সমাপ্ত।
বাহ্ ! সুন্দর !