Site icon আলাপী মন

গল্প- আশার আলো

আশার আলো
-সঞ্চিতা রায়(ঝুমা)

 

দুর্গা পুজো এসে গেল,অথচ স্নেহার নতুন জামাকাপড় কেনার কোনো আগ্রহ নেই। চারিদিকে আলো লাগানো হচ্ছে দুর্গা পুজো উপলক্ষে অথচ সেদিকে তাকাতে ইচ্ছা করছে না স্নেহার । অথচ এই মেয়ে অন্যান্য বছর আলো লাগানো হলে অফিসে সারাদিন কাজ করার পরেও ছুটে চলে যেত কোথায় কিভাবে আলো সাজানো হয়েছে দেখার জন্য। কে কোন দিন কি পরবে তাই নিয়ে আলোচনা করতো। সে আজ ঘর অন্ধকার করে বসে আছে। দু’মাস হ’ল পরিস্থিতির চাপে পড়ে বেসরকারী সংস্থার কাজটা ছাড়তে হয়েছে স্নেহাকে। স্নেহা সংস্থাটাকে বা সংস্থার সমস্ত কর্মীদের বড় ভালবাসতো। সংস্থাটাকে এতটাই আপন করেছিল, এতটাই ভালবেসেছিল যে অনেক ভাল ভাল চাকরির অফার সে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তার ধারণা ছিল কাজ করতে গেলে ভালবেসে আবেগ দিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু পেশাগত জগতে যে আবেগের কোনো দাম নেই সে আজ ভালভাবে বুঝতে পারছে। এই মুহূর্তে তার চাকরি নেই, এটা সে ভাবতেই পারছে না। তার কেবলই অফিসে সবার সাথে আনন্দ করে কাজ করা, টিফিন শেয়ার করা আরো কত মিষ্টি মুহূর্তের কথা মনে পড়ছে। দুপুরবেলা বাড়ি থাকতে বড় অসহ্য লাগছে। কর্মহীন দুপুরবেলা তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। কিছুতেই পুজোতে নতুন পোষাক নিল না সে। দেখতে দেখতে ষষ্ঠি এসে গেল, পাড়ার চারিদিকে আলো আর স্নেহা ঘরে আলো নিভিয়ে বসে আছে। বাড়ির অন্যরাও স্নেহার জন্য পুজোতে আনন্দ করতে পারছে না। বাড়ির একজন এইরকম বিষন্ন হয়ে থাকলে অন্যদের কি ভাল লাগে। কেউ মন্ডপে যেতে চাইছিল না। স্নেহার মা বাবাকে একরকম জোর করে পাড়ার পুজোতে পাঠিয়ে দিলেন স্নেহার ঠাকুমা। নাতনীর ঘরে এসে আলো জ্বেলে দিলেন ঠাকুমা। “ঠাম্মি প্লীজ আলোটা বন্ধ করে দাও, আর আমাকে একটু একা থাকতে দাও”। পাশে এসে বসে নাতনীর মাথায় হাত বোলালেন ঠাকুমা। “আমাকে একটা গান শোনাবি সোনাই”। ঠাকুমা স্নেহাকে সোনাই বলে। ‘ঠাম্মি আমার ভালো লাগছে না”। “তোকে একটা কথা বলি শোন্ এক দরজা বন্ধ হলে দশ দরজা খুলে যায়”। তাকিয়ে দেখ তোর জন্য কত পথ খোলা আছে। আর তোর গলায় এত সুর, তুই তার অমর্যদা করবি? প্রতিভার অসম্মাান করলে কিন্তু ভগবান অসন্তুষ্ট হন। স্নেহার মনে পড়লো, সত্যিই তো সে যে গান গাইতে বড় ভালবাসতো। গান ছাড়া জীবন ভাবতেও পারতো না। মা সরস্বতী তার গলায় অপূর্ব সুর দিয়েছেন। স্কুলে, কলেজে সবাই তার গান মুগ্ধ হয়ে শুনতো। ঠাকুমা নিজেই হারমোনিয়ামটা নিয়ে এলেন। হারমোনিয়াম দেখে মনটা স্নেহার আবেগ আপ্লুত হ’ল। গান শুরু করলো। সত্যিই তো তার গলা থেকে সুর হারিয়ে যায় নি। সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাত আটটায় বাড়ি ঢুকে তার আর গান করার মত ইচ্ছা থাকতো না। রবিবার দিনগুলো পর্যন্ত মাঝে মাঝে কোম্পানিকে দিতে হ’ত। কাজের চাপে চাপা পরেছিল তার সকল সুকুমার বৃত্তি। গান, লেখালেখি, বইপড়া সবই যেন হারিয়ে গিয়েছিল। নিজের গলা শুনে নিজেই যেন মুগ্ধ হ’ল। হ্যাঁ, পুজোর অনুষ্ঠানে গান গাইল সে। মুগ্ধ হয়ে শুনলো সবাই। অভিভাবক অভিভাবিকারা এগিয়ে এসে তাদের ছেলে মেয়েদের গান শেখানে অনুরোধ করলেন। স্নেহার মনে হ‘ল সত্যিই তো সে যা শিখেছে তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। তার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। কোম্পানিতে যা মাইনে পেত, তার চেয়ে অনেক বেশী রোজগার হতে লাগলো তার। যাদের ক্ষমতা কম তাদের একেবারে কম পারিশ্রমিক বা বিনা পারিশ্রমিকেও সে গান শেখাতে শুরু করলো। বাড়ির একটা ঘরেই সে গানের ক্লাশ নিত। গানে গানে মুখরিত তার ঘরে এক অপূর্ব পরিবেশ সৃষ্টি হ’ত। ক্রমে তার সিডি বেরালো। গান শুনে গান শেখা যায়, এমন শিক্ষামূলক সিডি-ও সে বার করলো। ইউটিউবেও গান শেখানো রেকর্ডিং তৈরী করলো। আজ দীপাবলী। ছাত্রছাত্রীরা সারা বাড়িতে প্রদীপ, মোমবাতি জ্বালিয়েছে। তার উপর টুনি দিয়েও ঘর সাজিয়েছে। অসাধারণ লাগছে বাড়িটাকে। গান শেখানো ছাড়াও সে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের পড়ায়। তারাও সামিল এই আনন্দ অনুষ্ঠানে। শব্দবাজী নয় আলোকবাজি জ্বালিয়ে আনন্দে উদ্বেল তারা। তাদের মিস’ই তাদের বাজি, বাতি সব কিনে দিয়েছেন। মিস’ও তাদের চোখের মণি । তারাও মিসের চোখের মণি। স্নেহার পরিবারের সবাই আনন্দ করছে। ঠাম্মি নিজে খিচুড়ি, বেগুনভাজা আর লাবড়া রান্না করছেন। সবাই মিলে আজ ছাদে খাওয়া দাওয়া। সব কিছুই বোধহয় সম্ভব হয়েছে ঠাম্মির উৎসাহ ব্যঞ্জক কথায়-তিনি বলেছিলেন, ‘এক দরজা বন্ধ হলে দশ দরজা খুলে যায়’। স্নেহা আলোক উজ্জ্বল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবছে সে তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে, মানুষের মধ্যে সব সময় আশাব্যঞ্জক বার্তা ছড়িয়ে দেবে সবসময়। খুঁজে দেখবে কার মধ্যে কি প্রতিভা আছে, চেষ্টা করবে সেই প্রতিভার যেন পূর্ণ বিকাশ ঘটে। এতদিন তার গানের বা পড়ানোর প্রতিষ্ঠানটার কোনো নাম ছিল না। এবার সে একটা নামফলক দিল, প্রতিষ্ঠান একই নামে পরিচিত হ’ল – ‘আশার আলো’।
হ্যাঁ জীবনে বাঁধাবিঘ্ন যাই আসুক নিরাশার অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে আনন্দ খুশির আলোকে জীবনে
জ্বেলে দেওয়ার কাজ স্নেহা, তার পরিবার এবং ছাত্রছাত্রীরা করতে থাকবেই।

Exit mobile version