একটি রাত
-উজ্জ্বল দাস
ডান দিক, ডান দিক, ডান দিক। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ আর একটু, আর একটু বাঁ দিকে, হ্যাঁ হ্যাঁ একটু নিচে। এই এই এই…হ্যাঁ এই খানটা। উফফ একটু জোরে জোরে দেনা বাবা। ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে চুলকে দে, উফফ। আহহহহ আহহহহহহ।
(এক)
বাড়িটা থমথমে করছে। ডানদিকে বড়মামা, মাটিতে মাথায় হাত দিয়ে বড় মামীমা বসে। মেজমামারা এসে ঢুকবে এক্ষুনি জানালো টেলিফোনে। মা বারবার বাথরুমে যাচ্ছে। বাবা সারাক্ষণ একে ওকে ফোন করে চলেছে। যেন এই বুঝি কোনো খবর এলো। টালিগঞ্জ থানায় একটা ডায়েরি করে পিসেমশাই সদ্য জানালো যে খবর পাওয়া মাত্রই পুলিশ ফোন করবে। ছবিও দিয়ে এসেছে একটা।
মেয়েটা হঠাৎই বিকেলের পর বাড়ি ফেরেনি। ছোট্ট মেঘলা এখন বছর পঁচিশের সুন্দরী তরুণী। বন্ধুদের সঙ্গে দুপুর বারোটা নাগাদ বেরোবে সেরকমই কথা ছিলো। এখন রাত সোয়া এগারোটা বাজে। কিন্তু মেয়ের কোনো খবর না পেয়ে সবাইকে জানায় ওর বাবা সৌরিন্দ্র বাবু। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না! থানায় খবর দেওয়া ছাড়া আর উপায়ই বা কি। মেয়ে বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছিলো না কিছুতেই, বাবা জোর করে বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ের কথা চালিয়ে যাচ্ছিলো। তাতে আবার মেয়ে কিছু করে বসলো কিনা, এইসব জল্পনা চলছে।
মা রিতা দেবী খামোখা বাবাকে দু’কথা শুনিয়ে দিয়ে আবার একবার বাথরুমে চলে গেলো। “আজ তোমার জন্যই সব হলো, পই পই করে বারণ করা সত্ত্বেও বিয়ে দিতে যাচ্ছিলে। যাও এবার ঠ্যালা বোঝো”। হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে থমথমে ঘরটাতে সবার চাহনি। এই বুঝি কোনো খবর। বড়মামা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো মেজমামারা এসে গেছে।
– কোনো খবর আছে দাদা?
– নাহ্ রে। আয় বস। এই তো থানায় ডায়েরি করা হয়েছে। দেখা যাক। তবে সবাই বলছে হাসপাতালগুলোতেও একটু খবর নেওয়া দরকার। কি করবো কিছুই বুঝতে পরছি না।
– তাহলে চলো সময় নষ্ট না করে আমরা বেরিয়ে পড়ি। আশপাশের হাসপাতালগুলো যাবো। আর তিন্নি যখন আছে ও একটু সামলে নেবে বাড়ি।
আবার কলিং বেলের আওয়াজ। আবার সব চুপ। যেন ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাবার জোগাড়। দরজা খুলতেই দেখা গেলো পাশের বাড়ির হরেন জ্যেঠু এসেছে। এসে সটান সোফায় বসে পড়লেন বছর সত্তরের বৃদ্ধ। বসেই মস্ত একটা হাই তুলতে তুলতে বললেন “আচ্ছা তোমরা হাসপাতালগুলো দেখলে না? বারবার করে বললাম, ওখানে গিয়ে মর্গগুলো দেখতে। আমার ভায়রা ভায়ের শ্বশুরের বন্ধুকে তো শেষ অব্দি মানিকতলার মর্গেই পাওয়া গেছিলো। সে যা অবস্থা পচা গলা, চেনাই যাচ্ছিলো না নাকি। দেখো এখন প্রায় রাত একটা বাজে কাল ভোর হতেই সব মর্গগুলোতে একে একে চলে যাও। তোমরা চিন্তায় আছো দেখে আমার আবার ঘুম আসছে না।“
সবাই সবার মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগলো। উপায় নেই তাই। বয়স্ক মানুষের যেচে পরে গালভরা মন্দগুলোও শুনতে হয় অসময়ে। কোনো চ্যাংড়া হলে এতক্ষণে চড়িয়ে দিত বড়মামা। “টিং টং, টিং টং” আবার বেল বাজলো। “আবার কে?” বলতে বলতে বড়মামা দরজাটা খুলতেই হরেন জ্যঠাইমা এসে হাজির।
– কই গো, ঘুমুবে না। একুনো বসে রয়েচো যে। তা বাবা তোমরা খপর কিছু পেলে? নাকি বাড়ি বয়ে কেউ খপর দেবে সেই আশায় রয়েচো।
মেঘলার মা পায়চারি করছিলেন। নির্বিকার জবাব দিলেন..
-না মাসিমা, এখনো কোনো খবর পাইনি। চেষ্টা করছি।
-কেন তোমরা তো আবার আমাদের কতায় কান দাও না বাপু আমাদের উনি যখন বলতেছেন যে হাসপাতাল, মর্গ এগুলো দেকো, তা না। বাপু যাও না। কথা শুনতে হয় বড়দের।
– না মাসিমা আপনারা বরং গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমরা খবর পেলেই জানিয়ে আসবো।
-যাচ্ছি যাচ্ছি, আর তাইরে দিতে হবে নেকো। আচ্ছা রিতা মা, ওই যে ছেলেটি আসতো তোমাদের বাড়ি, তা সে মেয়ের বয় না গাল কি একটা ফেন্ড। তেনার চঙ্গে আবার পাইলে টাইলে গেলো কিনা..
বড়মামা মুখের কথাটা একপ্রকার কেড়ে নিয়েই বললো,
-পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলেও আপনাদের নেমন্তন্ন মার যাবে না মাসিমা। আমি নিজে হাতে আপনাদের গিলিয়ে মানে ওই মানে খাইয়ে আসবো। আপনাদের বয়স হয়েছে। গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আর কত চিন্তা করবেন আমাদের নিয়ে। বরং গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েই পাশের বাড়ি হরেন জ্যেঠু আর জ্যঠাইমা নড়তে নড়তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন এক রাশ নিস্তব্ধতা। চলে যেতে সবাই একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।
(দুই)
এবার একটু সবাই শান্ত হয়ে বসে কি কি করা যায় আলোচনা শুরু করে দিলো। সমস্ত আত্মীয় স্বজনের বাড়ি খবর নেওয়া হয় গেছে। পুলিশে খবর দেওয়া আছে। খবর পেলেই জানাবে। হাসপাতালগুলো কাল ভোর বেলা থেকেই যাওয়া শুরু করবে সব। একদিকে বড়মামা আর পিসেমশাই আর অন্য দিকে মেজমামা সৌরিন্দ্র বাবুকে নিয়ে বেরোবে। মামীমা, মা তিন্নি সব বাড়িতে থাকবে। এইসব আলোচনা করে সবার চোখগুলো একটু লেগে লেগেও আসছে এবার।
বাইরে গাড়ির হর্নে যেন নিদ্রাভঙ্গ হলো সবার। দরজায় এসে দাঁড়ালেন মেঘলার কাকা কাকিমা আর বছর সতেরোর মেয়ে ঐন্দ্রিলা। ঢুকেই এমন ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি। এটা সবার জীবনেই ঘটে থাকে। কর্পোরেটের একজন উচ্চ পর্যায়ের আধিকারিক খুব সাবলীল ভাবে সবার সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করলেন। ঠিক কি হয়েছে। কি করা উচিত এই সমস্ত। আর ঐন্দ্রিলা মায়ের সঙ্গে ইংরেজিতে কিছু একটা তর্ক করে চলেছে সমানে। তার বাংলা মানে করলে এরকম দাঁড়ায়।
– দেখো মা তোমায় কি বলতে হবে, না বলতে হবে সেটা কি সব সময় আমরা শেখাতেই থাকবো?
– তুমি চুপ করো। আমি জানি মেঘলা প্রেম করতো। সেই ছেলেটার সাথে যে ভাগবে, একদিন সেটা আগেই জানতাম কিন্তু আমি দিদিকে (মেঘলার মা) কিছুই জানাই নি।
– তা তুমি যখন এতটাই সিওর, জানাওনি বা কেন।
– ইচ্ছে করেই বলিনি কারণ আমাদের স্ট্যাটাসের নয় ওরা বা তাতে ওরা কষ্ট পেতে পারে। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে দিন পনেরো আগে মেঘলাকে দেখে আমি ঠিক যেটা ডাউট করেছিলাম সেটাই সত্যি।
-হোয়াট ডু ইউ মিন মম?
-আই মেন্ট এক্সাক্টলি হোয়াট ইউ নো।
-রাবিশ! তুমি কি বলতে চাইছো? দিদিয়া প্রেগনেন্ট? তাই পালিয়ে গেছে?
-এক্সাক্টলি তাই।
“আহঃ স্টপ ইট”। বলে একপ্রকার রেগে গিয়েই বাবা ধমক দিলো মা আর মেয়েকে।
(তিন)
ভোর পাঁচটা।
দিনের আলোয় সবদিক দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সবাই তৈরি হবে বেরোনোর জন্য। কানের কাছে
ক্রিং,, ক্রিং,, ক্রিং,, ক্রিং,, করে টেলিফোনটা সজোরে বেজে উঠলো। সবার মনেই একটা অনুকম্পা। খবর কিছু একটা তো আছেই। নাহলে এভাবে এত সকালে কেই বা ফোন করবে! কাল সারাদিনের ধাক্কায় সৌরিন্দ্র বাবু অনেকটাই মুহ্যমান। তাহলেও উপায় নেই। বাড়ির ফোন, আর কে বা ধরবে?
ফোনটা তুলে হ্যালো বলতে, ওদিক থেকে শোনা গেলো..
– আমি টালীগঞ্জ থানার ও.সি কথা বলছি। একটু সৌরিন্দ্র বাবুর সাথে কথা বলানো যাবে?
– আমি ই কথা বলছি। বলুন স্যার।
– আপনারা যত তাড়াতাড়ি পারবেন এক্ষুনি একবার হাওড়া সিটি হাসপাতালে চলে যান। ওখানে কাল সন্ধ্যা বেলা একজন গঙ্গায় আত্মহত্যা করেছে। দেখে আসুন আপনাদের মেয়ে মেঘলা চ্যাটার্জী কিনা। লাশটা আইডেন্টিফাই করতে হবে। হাওড়া নিমতলা ঘাটের পাশেই…
-আচ্ছা আমরা চিনি। এক্ষুণি বেরোচ্ছি অফিসার..
বলে ফোনটা অবচেতন মনে পাশেই ফেলে রেখে দিলেন সৌরিন্দ্র বাবু। হতাশ হয়ে বসে পড়লেন সোফার হাতলে। চারদিক থমথম করছে। কাকে কি বলবেন বুঝে ওঠার আগেই বড়মামা গিয়ে ফোনটা তুলে “হ্যালো হ্যালো” বলতে অন্য দিকের জোরালো গলার উপদেশটা শুনেই ফোনটা কেটে দিয়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো। এদিকে বাড়ির সবাই তাকিয়ে আছে খবরের অপেক্ষায়।
বড়মামা ভগ্নিপতিকে আর ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যাবার সময় জানিয়ে গেলো যে হাওড়া বড় বাজারের কাছে কোনো একটা হাসপাতালে এক্ষুণি যেতে হবে। সেখানে গিয়ে গঙ্গা থেকে তুলে আনা একটা লাশ নাকি আইডেন্টিফাই করার আছে। মেঘলার মতো বয়সী কেউ কাল গঙ্গায় ডুবে আত্মহত্যা করেছে। একদম চেনা যাচ্ছে না। তবে বড় মামার বিলক্ষণ মনে হচ্ছে তেমন কিছুই হবে না। এহেন খবরে বাড়ির সকলেরই কান্নার রোল, হা হুতাশ তুলেছে এক প্রকার। তিন্নি আর ঐন্দ্রিলা ছাদে চলে গেছে এসব শুনে। মেঘলার মা আবার কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলেন। মামীমারা পাশাপাশি মাটিতে বসে। কাকু কাকিমা চুপচাপ নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কিছু কথা বলে চলেছেন। তাহলে কি পাশের বাড়ির হরেন জ্যাঠাই সত্যি হলো অবশেষে।
হাসপাতালে পৌঁছে মর্গের সামনে অপেক্ষায় সবাই। কখন খোলা হবে মর্গ। আরো আধ ঘন্টা কেটে গেল। সৌরিন্দ্র বাবুর মুখ ক্রমেই আরো ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। ভাগ্যের জোরে যেন এখানে ভাগ্নিকে না পেতে হয় মামারা সেই প্রার্থনাই করে চলেছে।
অবশেষে মর্গের দরজাটা খোলা হলো। প্রবল ঠান্ডায় চারদিকে বরফের ভোটকা গন্ধে ধোঁয়া ধোঁয়া উড়ছে। আর দু’টো পরিবার অপেক্ষা করছিলেন। ঢক করে ডালাটা খুলতেই ট্রে-টা বেরিয়ে এলো। পচা গলা একটা লাশ। চেনার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। স্বযত্নে তাকে মর্গের ভেতরে রেখে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চেহারা, উচ্চতা দেখে মেঘলাই মনে হচ্ছে। হরেন জ্যেঠু থাকলে না দেখেই হয়তো “হ্যাঁ” বলে দিতেন। সে যাই হোক। আরো ভালো করে খুঁটিয়ে দেখার জন্য জামাইবাবুকে ডাকা হলো। সৌরিন্দ্র বাবু কাঁপতে কাঁপতে এসে দেখলেন। বার বার তাকালেন। অস্ফুটে বলে উঠলেন “হ্যাঁ এই তো আমার মা, আমার মামনি… মামনি”।
ডুকরে কেঁদে উঠে বেড়িয়ে গেলেন। বড় মামা, মেজমামা এতক্ষণে বুঝতে পেরে গেছে সব শেষ। কি এমন হলো যে মেয়েটা এমন কিছু করে বসলো। হায়রে কি কপাল। জামাইবাবু কমাস ধরেই মেয়ের বিয়ে দেবার তোড়জোড় করবে বলে ভাবছিলো। তাতেই কি এরকম হলো, কে জানে। তিন জনেই মর্গের বাইরে রাখা একটা লোহার মরচে পড়া বেঞ্চে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। এবার সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে, থানায় গিয়ে কথাও বলতে হবে। তারপর ডেড বডি ছাড়বে। তারপর একে একে ফুল, মালা, খাট…উফফ। হাসপাতালের বাইরের টেলিফোন বুথ থেকে মেঘলার কাকাকে ফোন করে সব জানানোর কথা ভাবছে বড় মামারা। কি ভাবে বলবে, দিদিকেই বা কি জানাবে। একি সর্বনাশ হয়ে গেলো। বড়মামা উঠে গেলো জামাইবাবুর পাশে মেজমামাকে রেখে। টেলিফোন বুথ থেকে বাড়িতে সব জানানো হলে তারপর এক এক করে কাজে হাত দিতে হবে।
(চার)
সৌরিন্দ্র বাবুকে হঠাৎ মেজমামা কনুই দিয়ে একটা ধাক্কা মারল। “ও দেখুন জামাইবাবু”।
-হু! কি হলো।
-দেখুন না ভালো করে।
-ওই ওই, মেঘলাকে ওনারা ওদের মেয়ে বলে দাবি করছেন। তাহলে!!
-মনে? সেকি? ও কি তবে মামনি নয়? চলো তো দেখি।
মর্গের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই সব পরিস্কার হয়ে গেল। অন্য একটা পরিবার অসম্ভব কান্নায় ভেঙে পড়েছে। মেঘলা বলে যে ডেড বডিটা ওঁরা আইডেন্টিফাই করেছিলেন আসলে ওটা মেঘলা নয়। মেঘলা কখনোই পায়ের তোড়া বা হাতে ট্যাটু করেনি। ওই চিহ্ন আর গয়না দেখে খুব সহজেই বোঝা গেলো যে ওটা মেঘলা নয়। মুহূর্তে সৌরিন্দ্র বাবুর অশ্রু, আনন্দাশ্রুতে পরিণত হলো। অন্তত যার গেলো তার গেলো বটে কিন্তু এখনো তো ভাবাই যায় মেঘলা মা ভালো আছে।
ওদিকে বড়মামা ততক্ষণে ফিরে আসছে ফোনে কথা বলে। এসে দেখলো জামাইবাবু আর মেজমামা দু’জনে যেন একটু সহজ। হাসি হাসি মুখ। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অথচ বাড়িতে ফোন করেও কিছু বোঝা যায়নি। দিদি বলেছে এক্ষুণি বাড়ি ফিরে আসতে। ওরা নাকি ফোনের অপেক্ষায় বসে ছিলো সব। জামাইবাবু আর ভাইয়ের থেকে সবটা শুনে ওদের হাসির কারণটা যদিও বুঝতে পারলো তথাপি জরুরি ভাবে বাড়িতে ফিরতে বলার কারণটা কেউই বুঝে উঠতে পরলো না। অগত্যা বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
(পাঁচ)
প্রায় সাড়ে নটা বাজে।
বাড়িতে ঢোকার মুখেই যেন মুহূর্তে পাল্টে গেল মানসিক টানাপোড়েন। খোলা হয়েছে দীর্ঘ সাত বছর ধরে বন্ধ থাকা ঘর। এসব কি! কোনো উৎসব হচ্ছে নাকি বাড়িতে। সবাই মিলে একসাথে কূটনো কুটতে বসে পড়েছে। দেখতে দেখতে মেঘলার কাকা হাতে করে সবার জন্য কচুরি মিষ্টি নিয়ে ঢুকলেন। বড়মামা, মেজমামা, সৌরিন বাবু ঘুণাক্ষরেও কেউ বুঝতে পারছে না কিছু।
“আরে কেউ তো কিছু বলো” বলেই চোখটা গেলো বাঁদিকের এতদিন বন্ধ হয়ে থাকা ঘরটার দিকে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে সৌরিন্দ্র বাবু দেখলেন নিজের মা’কে। প্রায় সাত সাতটা বছর পর। সঙ্গে তিন্নি, ঐন্দ্রিলা কত্ত গল্প করছে, কত্ত প্রশ্ন তাদের। কেউ তাদের দিদাকে, কেউ ঠাম্মিকে ফিরে পেয়েছে। যেন এক নতুন মানুষ এসেছে বাড়িতে। মা বড় ছেলের দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরিয়ে আনন্দ পাচ্ছেন। একটু এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলো মায়ের কাছে। কেনই বা এমন জরা জীর্ণ চেহারা হয়েছে মায়ের। পেছন থেকে উত্তর এলো “এসবের উত্তর তোমাদের আমি দেবো বাপি।“
-মেঘলা! মা, কোথায় চলে গেছিলি মা আমাদের ছেড়ে? কেন একটা খবর দিসনি মামনি? কি দোষ করেছি আমরা সোনা! কাল সারা রাত কোথায় ছিলি মা? মাকেই বা আজ হঠাৎ এভাবে, আমার তো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
-দাঁড়াও। সবাই বসো শান্ত হয়। সব জানাবো।
ধীরে ধীরে সবাই জড়ো হয়েছে মায়ের মানে ঠাম্মির ঘরে। কেউ কেউ এতক্ষণে কিছুটা জানলেও পুরোটা জানা হয়নি কারুর। শুরু করলো মেঘলা।
-দাদু মারা যাবার ঠিক পর পরই তুমি আর কাকাই মিলে বছর সাত আট আগে যখন এই বাড়িটার দখল নেবে বলে ঠাম্মিকে একটা ছোট্ট চালা ঘরে নির্বাসন দিলে তখন আমি নিতান্তই ছোট। তখন থেকেই ব্যপারটা আমায় ভীষণ কষ্ট দিতে শুরু করে। কিন্তু তোমরা কেউ আমার কথা শুনবে না বলে আমি তখন কিছুই বলতে পারিনি। তুমি আর কাকাই মিলে ঠিক করলে তোমাদের মা’কে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। আর মাসে মাসে পাশের পাড়ার গাড়ি চালক সমীর কাকুকে দিয়ে দু’জনে মিলে তিনশ তিনশ, ছশ টাকা পাঠিয়ে তোমাদের দায়িত্ব ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলবে। আচ্ছা কাকাই বলতে পারো আজ ছ’শ টাকায় কি হয়? তিন্নি বা ঐন্দ্রিলার হাত খরচ কত? বলতে পারো মেজমামা?
বাবা, কাকু দু’জনেই মাথা নিচু করে বসে আছে।
-তাই আমি আর সমীর কাকু মিলে গত দু’বছর ধরে প্রত্যেক মাসে দেখা করে আসতাম আর আমার টিউশনি করার টাকা থেকে হাজার টাকা করে দিয়ে এসেছি এতদিন। কাল হঠাৎ ঠাম্মির কাছে যখন যাই, দেখলাম জ্বরে ঠাম্মির গা পুড়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড শরীর খারাপ। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। খাওয়ার কিছু নেই। আমি মাথায় জলপট্টি দিতে শুরু করি, আর সমীর কাকু ডাক্তার ডাকতে যায়। অনেকক্ষণ পর যখন একটু ওষুধ পড়লো তখন ঠাম্মি আস্তে আস্তে সুস্থ হতে শুরু করলো। কিন্তু সেই অবস্থায় আমি ঠাম্মিকে একা ফেলে চলে আসতে পারিনি। সমীর কাকু ফিরে আসার সময় ওনার ফোন নম্বরটা দিয়ে বলেছিলেন “দরকার হলে ফোন করিস, তোর বাবা মা বা কাকু কাকিমা কেউই গত সাত বছরে একবারও আসেননি।“ এভাবেই আমি আর ঠাম্মি রাতটা অনেক কষ্টে কাটালাম একসাথে। আর তোমরা জানতে আমি বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে বেড়িয়েছি।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে মা বলে উঠলো “একটা ফোন তো অন্তত করবি মা।“
বলে চলে মেঘলা…
-মা তুমিও বলিহারি। একবারও বাপিকে বলোনি ঠাম্মিকে ফিরিয়ে আনতে। বাপি, আজ আমি একটা দিন বাড়ি ফিরিনি তাতেই তোমাদের এত চিন্তা, এত কষ্ট, নিজের মায়ের কথা যদি একটু ভাবতে তাহলে বুঝতে পারতে ঠাম্মি কি করে এতগুলো বছর অনাহারে, অনিদ্রায় কিভাবে কাটিয়েছে তাও নিজের সন্তান, নাতি নাতনিদের ছেড়ে। তাই তোমাদেরকেও একটু বোঝানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো, ফোন করে খবর না দেওয়ার এটাও একটা কারণ। আজ থেকে ঠাম্মি এখানেই থাকবে বাপি। আমার সাথে।
সারা ঘরে একরাশ নীরবতা। কেউ কোন রকম প্রতিবাদ করতে সাহস পেলো না। তাদেরও বয়স হচ্ছে। কে জানে তাদের এই দিন দেখতে হবে কিনা। দুঃখ, দৈন্যতা, একাকীত্ব, শেষ জীবনের এমন সঙ্গী কজন ভাবতে সাহস পাবে।
এদিকে তিন্নি একমনে ঠাম্মির ইনস্ট্রাকশন মেনে তার তার পিঠ চুলকে চলেছে,
ডানদিক, ডানদিক, ডানদিক আর একটু নীচে নীচে। আহা আহা আহ…পরম শান্তিতে ঠাম্মি চৌকির ওপর পা দু’টো ছড়িয়ে সব কিছু ফিরে পাওয়ার আনন্দে অঝোরে চোখের জল ফেলে চলেছে।। এ যেন আবার এক নতুন জন্মদিন, যেন নবজন্ম।
ধন্যবাদ আলাপীমন
দারুন একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া হলো গল্পের মধ্যে দিয়ে,খুব ভালো লাগলো
অনেক অনেক ধন্যবাদ