অজানা অভিশাপ (পর্ব -১)
-সুপর্ণা নাথ
পঁচিশ বছরের পুরনো কর্তাটি যদি আচমকা এক সুন্দর সকালে বলে,
– বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে নাও, গোয়া যাচ্ছি তাও পুরো তিন মাসের জন্য।
আনন্দের আগে চমকটাই লাগবে, তাই না? সাথে একটু আধটু বিষমও লাগতে পারে। আমারও তাই হলো। অবিশ্বাসের ঘোর কাটিয়ে উঠে পুরো বিষয়টা গুছিয়ে শুনেই প্রথম ফোন করলাম আমাদের একমাত্র মেয়ে তিয়াসকে, ও কাজের জন্য আপাতত ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা। শুনে বললো,
– ভাগ্গিস অনেকটা ছুটি বাঁচিয়ে ছিলাম মা, আমিও তোমাদের জয়েন করছি গোয়াতে। উফফ কি এক্সইটিং ব্যাপার!
এই অপ্রত্যাশিত আনন্দ যে সাথে এক অনির্বচনীয় বিভীষিকা বয়ে আনছে সেটা আমরা কেউ আঁচ করতে পারিনি। যে আতঙ্কের ছায়া হয়তো সারা জীবন আমাদের ধাওয়া করে বেড়াবে। এতকালের বিশ্বাস, যৌক্তিকতা, বোধ সব কিছুর ভিতকে নাড়িয়ে দেবে।
আমি তনুকা আর আমার কর্তা অরিন্দম, সে একটা বহুজাতিক ব্যাঙ্কে উঁচু পদে কর্মরত। আর সেই কাজেই তাকে গোয়ার নতুন ব্রাঞ্চে কিছুদিনের জন্য যেতে হচ্ছে। থাকার ব্যবস্থা অফিসই করে দেবে। সব কিছু ব্যবস্থা পাকা।
আমরা গোয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছলাম শেষ দুপুর তখন, অফিসের একজন হাতে অরিন্দমের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার সাথে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম, অরি বললো আমাদের গন্তব্য পানাজির Fontainhas, এটা নাকি গোয়ার খুব পুরোনো পর্তুগিজ প্রভাবিত অঞ্চল, ইংরেজদেরও আগে পর্তুগিজরা উপনিবেশ স্থাপন করে এখানে আর এই Fontainhas ছিল তাদের বিশেষ প্রিয়। আমাদের যে ছেলেটি নিতে এসেছিল সে বেশ মিশুকে আর সপ্রতিভ, নাম অদ্রিয়ানো বয়স তেইশ-চব্বিশ হবে।
সে গরগর করে তাদের তথা গোয়ার ইতিহাস বলে গেলো, জানলাম সে নিজেও পর্তুগিজদের শোনিত বাহক। তার পূর্বপুরুষ এক জাহাজের কর্মচারী ছিল। গোয়াতে আসে কাজের সূত্রে কিন্তু তখন পর্তুগিজদের রমরমা এখানে, ইংরেজরা তখন জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। এখানেই এক ভূমি কন্যার সাথে ঘর বাঁধে সে। পরের প্রজন্ম এটাকেই তাদের নিজের দেশ বলে আপন করে নিয়েছে। অদ্রিয়ানো আরো বললো আমাদের গন্তব্য যে Fontainhas সেটা আসলে এক লাতিন প্রভাবিত অংশ, এখন হেরিটেজ সাইটের তকমাও পেয়ে গেছে। 1770 খ্রিস্টাব্দে Antonio Joao de Sequeira যিনি কিনা আদতে গোয়ান, Mozambique এ ব্যবসাসূত্রে ছিলেন বহুকাল এবং সেখান থেকে প্রচুর আয় করে দেশে ফিরে এই Fontainhas জনপদটি স্থাপন করেন হুবহু পর্তুগিজ শহরের ধাঁচে। অদ্রিয়ানোর কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কোথায় যেন পড়েছিলাম ঐতিহাসিক William Dalrymple এর উক্তিটি
Fontainhas is ” a small chunk of Portugal washed up on the shores of the Indian Ocean”
গল্প, কথা আর ইতিহাস শুনতে শুনতে কখন যে এক ঘন্টা কেটে গেছে খেয়াল করিনি।
Fontainhas এ পৌঁছে অদ্রিয়ানো গাড়িটা থামালো। অরি বললো,
– এখানেই কি?
– না sir, অফিস আপনাদের জন্য যে বাংলোর ব্যবস্থা করেছে সেটা আর একটু উপরে, এটা তো আল্টিন্হ হিলের পাদদেশ, বাংলোটা হিলের উপরে, চলুন না দেখে মনে ভরে যাবে।
আমি গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললাম
– তুমি এখানে থামালে কেন তাহলে?
– ম্যাডাম, আজ তো মেইডকে পাবেন না, সে কাল থেকে আসবে আর বুড়ো দারোয়ানটা কোনো কাজের নয়, না চোখে দেখে না কানে শোনে। তাই আপনাদের জন্য কিছু খাবার আর ফ্রুটস নিয়ে নেব।
মনে ভাবলাম, সত্যি খুব গুছানো ছেলে আর খুব আন্তরিক। বেশ ভালো লেগে গেলো ওকে। হয়তো বাৎসল্য, তিয়াসের কাছাকাছি বয়স ওর। ও বললো
– ম্যাডাম, একটু ঘুরে দেখুন না, জায়গাটা সত্যি দারুণ।
– আজ না, একটু জেট ল্যাগ লাগছে।
– ঠিক আছে, আমি সামনের উইক এন্ডে আপনাদের গাইড হয়ে পুরো Fontainhas ঘুরিয়ে দেখাবো।
পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গাড়ির উঠতে একটু সময় বেশি লাগে, প্রায় মিনিট দশ পর আমাদের বাংলোর সামনে গাড়ি দাঁড়ালো। টিপিক্যাল পর্তুগিজ আর্কিটেকচার। উজ্জ্বল মেটে হলুদ রং এর দেওয়াল, দোতলা বাড়ি মাথার উপর লাল টালি। জানলায় সান শেড নেই, রট আয়রনের রেলিং ঘেরা ব্যালকনিগুলো যেন দেয়াল থেকে এগিয়ে বাইরের দিকে বেরোনো (protrudind out)।
তবে এতক্ষণ পাহাড়ি রাস্তায় ওঠার সময় বেশ ঘিঞ্জি শহর দেখছিলাম, সব বাড়িগুলোই পর্তুগিজ স্টাইলের, হলুদ, নীল বা সবুজ দেয়াল, বাউন্ডারি ঘেরা, সাথে গাছগাছালিও আছে। কিন্তু ওপরে ওঠার সাথে সাথে বসতি পাতলা হয়েছে। এখানে দূরে আর একটা নীল বাড়ি ছাড়া অন্য বাড়ি চোখে পড়লো না। আমাদের বাড়ির চারদিকে বেশ বড় লন আর বেশ কিছু ফুলের গাছ সাথে দু’টো কাজুবাদাম গাছ আর একটা লেবু (লেমন ) গাছ। পুরোটাই কাঠের তক্তার বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে ফ্রন্ট পর্চে সাদা রং করা লোহার চারটি চেয়ার আর একটা টেবিল। এ যেন গল্পে পড়া অন্য কোনো দেশ! মাথার উপর আকাশটাও অদ্ভুত নীল। মনটা সত্যি খুব ভালো হয়ে গেলো। শুধু মনে হচ্ছে তিয়াস কবে আসবে, ও বরাবরই পাহাড় ভালোবাসে।
অদ্রিয়ানো নিপুণ ভাবে বুড়ো দারোয়ানকে সব বুঝিয়ে দিলো আর চটপট আমাদের জিনিসপত্রগুলোও গুছিয়ে দিলো, কাজের ছেলে। আমাকে পুরো বাড়ি দেখিয়ে চাবি বুঝিয়ে চলে গেলো, কাল সকালেই মেইডকে নিয়ে আসবে কথা দিয়ে গেলো।
আমরা ফ্রেশ হয়ে এসে গরম কফি, কুকিজ সহযোগে উদর্পূর্তী করলাম। অরিন্দম এসেই অফিসের কাজে লেগে গেছে স্কাইপে কথা বলছে অফিসের কারো সাথে। ওকে আর ডিসটার্ব করলাম না। বাড়িটা আরো একবার ঘুরে দেখলাম। নীচে গেস্ট রুম, কিচেন, ড্রইং এন্ড ডাইনিং আর উপরে দু’টো বড় বেড রুম আর একটা বসার ঘর আছে। দু’টো ঘরের ব্যালকনি দিয়েই পাহাড়ের চূড়ার দিক দেখা যায় আর একটা সরু রুপালি রেখা চোখে পড়ে, পাহাড়ি ঝর্ণার জন্যই নাকি এই জনপদের নাম Fontainhas, পর্তুগিজে এর মানে “Little Fountain” মনে ভাবলাম আজন্ম কলকাতার ব্যস্ততায় অভ্যস্ত চোখ আর মন যেন স্বস্তির অবকাশ পেয়েছে। চারিদিকটা কেমন নিস্তব্ধ তবে প্রকৃতির নিস্তব্ধতারও কি সুন্দর একটা সুর থাকে ভাষা থাকে। নাম না জানা পাখির ডাক, গাছের পাতার শিরশিরানি, খুব ক্ষীণ ঝর্ণার শব্দ সব মিলে এক অদ্ভুত বাঙ্ময় নীরবতা সৃস্টি করেছে!
আমাদের বেডরুমটা মোটামুটি গুছিয়ে ফেললাম। পাহাড়ে সন্ধ্যে যেন ঝুপ করে নেমে আসে। ব্যালকনি সংলগ্ন দরজাটা পুরো কাঁচের, কাঁচের ওপারে জমাট কালো অন্ধকার, বসতি নেই তাই আলোর রেখাও নেই। অন্ধকারটা যেন কেমন অস্বস্তিকর। পরক্ষণে নিজেরই হাসি পেলো, জায়গাটা নতুন আর পরিবেশটাও অন্য রকম তাই একটু অস্বস্তি হওয়া তো স্বাভাবিক। ভারী মোটা পর্দাটা টেনে দিলাম। ব্যাস সব অস্বস্তি গায়েব। নিচে গিয়ে দেখলাম দারোয়ান বসে ঝিমোচ্ছে, বেচারা বুড়ো মানুষ, শক্তি সামর্থ নেই তবু পেটের দায়ে … তাকে জাগাতে আর মন চাইলো না।
আর অরিন্দম গেস্ট রুমটাকেই আপাতত তার হোম অফিসে পরিণত করেছে, আর এক প্রস্থ কফি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করার জন্য দরজা দিয়ে গলা বাড়ালাম, দেখলাম বর মশাই তার কোনো এক সাবোর্ডিনেটকে খুব বকাঝকা করছে ফোনে। চুপচাপ সরে এলাম, এই মানুষটা কাজ পেলে বিশ্ব সংসার ভুলে যায়। আমার আসার শব্দে বুড়ো দারোয়ান জেগে উঠেছে , ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো, কি লাগবে আমার? তাকে বাঁধা দিয়ে কিচেনে গেলাম, বুঝলাম তিন মাসের সংসার হলেও কালই কোমর বেঁধে লাগতে হবে। তিন কাপ কফি বানিয়ে নিলাম। দারওয়ানজিকে দিলাম, এক কাপ কফি যে কারো চোখে এত আনন্দ আর আপ্লুত ভাব আনতে পারে জানতাম না।
অরিন্দমের কাপটা ইচ্ছে করেই ওর সামনে ঠক করে রাখলাম যাতে সে বুঝতে পারে যে এসে থেকেই কাজে লেগে পড়াতে আমি মোটেও খুশি না।
– কাপ প্লেটের উপর রাগটা নাই দেখালে, চলো আমার কাজ শেষ, এখন আমি আপনার সেবাদাস ম্যাডাম।
– থাক হয়েছে, অতো সেবা আমার সইবে না, তুমি বরং তিয়াসকে ভিডিও কল করো তো। ও এতক্ষণে ফিরে এসেছে অফিস থেকে ।
কফি খেতে খেতে কর্তা গিন্নি অনেকক্ষণ মেয়ের সাথে আড্ডা দিলাম। ও বললো আগামী পরশু এসে যাবে। পুরো তিন সপ্তাহের ছুটি চেষ্টা করছে যাতে আরো কয়েকদিন ম্যানেজ করতে পারে। খুব খুশি ও।
রাতের দিকে দারোয়ানজি বললো, রাতের খাবার তৈরি। অদ্রিয়ানো নাকি তার বাড়ি থেকে খাবার দিয়ে গেছে, কোন ফাঁকে এলো ছেলেটা বুঝতেই পারিনি! রুটি আর গরম চিকেন কারি খেয়ে নিলাম। খাওয়া মিটিয়ে দারোয়ান তার আউট হাউসে চলে গেলো। সারাদিনের ক্লান্তি চোখে ঘুম নেমে আসতে দেরি হলো না।
রাত তখন কত জানি না, হঠাৎ মনে হলো চোখের উপর জোরালো কোনো আলো পড়ছে, চোখ বন্ধ থাকলেও চোখের উপর আলো পড়লে একটা অনুভুতি হয়, আমার ঘুম বরাবরই পাতলা। ঘুম ভেঙে জাগতেই, মনে হলো ব্যালকনির কাঁচের উপর কোনো আলো পড়েছে সেটা মুহূর্তে নিভে গেলো, চোখে ঘুম ছিল তাই অতো তোয়াক্কা না করেই আবার ঘুমালাম, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণের জন্য না। আবারও সেই এক অনুভূতি! এবার সত্যি ঘুমের ঘোরটা কেটে গেছে, মাথায় এলো অতো মোটা ভারী পর্দা ভেদ করে আলো আসবে কি করে? বেড সাইড টেবিলের ল্যাম্পটা জ্বেলে নেমে দেখলাম পর্দাটা বেশ অনেকটা সরে গেছে! অরিন্দমকে ডাকলাম, ও চোখ না খুলেই বললো
– আরে ও কিছু না, পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বড় কোনো গাড়ি নামছিল হয়তো তারই হেডলাইটের আলো এসে পড়েছে কোনো ভাবে কাঁচের উপর।
আমার মনের খুঁতখুতুনি রয়েই গেলো, সারা সন্ধ্যে কি একটাও গাড়ি ওই রাস্তায় যায়নি! কৈ কোনো আলোর রেখা তো দেখিনি! বাকি রাতটা ঘুমালাম তবে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম। সকালের আলোতে রাতের সব দুশ্চিন্তা মুহূর্তে হারিয়ে যায়। সাত সকালে হৈ চৈ করে অদ্রিয়ানো বাড়ি মাথায় করেছে। ভোর বেলাতেই সে এক গাদা বাজার করে এনেছে সাথে একটা অল্প বয়সী মেয়ে, আজ থেকে আমাকে সাহায্য করবে। ওর নাম মারিয়ানা। একটু চুপচাপ, ইংরেজিতে অতো সরগর না তবে কাজ চলা হিন্দি বলে, এখানকার বেশিরভাগ মানুষ এখনো পর্তুগিজ ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ। অদ্রিয়ানো ওকে বললো চটপট কাজে লেগে যেতে বললো। আমাদের কফি দিয়ে সে ব্রেকফাস্ট বানাতে গেলো।
খাবার টেবিলে নানা বিষয় কথা হচ্ছিল। অদ্রিয়ানো একটা চাবির গোছা অরিন্দমকে দিয়ে বলল,
– Sir, আপনাদের সুবিধের জন্য এই গাড়িটা আজ থেকে এখানেই থাকবে। যদি ড্রাইভার লাগে অফিস সেটাও দিয়ে দেবে।
আমি বললাম,
– আমরা দুজনেই ড্রাইভিং জানি তাই ড্রাইভারের দরকার নেই। আর হাতের কাছেই তো সব একটু আধটু হাঁটাও ভালো।
– ওকে ম্যাডাম। তাও যদি কখনো দরকার হয় আমাকে একটু জানাবেন আমি চলে আসব।
– বেশ জানাবো (হাসি মুখে বললাম), আচ্ছা অদ্রিয়ানো, আমাদের বাড়ির পিছন দিকে মানে যেদিকে ঝর্ণা ওদিকের রাস্তা দিয়ে রাতে খুব গাড়ি যাতায়াত করে না? সারাদিনে তো তেমন কিছু…
আমার কথা মাঝখানে থামিয়ে ও বলল,
– ওদিকে তো রাস্তাই নেই ম্যাডাম! গাড়ি কি করে আসবে?
রাস্তা তো আপনাদের বাংলোর সামনে দিয়ে গিয়ে আরো পূর্ব দিকে চলে গেছে আর এরপর তো তেমন বাড়িও নেই আবার পাহাড়ের পুব দিকের ঢালে বস্তি আছে। এদিকটা খুব posh অঞ্চল কিন্তু পাহাড়ের পুবের ঢালটা একটু নিম্নবিত্ত মানুষদের বসতি।
– ও আচ্ছা
– কেন ম্যাডাম, কি হয়েছে?
অরিন্দম কথাটা ঘুরিয়ে দিলো, অফিসের কি সব কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো, আমিও আর কথা বাড়ালাম না।
উপরে চলে এলাম, বাড়ির সামনেও একটা ব্যালকনি আছে, ওখান থেকে নিচের বাজার এলাকার কিছুটা আর আল্টিহ্ন ( Altinho) হিলের গায়ের রঙচঙে বাড়ি আর রাস্তাঘাট কিছুটা দেখা যায়, ব্যস্ত জীবনের চেনা ছবি। দেখলাম অদ্রিয়ানো বেরিয়ে যাচ্ছে আর মারিয়ানা তার পেছনে ছুটে গেলো, সে হাত মাথা নেড়ে তাদের ভাষায় কি সব বলছে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মনে হচ্ছে সে ভারী বিরক্ত আর অস্বস্তিতে আছে। চোখে মুখে উদ্বিগ্ন ভাব। অদ্রিয়ানো তাকে কিছু বোঝাচ্ছে। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে ও হন হন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো, আর মারিয়ানা ব্যাজার মুখে বাড়ি ঢুকলো। নতুন এসেছে তাই এখনই কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক মনে হলো না।
একটু বেলার দিকে অরি বেরিয়ে গেলো অফিসে আর আমার সারাদিনটা প্রচুর ব্যস্ততায় কাটলো। মারিয়ানা ধীরে ধীরে অনেকটা সাবলীল হয়ে গেছে, কথা কম বলে কিন্তু বেশ কাজের আর হাসিখুশি, কিছু টুকটাক কেনাকাটার ছিল, ওকে সঙ্গে নিয়ে নিচের বাজারে গেলাম, আমাকে নতুন দেখে পাছে কেউ ঠকায় তাই মারিয়ানাই দেখে শুনে গুছিয়ে কেনাকাটা করলো, বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে হলো। আজ ও এখানেই থেকে যাবে তবে কাল থেকে সন্ধ্যেবেলা ফিরে যাবে, তেমনটাই ঠিক হয়ে আছে। তিয়াসের ঘর সাজানোর কিছু জিনিস কিনেছি সাথে সুন্দর আসমানী পর্দা। ওর পছন্দের রং। আমি রান্না ঘরে কিছু কাজ করছিলাম, অরি জানিয়েছে ওর ফিরতে দেরি হবে। আমি মারিয়ানাকে বললাম,
– উপরের আমাদের পাশের বেড রুমে পর্দাগুলো লাগিয়ে দেবে। তারপর একটু কিচেনে এসে হেল্প করবে।
বেশ অনেকটা সময় কেটে যেতেও ও ফিরছে না দেখে আমি ওকে ডাক দিলাম, কোনো উত্তর নেই। আশ্চর্য! আমি ওকে ডাকতে ডাকতে উপরে উঠে দেখি ফ্যাকাশে মুখে হাতে পর্দা নিয়ে ঘরের দরজাতে দাঁড়িয়ে, আমি আবার ডাকলাম, কোনো সাড়া নেই। মুখ পুরো সাদা, চোখ বিস্ফোরিত, চেয়ে আছে ব্যালকনির কাঁচের দরজার দিকে। আমি ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ওর যেন সাড় ফিরলো, আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ম্যাডাম এ ঘরটাতে আমি একা যাবো না,
– কেন?
– ওই অন্ধকার …. না মানে আমি সব কাজ করবো ম্যাডাম শুধু এখানে যেতে বলবেন না প্লিজ।
কথার মাঝেই শুনলাম, পুরোনো লোহার দরজার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ আর গাড়ির শব্দ। অরি ফিরলো। আমি নিচে এলাম পেছন পেছন মারিয়ানাও নেমে এলো। দেখলাম অদ্রিয়ানো এক বোঝা ফাইল নিয়ে অরির পেছনে আসছে। অরি ফ্রেশ হতে গেলো। মারিয়ানা জলখাবার তোড়জোড় করছে।
– আচ্ছা অদ্রিয়ানো, মারিয়ানা কি এখানে অনিচ্ছাতে কাজে এসেছে?
– কেন ম্যাডাম কি বলেছে ও?
আমি সকালের ওদের কথোপকথন আর একটু আগের ঘটনাটা বললাম। ও হা হা করে হেসে মারিয়ানাকে শুনিয়ে জোরে জোরে বললো,
– ও একটা ভিতুর ডিম ম্যাডাম, অন্ধকার হলেই ওর চারপাশে ও ভুত দেখতে পায়। ব্যালকনিতে অন্ধকার দেখেছে ব্যাস আর দেখে কে। ওর এমন অনেক ভুত দেখার গল্প সব্বাই জানে। এরজন্য দায়ী ওর গ্রানি সারাক্ষণ বুড়ি খালি ভুত পিশাচ আর উইচদের গল্প শোনাত তাই ও ওই সব শিখেছে। বুঝলেন ম্যাডাম লেখা পড়ায় ফাঁকি দিলে যা হয় আর কি (মিচকে হেসে বললো)।
মারিআনা কটমট করে ওর দিকে তাকাচ্ছে।
আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু ভীষণ মারাত্মক কিছু একটা যে আমাদের ভবিতব্যে লুকিয়ে আছে তা তখনও জানতাম না ।