প্রশান্তি
-পরিতোষ ভৌমিক
শহরের বিকেল আমাদের গ্রামের মতো হয় না। শুধু লম্বা লম্বা ছায়া। ইট পাথরের গাঁয়ের গরম যেন গাঁয়ে লাগে। এমন হেমন্তে আমাদের গ্রামের মাঠের পাশে গেলেই একটা সোনালী পরত পড়ে চোখে। আমার ছোট ভাইটার জন্মের আগের দিন মাকে যেমন দেখেছিলেম, গর্বে ভরা অভিজাত চেহারায়; ঠিক তেমন লাগে ধান ক্ষেতগুলোকে। হৃদয় জুড়িয়ে যায়, বাতাসে দোল খেলে পাকা ধানের একটা ঝনঝন শব্দ কানে ভাসে। যেন কিষাণী মনের সুখে গাইছে আর রাতের আন্ধকারে জোনাকি পোকার মেলায় ধান সিদ্ধ করছে। সিদ্ধ ধানের একটা অন্যরকম গন্ধ আছে, যেন নেশা নেশা লাগে। কিন্তু শহরে এসব ভেবে লাভ নেই। আমি আর ত্রিদিব দু’জনেই এখন শহরের মানুষ। তবে এই নষ্টালজিয়ার জন্য সব সময়ই আমাকে অনুযোগ পেতে হয়। তবুও গ্রামের টান আমি ছাড়তে পারি না, আর পারি না বলেই এই সুন্দর বিকেলে যখন আমরা দু’জন আজকে আমাদের শত ব্যাস্ততার মধ্যেও একটু ছাড়া পেয়ে সন্ধ্যাটা গতানুগতিকতার বাইরে অন্য রকম ভাবে কাটানোর পরিকল্পনায় আমাদের অস্থায়ী হলেও বেশ কয়েক বছরের স্থায়ী ঠিকানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন এই সব নষ্টালজিয়ার কথা যদি ত্রিদিব জানে তবে আর রক্ষে নেই। আজকের বেশীর ভাগ খরচের দায় দায়িত্ব সে নিজে নিয়েছে, যদিও দু’জনের কামাই রোজগার মোটামোটি একই রকম তবুও আমার অভাবটা একটু বেশী । কেননা অল্প বয়সেই বিয়ে শাদী করে একেবারে দুই সন্তানের পিতা আর ত্রিদিব ! এখনো স্বপ্ন দেখে, কলেজের হিমাগ্নীর মতো একটা মেয়ে না পেলে হয়তো তার জীবনে আর বিয়ে করে সংসার গড়ার স্বপ্ন পূরন হবে না । হিমাগ্নী আমাদের কলেজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী, দেখতে মোটেই রূপসী ছিলনা কিন্তু গানের গলা ছিল অসাধারন , নিজের লেখা কবিতা নিজে আবৃত্তি করতো । সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম, অন্য আরো বেশ কিছু ছেলেদের মতো ত্রিদিবও তাকে ভালবাসত কিন্তু প্রস্তাবটা পাঠাতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল । যেদিন দেখা করে মনের কথা জানিয়েছিল তার আগের দিন হিমাগ্নীর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেছিল । সেকারনেই এখনো মাঝে মধ্যে এই অবসরের দিন গুলোতে যখন একটু বেশী খরচা পাতির কথা ভাবি তখনই ত্রিদিব নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দেয় । আজকেও দুজনে ইট পাথরের গরম হাওয়া ঠেলে যখন ঘড়ের দিকে যাচ্ছিলাম, আমি আমার অবচেতন মনেই পশ্চিমের লাল সূর্যটাকে খুঁজতে খুঁজতে একসময় যখন একটু পিছিয়ে পড়লাম, হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি ত্রিদিব একটি থামানো অভিজাত প্রাইভেট গাড়ির চালিকার সঙ্গে কথা বলছে । দু একবার না বলেছে, আমি আপনাকে চিনিনা’ এই কথাগুলোও আমার কানে পৌঁচেছে কিন্তু তার পরেও দেখলাম গাড়ির সামনের দড়জাটা খুলে একটা হাত ত্রিদিবের হাতে টান দিয়ে গাড়িতে তুলে নিল । আমি কিছু বলার সাহস বা ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না । কেননা যে হাতটা ত্রিদিবকে আহ্বান করছিল সে হাতটা আর দশটা সাধারন হাতের মতো নয় । যেন স্বপ্নের রাজকুমারীর হাত, সাদা রং দেখেই বুজা যায় এ বড় লাস্যময়ীর হাত । হাতের অলঙ্কারের বাহার দেখেই বুজা গেছে রাজরানীর মতোই তার পরিধান । এ কোন সন্ত্রাস বাদী বা ছিনতাইকারীর হাত হতে পারে না । আমি পা চালিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে গাড়ির কালো গ্লাস উঠে গেছে, ত্রিদিব হাত দিয়ে আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছিল আমি বুজতে পারিনি । আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে ডায়াল করলাম, সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হল, আমি আসছি বলতে বলতেই লাইনটা কেটে গেল, তার পরে স্যুইচ অফ । কিছু বুজে উঠতে পারলাম না একটা অজানা উৎকণ্ঠায় পথ চলতে শুরু করলাম । তবে নিজে নিজে এটুকু ধারনা করতে পারলাম কোন বিপদ নয়, দেখা যাক । না বেশীক্ষণ উৎকণ্ঠায় থাকতে হল না , পাঁচ সাত মিনিট পরেই ত্রিদিব আমায় ফোন করে জানিয়ে দিল, চিন্তা করার কিছু নেই ঘণ্টা খানেক পরেই ফিরে আসবে সে, আমি যেন ঘরে চলে যাই ।
চিলি চিকেনটা আমি ভালো বানাই বলে এই কাজটা আমাকেই করতে হয় সব সময় , তাই বেশী কিছু চিন্তা না করে বাজার থেকে আনা পণ্য সামগ্রীর যথাযথ ব্যাবহার করে চিলি চিকেন তৈরীর দিকে মন দিলাম, মাঝে মধ্যে একটু বিরক্তি আসছিল বটে আবার উৎকণ্ঠার ভাবটাও মাথাচারা দিচ্ছিল । এভাবেই দেখতে দেখতে প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে বাবু এল , একে বারে হেলতে দুলতে, অবসন্ন একটা দেহ নিয়ে । যেন কোন রকমে দেহটাকে বিছানায় এনে রাখল । আমার শত সহস্র প্রশ্নের পরে, ত্রিদিব বিরক্তির স্বরে উত্তর দিল, তর সইছেনা কেন রা ! আমি তো এসে গেছি, তুই খেয়ে নে, আমার আর আজকে কিছু লাগবে না, যা পেয়েছি, খুব খুব, খাওয়া দাওয়া, সুখ আহ্লাদ, টাকা পয়সা যথেষ্ট যথেষ্ট । আমি ঘুমাই, একদম ডিষ্টার্ব করবি না । সকালে জাগতে দেরী হলে জাগাবি না, আমি হয়ত আর এই চাকরি করব না , করতে হবে না ।
আমি কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না, কিন্তু আন্দাজ করতে পারলাম অনেক কিছু । শহরের অভিজ্ঞতা দিয়ে যতটা ঠাহর করতে পারলাম, তার পরে ত্রিদিবকে আর আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলাম না , নিজে নিজে রাতের খাবার সেরে বাড়িতে স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আলাপ সেরে ফোনটা চার্জে লাগিয়ে দিলাম, কেননা রাতের বেলা চার্জ ঠিক মত না হলে আগামীকালের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে । বিছানায় যেতে যেতে এক বার ত্রিদিবের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম, উপড়ে ফ্যান চলছে, তবুও তার চেহারায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, চেহারার মধ্যে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও একটা মিষ্টি প্রশান্তির ছায়া যেন পরে আছে মুখটার উপর । আমি ঘুমিয়ে পড়লাম ।