তানপুরা
– পারমিতা চ্যাটার্জী
বহুদিনের পুরানো বাসস্থান বদল হচ্ছে, সমরের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে, কত পুরানো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাসায়, আজ তা ভেসে উঠছে বুকের মধ্যে, অথচ সেই মানুষটা নীরবে এই বাসাটাকে বাঁচাবার জন্য যখন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যেত তখন এর কোন দাম দেননি, উল্টে কত বিদ্রুপ করে গেছেন। আজ চোখের জলটা যেন নিজের কাছেই নোনতা লাগছে।
কিছু বলছেন না তিনি চুপ করে দেখে যাচ্ছেন। ছেলে প্রদীপ আর বউমা কমলিকা সব পুরানো জিনিষগুলো বাতিল করে দিচ্ছে, তাদের নতুন সাজানো ফ্ল্যাটে এগুলো খুবই বেমানান হবে না কি! আজকালকার ছেলেমেয়ে কিছু বলার উপায় নেই, এতো আর জয়া নয় যে শাশুড়ির হাজার গঞ্জনা সহ্য করেও গানের টিউশনের পয়সা দিয়ে শাশুড়ির হাঁপানির ওষুধ কিনে আনবে।
প্রদীপ জিনিষগুলো এক ধার থেকে বাতিল করতে করতে এসে থমকে দাঁড়ালো মায়ের তানপুরাটার কাছে এসে। মনে পড়ে গেল তার বড় টিপ পরা সুন্দরী মায়ের মুখখানা, এই তানপুরা বাজিয়ে মা সেদিন জীবনের শেষ গানটা গেয়েছিলেন, ‘যখন জমবে ধূলা তানপুরাটার তার গলায়, তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে…’ শরীরটা খারাপ থাকায় মা সেদিন বিকেল বেলায় ছাত্রছাত্রীদের বাড়ীতে ডেকে ছিলেন, বাবা অফিস থেকে ফেরার আগেই যাতে ক্লাস নেওয়া হয়ে যায়, সেই বাবা তাড়াতাড়ি সেদিন বাড়ী ফিরলেন আর মায়ের ক্লাস দেখেই চিৎকার করে বলে উঠলেন- এখন দেখছি বাড়ীতেও গানের অত্যাচার আরম্ভ হল। মাকে সেদিন খুব ক্লান্ত লাগছিল, ছাত্রদের ছুটি দিয়ে বাইরে এসে বললেন এই গানটা আমি সখ করে শেখাই না।
– কেন আমি কি রোজগার করিনা না কি?
– হ্যাঁ, তাতে শুধু ডালভাতের খরচটুকু আর বাড়ীভাড়াটা আসে, আর ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজের পড়ার তাদের টিউশন তোমার মায়ের ওষুধের খরচ সব এই গান শিখিয়ে আসে, একটা কাজের লোক পর্যন্ত রাখতে পারিনা, সমস্ত কাজ নিজে হাতে করি এই শরীর নিয়ে সে খবর রাখো কখনও? ওইটুকু কথা বলতেই মা কেমন হাঁপিয়ে পড়লেন আর ঘামতে শুরু করলেন। প্রদীপ মাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে বাবাকে বলল- কখনও কি একটা ভালো কথা বলতে পারোনা? যে মানুষটা সকাল থেকে রাত অবধি নিরলস পরিশ্রম করে যায় তার কি কিছুই পাওনা নেই? আর তোমাকেও বলি মা কতবার বলেছি একটা কাজের লোক রাখি, আমি টিউশন করি তুমি রাজি হওনি খালি একটা কথা বলে যাও তোরা শুধু ভালোভাবে দাঁড়া তাহলেই আমার সব পাওয়া হবে। যাক আর তোমার কষ্ট করতে হবেনা আমি চাকরী পেয়ে গেলাম, বলে প্রদীপ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা মায়ের পায়ের কাছে রাখল। মা প্রদীপের মাথাটা নিজের কোলে টেনে নিয়েছিলেন। প্রদীপ মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বলল, আমার এই ভালো চাকরী পাওয়ার পেছনে তোমার অনেক শ্রম আর ঘাম আছে মা, আর গান শিখিয়ে আমাদের শিক্ষিত করে তুলেছিলে বলে সংসার তোমায় দিয়েছে অনেক অপমান আর লাঞ্ছনা। আমি তোমায় কথা দিলাম মা তোমার সব অপমানের জবাব আমি দেব। মা হাতের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে বলেছিলেন- মিষ্টি কিনে আন বাবা এতোবড় সুখবর, আর আসার সময় তোর ঠাকুমার হাঁপের ওষুধটাও নিয়ে আসিস।
প্রদীপ ভাবছিল মা শুধু দিয়েই গেলেন কিছু পাবার সুযোগ দিলেন না। সেই রাতেই মায়ের প্রচণ্ড বুকে ব্যথা আরম্ভ হল, বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন- তাড়াতাড়ি একটা ডাক্তার ডাক বাবু তোর মা কেমন করছে, ডাক্তার আসতে আসতেই সব শেষ হয়ে গেল।
প্রদীপ খুব যত্ন নিয়ে তানপুরার ধূলাগুলো ঝাড়ছিল আর তার দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে, আর মনে হচ্ছিল মা কেন শেষদিন ওই গানটা শেখাচ্ছিলেন, ‘যখন জমবে ধূলা তানপুরাটার তার গুলায় তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে’।
হঠাৎ কাঁধে কার হাতের স্পর্শে প্রদীপ চমকে তাকালো, দেখল স্ত্রী কমলিকা এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে বাবা, প্রদীপ জলভরা চোখে স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, আর কিছু নয় শুধু এই তানপুরাটা নিয়ে যাবো।