অশুভ যাত্রা
– বিশ্বদীপ মুখার্জী
খবরের কাগজে প্রকাশিত রাশিফলে আমার বিশ্বাস নেই। তাও অভ্যাসবশত রোজ একবার দেখেই নিই। আজ সকালে উঠে দেখলাম আমার রাশির নিচে লেখা আছে- যাত্রা শুভ নয়। এক্ষেত্রে বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাসের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, আজ আমাকে বেরোতেই হবে। অফিসের কাজে যেতে হবে ভুবনেশ্বর। রাতের ট্রেনে টিকিট, হাওড়া থেকে। তবে যাত্রার বিষয় কোনও অশুভ খবর যদি শুনে বা পড়ে নেওয়া হয়, তাহলে মনটা খুঁতখুঁত করে বৈকি। আমারও করছিল। কিন্তু আমি নিরুপায়। আমাকে যেতেই হবে।
সারা দিন কাজের ব্যস্ততার মাঝে সকালে পড়া খবরের বিষয় বেমালুম ভুলে গেলাম। সন্ধ্যাতে বাড়ি ফিরে, ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলাম হাওড়া স্টেশনের দিকে। থার্ড এ.সি-তে টিকিট ছিল। গিয়ে বসে পড়লাম নিজের সিটে। আশেপাশের সহযাত্রীদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম একবার। যথা সময় ট্রেন ছাড়লো। শুতে এখনও প্রায় ঘন্টা খানেক দেরি। তাই সময় কাটানোর জন্য একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
তখন হয়তো প্রায় মধ্যরাত। আমি শুয়েছিলাম আপার বার্থে। বিকট ঝাঁকুনি এবং বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। ঝাঁকুনির কারণে আপার বার্থ থেকে সজোরে পড়লাম নিচে এসে। কপালে, হাতে, পায়ে যে আঘাত লাগলো সেটা বলাই বাহুল্য। যতক্ষণে নিজেকে সামলাবো, আরও দু’ চারজন পড়লো আমার ঘাড়ে এসে। কম্পার্টমেন্টে জ্বলছিল নাইট বাল্ব। তাই কে কোথায় আছে সেটা বোঝা কঠিন। মানুষের চিৎকার, কান্না ভেসে এলো কানে। আমার উপর যে দু’ তিনজন পড়েছিলেন তাদেরকে ঝাঁকিয়ে দেখলাম। কোনও সাড়া শব্দ পেলাম না। তারা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে, কি তাদের নিথর দেহকে আমি ঝাঁকিয়ে চলেছি, বুঝতে পারলাম না। বুঝবার মতো সময়ও ছিল না আমার কাছে। ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। শুধু অ্যাক্সিডেন্ট বললে ভুল বলা হবে, বিকট অ্যাক্সিডেন্ট। তাও আমি বেঁচে আছি? বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখলাম। না, আমি জীবিত, এখন পর্যন্ত মৃত্যু আমায় আলিঙ্গন করতে পারেনি। কপালের চোটটা বেশ গভীর, সেখান থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষয় হচ্ছে। তৎক্ষনাৎ প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালে বাঁধলাম। কোনও ক্রমে নিজের পিঠের ব্যাগ খোঁজার চেষ্টা করলাম। পেলাম না। যাক গে.. কী বা ছিল ওতে? কিছু জামা প্যান্ট আর কিছু টুকটাক জিনিস। প্রাণে বেঁচে গেছি, এটাই কি কম? কম্পার্টমেন্ট থেকে বাইরে বেরোবার জন্য জানালা ভাঙ্গতে হলো না। বেশ কিছু জানালার কাঁচ ভেঙ্গে প্রায় গুঁড়া হয়ে গেছে। ভাঙ্গা জানালা দিয়ে জীবিত লোকেরা বেরোচ্ছে বাইরে। তাদের মধ্যে বহুজনের কন্ঠে এখনও চিৎকার, আর্তনাদ। তাদের সাথে সাথে আমিও বাইরে বেরিয়ে এলাম। দু’ পাশে খোলা মাঠ, মাঝে পড়ে আছে লাইনচ্যুত আমাদের ট্রেন। সময় দেখবার জন্য প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করতে গেলাম। কিন্তু পেলাম না। মোবাইল হয়তো সেই কম্পার্টমেন্টেই পড়ে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিদ্যুৎ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইটের মতো এই বীভৎস দুর্ঘটনার ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমার চারিপাশে হাহুতাশ করা লোকেদের ভিড়। ঈশ্বরই জানেন কখন সাহায্যের হাত এগিয়ে আসবে এদের দিকে। এই খোলা মাঠে বেশিক্ষণ থাকাও যাবে না। যে কোনও মুহূর্তে ঝেঁপে বৃষ্টি নামতে পারে। কোনও আশ্রয়ের আশায় গুটিগুটি পায়ে আমি এগিয়ে গেলাম অজানা গন্তব্যের দিকে। কপালে বাঁধা রুমালটা এতক্ষণে রক্তে পুরো ভিজে গেছে। হাতে, পায়ে প্রচন্ড যন্ত্রণা, সাথে অল্প মাথাও ঘুরছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, তাও হেঁটে যাচ্ছি মনের জোরে। বেশ কিছুটা এগোবার পর ছোট এক ভাঙ্গা পোড়ো বাড়ি পেলাম। বিদ্যুতের আলোর কারণে বাড়িটা চোখে পড়লো আমার। সোজা এগিয়ে গেলাম সেই দিকে। মানুষ বলতে বাড়িতে কেউ নেই। কোনও রকম বিষাক্ত সরীসৃপ আছে কি না, সেটা বলা সম্ভব নয়। ঈশ্বরকে প্রার্থনা করলাম, এতবড় দুর্ঘটনার হাত থেকে যখন জীবন রক্ষা করেছ, তখন কোনও সরীসৃপের দংশনে প্রাণ নিও না। কোনও রকমে সেখানে বসে ভোরের অপেক্ষা করা শুরু করলাম।
ভোরের আলো যখন অল্প অল্প ফুটতে শুরু করেছে ঠিক তখনই নিজের পাশ থেকে একজনের গলার আওয়াজ পেলাম।
‘এত রাতে আপনি এই বাড়িটা খুঁজে পেলেন?’
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম। একজন এগিয়ে এলো আমার দিকে। দেখে মনে হলো বয়স আমারই মতো হবে। তবে মাথায় চুল কম, মুখটা একটু গোল। তারও মাথা ফাটা, অঝোরে রক্ত ঝরে যাচ্ছে সেখান থেকে। আমার পাশে এসে বসলো সে। আমায় বলল – ‘সারা রাত আমি খোলা মাঠেই বসে রইলাম। ভিজলাম বৃষ্টিতে।’
তার জমা কাপড় যে পুরো ভেজা সেটা আমি আগেই লক্ষ্য করেছিলাম।
আমি বললাম – ‘আকাশের অবস্থা দেখে বুঝে গিয়েছিলাম যে বৃষ্টি হবে। এক নিরাপদ আশ্রয় দরকার ছিল। তাই পায়ে ব্যথা নিয়েও কোনও রকমে এগিয়ে এলাম।’
‘আর নিরাপদ! কপাল যদি নিরাপদের মানে বুঝতো তাহলে এতবড় কান্ড ঘটতো না।’ ভদ্রলোক বললেন আমায়।
‘আপনি কপালে কিছু বাঁধেননি কেন? অনেক রক্ত বেরোচ্ছে তো।’
আমার কথায় মুচকি হেসে তিনি বললেন – ‘আপনি তো মাথায় রুমাল বেঁধে আছেন। তাও তো রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে।’
ঠিকই বলেছে সে। অনেক রক্ত বেরিয়েছে। শরীরটা খুবই দুর্বল লাগছে। কতক্ষণ এই অবস্থায় থাকতে পারবো জানি না। এত রক্ত বেরোবার পরেও আমি জ্ঞানহীন কেন হয়ে যাইনি সেটাই রহস্য।
সেই লোকটা বলল – ‘আমার নাম প্রভাত মাঝি। বাড়ি কোলকাতার শ্যামবাজারে। ভাড়া বাড়ি। বাড়িতে আমার বৌ আর দু’ বছরের এক ছেলে আছে। শ্যামবাজার পাঁচমাথা মোড়ে একটা বড় ওষুধের দোকান আছে, ‘নিউ লাইফ মেডিক্যাল হল’। সেখানেই সেলসম্যানের কাজ করি। এক দরকারি কাজে পুরী যাচ্ছিলাম। একাই। টিকিট পাইনি, তাই জেনারাল কম্পার্টমেন্টেই যাচ্ছিলাম। তারপর হঠাৎ এই ঘটনা ঘটে গেল।’
আমি বেশি কথা বলতে পারছিলাম না। শরীরটা খুবই দুর্বল লাগছিল। ডান দিকে ঘাড় ঘোরাতে দেখলাম, সারা মাঠে লোকে লোকারণ্য। আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকেরা চলে এসেছে। আলোও ফুটে গেছে বেশ ভালোই। বৃষ্টি থেমেছে ঠিকই, আকাশের মুখ কিন্তু এখনও ভার।
‘আসি আমি।’ কথাটা বলে প্রভাত বাবু চলে গেলেন।
কোথায় গেলেন সেটা খেয়াল করলাম না আমি। অতি শীঘ্রই আমার নিজের চিকিৎসার দরকার ছিল। কোনও ক্রমে এগোলাম মাঠের দিকে। ট্রেনের দুর্দশা দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল। বেশ কিছু কম্পার্টমেন্ট একে অপরের ঘাড়ে চড়ে আছে। কম্পার্টমেন্টের ভিতর থেকে মৃত দেহ বের করার কাজ চলছে। আশেপাশে বেশ কিছু অ্যাম্বুলেন্সও চোখে পড়লো আমার। হঠাৎ দেখলাম দু’ চারজন ছুটে এলো আমার দিকে।
‘আপনি এখানে কী করছেন। আপনার তো দেখছি ভালোই চোট লেগেছে। তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্সে উঠুন।’
আমাকে নিয়ে ওরা অ্যাম্বুলেন্সে ওঠাতে যাবে ঠিক সে সময় দেখলাম এক জেনারাল কম্পার্টমেন্ট থেকে বের করা হলো এক মৃত দেহকে। দূরত্ব আমার থেকে খুব বেশি হলে দশ হাত। মৃত দেহ দেখে আমি অবাক। মৃত দেহকে স্ট্রেচারে শুইয়ে আমার সামনে দিয়েই নিয়ে যাওয়া হলো। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম সে দিকে। এত…. এত…. প্রভাত মাঝি। শরীর এমনিতেই দুর্বল ছিল অত্যধিক রক্তক্ষয়ের কারণে, জ্ঞানশূন্য হওয়ার জন্য প্রভাত মাঝিকে মৃত অবস্থায় দেখাটা যথেষ্ট ছিল।
জ্ঞান ফিরল এক সরকারি হাসপাতালে। মাথায় পট্টি বাঁধা আমার। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলাম, সকাল দশটা বাজে। কিছু চিন্তা করার আগেই প্রভাত মাঝির চেহারাটা আমার মুখের সামনে ভেসে উঠল। জীবন্ত আর মৃত চেহারা। তাহলে কি প্রভাত মাঝি দুর্ঘটনার পরেই মারা গিয়েছিলেন? তাহলে আমার সাথে কথা বলল কে? কেই বা আমাকে তার ঠিকানাটা দিলো? হঠাৎ আমার শিড়দাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। যেটা আমি ভাবছি, সেটা কি সত্যি? সে নিজের ঠিকানা আমায় দিতে এসেছিল, যেন আমি তার মৃত্যুর খবর তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারি? আমিই কেন? সেখানে তো আরও অনেকেই ছিল। এই প্রশ্নের জবাব হয়তো আমি কোনও দিন পাবো না। কিন্তু শ্যামবাজারে আমি তার বাড়ি পাবো কী করে? হঠাৎ মনে পড়লো ‘নিউ লাইফ মেডিক্যাল হলে’র কথা। সেখানে খবর দিলে তার বাড়ির লোকেরা খবর পেয়ে যেতে পারে। না, আমাকে যেতেই হবে শ্যামবাজার।
কিছু অবাস্তব ঘটনা যখন নিজের সাথে ঘটে, তার রেশ প্রায় সারা জীবন থেকেই যায়। এই ঘটনাটা আমি হয়তো কোনও দিন ভুলবো না। এই দুর্ঘটনার ফলে খবরের কাগজে প্রকাশিত ‘রাশিফলে’ কিছুটা হলেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।
সমাপ্ত।