অজানা অভিশাপ (পর্ব-৪)
-সুপর্ণা নাথ
আমি জানি মারিয়ানা যা বলবে তা তিয়াসের শোনা উচিত না। আমি চোখের ইশারায় ওকে উপরে যেতে বললাম। ও বুঝে গেলো আমি কি চাই।
– মা এই কয়েকদিন বাড়িতে থেকে থেকে বোর লাগছে আর আমার ফোনটাও একটু প্রবলেম করছে, আমি নিচের মার্কেটে যাবো একটু? লাঞ্চটা বাইরেই করে নেব। ফোনটাও ঠিক করিয়ে নেব।
– আচ্ছা যা তবে সন্ধ্যা নামার আগে ফিরিস।
– একদম, চিন্তা করো না।
ও মিনিট পনেরোর মধ্যে বেরিয়ে যায়।
আমার পক্ষে শাপে বর হলো। খুব দরকার ছিল ওর সরে যাওয়ার। আমি মারিয়ানাকে ডাকতেই, এক ছুটে ও আমার কাছে এসে বললো,
– ম্যাডাম, দিদিমনির ঘরের বিছানার চাদরটা দেখবে চলো।
গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার সন্দেহ আরো পোক্ত হলো। ওর বিছানার চাদর নিচের দিকে মানে যেদিকে পা থাকে কাদায় মাখামাখি! যে কাল সারাদিন ঘর থেকেই বেরোয়নি তার চাদরে কাদা আসে কি করে? কোনো বিড়াল বা কিছুও ঢুকতে পারবে না কেন না এটা দোতলার ঘর। তাহলে? আমার সন্দেহই কি ঠিক!
না না আমাকে মাথা ঠান্ডা করে আরো কিছু হিসেব মেলাতে হবে। হঠাৎ কি মনে হতে দূরবীনটা নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বাড়িটার দিকে ভালো করে দেখলাম। কিন্তু নাহ্, ভাঙা চোরা কাঠের দেওয়াল আর বন্ধ কাঁচের জানালা ছাড়া আর কিছুই নজরে এলো না।
মারিয়ানা বললো,
– দিনের আলোতে অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে, খালি চোখে দেখা যায় না, আঁধারে দেখতে শেখো ম্যাডাম।
আমি সত্যিই ওর কথার মানে বুঝলাম না।
– মারিয়ানা আমার সাথে যাবে?
– কোথায় ম্যাডাম?
– প্রিস্ট মিখাইলের কাছে যার কথা অদ্রিয়ানো বলেছিল।
– যাবো।
ফাদার মিখাইল বয়স অনুপাতে খুবই সুস্থ বলা যায়, দেখে বোঝার উপায় নেই ওনার বয়স নব্বই-এর উপর।
বাড়িতে একাই থাকেন একটি ছেলে দেখাশোনা করে। মারিয়ানাকে চিনতেন তাই পরিচয় হতে বেশিক্ষণ লাগলো না।
– ফাদার এই অশুভ ছায়াটা কি আসলে? সবাই বলছে শতাব্দী প্রাচীন কোনো অভিশাপ!
– সব বলছি কিন্তু এ বিষয়ে এত আগ্রহ কেন দেখাচ্ছেন?
অগত্যা আমার সন্দেহ আর তিয়াসের বিষয়ে সবটা বললাম।
উনি চেয়ারে বসে ছিলেন, একপ্রকার লাফিয়ে উঠলেন। বললেন,
– God please save her..
– কেন ফাদার? কি হয়েছে? আমার আশঙ্কা কি তাহলে …
– উনি সংক্ষেপে আমাকে Casa De Monte এর ইতিহাস টা বললেন। যা শুনলাম তাতে আমার মন বসে যেতে লাগলো। খালি মনে হচ্ছে কি কুক্ষণে মেয়েটাকে এখানে ডেকে এনেছিলাম।
ফাদার আবারও মারিয়ানাকে কি সব বুঝিয়ে বললেন ওদের ভাষা আমি বুঝলাম না। ও মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো।
আমার চোখে প্রশ্ন দেখে ফাদার আস্বস্ত করলেন,
– মারিয়ানাকে ওর দিদার কাছে পাঠিয়েছি কিছু জিনিস আনতে।
ওর দিদা এক কালে খুব নাম করা গুনীন বা উইচ ডক্টর ছিল। আমার সাথেও কাজ করেছে।
আমি তোমাকে যা বলবো যা বোঝাবো ঠিক সেই মতো চলবে আর তোমার husband-কেও বুঝিয়ে দেবে। মারিয়ানাকে সাথে রেখো, মেয়েটি খুব কাজের। ওর দিদার অনেক বিদ্যে ও জানে।
– আমার মেয়ের কি হবে ফাদার, ওর কোনো ক্ষতি…
– উপরওয়ালার উপর ভরসা রাখো। মনে সাহস রাখো। তুমি মা, গড এর পর সব থেকে শক্তিশালী তুমি, এটা মাথায় রাখবে। আর আগের বার যদি শয়তানকে শায়েস্তা করা গেছে, এবারেও যাবে।
মারিয়ানা এসে পড়ল, হাতে একটা ব্যাগ।
ফাদার সবটা বুঝিয়ে দিলেন আমাদের, কি করতে হবে, না হবে।
মারিয়ানা দু’টো পুঁতির মালা এনেছিল, ছোট পাথর আর কাঠের বিডস দিয়ে বানানো মালা, মন্ত্র পরে আমার গলায় পরিয়ে দিলো আর নিজেও একটা পড়লো, ফাদার ও দু’টো হলি ক্রস দিলেন সাথে রাখার জন্য।
ফাদারের কাজের ছেলেটি হঠাৎ হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বললো, নিচের বসতিতে আজ সকাল বেলাতেই শয়তান হামলা চালিয়েছে,
– সেকি দিনের বেলায়?
– হ্যাঁ, দু’জন মানুষ আর বেশ কিছু স্ট্রিট dog-কে উন্ডেড করেছে। একটা লোক পুলিশকে জানিয়েছে, কালো পোশাক পরা মুখ ঢাকা এক নারী মূর্তি, আলোর গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর তারপর জংলি পশুর মতো নখ দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে খাবার চেষ্টা করেছিল। লোকটি বেশ জোয়ান আর হাট্টা কাট্টা তাকেও কাবু করে ফেলেছিল এতই তার শক্তি !
– (ফাদার বিড়বিড় করলেন) এত শতাব্দীর খিদে, একি সহজে থামবে!
– ফাদার আমার মেয়ের কি হবে?
– ব্যাকুল না হয়ে যা বলছি যেভাবে বলছি করো। ভয় পাবে না।
– আচ্ছা ফাদার দিনের আলোয় শয়তান / অশুভ ছায়া বের হচ্ছে কি করে?
– শয়তানের অনেক রূপ অনেক শক্তি। আর শয়তানের প্রধান খাদ্য কি জানো? আমাদের মনের ভয়।
শুধু মাত্র ড্রাকুলা আর কিছু নাইট স্পিরিট আছে যারা দিনের আলো সইতে পারে না। ওদের অনেক ক্ষমতা অনেক রূপ, বেশভূষা, ভাষা সব নকল করতে পারে। যাক গে তোমরা বেরিয়ে পরো সময় বেশি নেই।
আমি জানি না কি হতে চলেছে, কি ভাবে সবটা সামলাবো? তার মাঝেই অরিন্দম জানালো, ওদের কাস্টমারদের ডিটেইলসের ডাটা বেসে কি এরর হয়েছে, মারাত্মক চিন্তায় আছে ও, যতক্ষণ সবটা না শর্ট আউট করতে পারছে ও আর ওর টিম অফিসেই থাকবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
পরের কয়টা ঘন্টা বোধহয় আমার জীবনের সব থেকে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন ছিল। যা সারা জীবন মনে থাকবে।
বাড়ি ফিরেই মারিয়ানা, তার সেই ব্যাগ থেকে নুন বের করে সেটা দিয়ে সারা বাড়ির কম্পাউন্ড ঘিরে একটা গন্ডি কেটে দিলো। শুধু দরজার কাছটা ফাঁকা রাখলো। এখন শুধু অপেক্ষা।
তিয়াস না ফেরা পর্যন্ত বুঝতে পারছি না, ওর উপর শয়তানের ছায়া আছে কি না? মারিয়ানা আর আমি চুপচাপ বসে আছি, এতটাই নিস্তব্ধতা চারদিকে যে আমরা পরস্পরের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি।
বিকেল নাগাদ তিয়াস ফিরলো। আমি আমার স্নায়ু ঠান্ডা রেখে ওর সাথে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ব্যবহার করছি। মারিয়ানা এক ফাঁকে উঠে বাইরে গেলো। আমি জানি এবারও দরজার সামনেও মন্ত্রপুত নুন দিয়ে গন্ডি কেটে দেবে।
আমি তিয়াসকে বিভিন্ন কথায় ভুলিয়ে রাখলাম। ও কিছু সময় পর নিজের ঘরে চলে গেলো। তবে ওর চোখের ভাষায় একটা অস্থিরতা ধরা পড়েছিল।
ক্রমশঃ সন্ধ্যে নামলো। তিয়াস এখনো ঘরেই, মারিয়ানা কফি দিয়ে এলো, যথারীতি ঘরে ঢুকতে দেয়নি দরজার ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিয়েছে।
আমার মাথায় মারিয়ানার বলা কথাটা ঘুরছে, অন্ধকারে দেখতে শেখো। বাইনোকুলারটা নিয়ে বাড়ির পেছনে কাঠের বাউন্ডারির উপরে উঠলাম একটা মই এর সাহায্যে। মারিয়ানা আগে থেকেই মইটা বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। ফাদারের দেওয়া একটু হলি ওয়াটার চোখে বুলিয়ে ওনার বলা মন্ত্র বলতে বলতে মই দিয়ে উপরে উঠে Casa de Monte র দিকে দেখার চেষ্টা করলাম, আমার আরাধ্যকে মনে মনে বললাম, ঈশ্বর আমাকে শুধু সত্যিটাই দেখাও কোনো মায়া যেন আমার দৃষ্টিকে অবরুদ্ধ না করে।
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আকাশের মুখ ভার, কালো মেঘ ঢেকে রেখেছে চারিদিক, বড্ড নিস্তব্ধ চারিদিক। যেন প্রকৃতিও অজানা আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পিটছে।
Casa de Monte একটা মূর্তিমান প্রেতপুরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, যেন এক তাল অন্ধকার। কিন্তু আশ্চর্যভাবে ঈশ্বরের নাম নিয়ে বাইনোকুলারটা চোখে লাগানো মাত্রই যেন চোখের সামনে অন্য এক ছবি ভেসে উঠলো! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ওই বাড়িতে হালকা ম্যারমেরে হলুদ আলোতে দু’হাতে জানলার কাঁচে করাঘাত করছে আর চেঁচাচ্ছে একজন। যদিও তার শব্দ এ পর্যন্ত আসছে না।
পাগলের মতো উদ্বিগ্ন চেহারা তার!
বোঝাই যাচ্ছে বিধস্ত আর ক্লান্ত সে। আমার আশঙ্কা তাহলে ঠিক ছিল? সে মানুষটা আমার বড্ড চেনা … সে তিয়াস !!
ফাদার এটাই আঁচ করেছিলেন। আর এটাও বলেছিলেন, তিয়াসকে ও বাড়িয়ে দেখা মানে, যুদ্ধটা আরো কঠিন হয়ে যাবে! আমার দু’ গাল বেয়ে নেমে আসে চোখের জল। কাঁধে একটা আলতো স্পর্শে চমকে ঘুরে দেখি, মারিয়ানা!
– কেঁদো না ম্যাডাম। আমাদের দিদিমনিকে ফেরাতেই হবে। আর তারজন্য এই পিশাচটাকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে, ও আমাদের দিদিমনির জীবনী শক্তি শুষে ওর রূপ নিয়ে এসেছে। আর এই নিরীহ পশু আর মানুষদের শিকার করে নিজের পেট ভরছে আর শক্তি বাড়াচ্ছে।
– এসব সত্যি হতে পারে এ যুগে?
– চাঁদ তারা সূর্য সত্যি হলে, ঈশ্বর সত্যি হলে তার বিরুদ্ধ শক্তিও থাকবেই ম্যাডাম। তবে আজ ও বন্দি এই বাড়িতে নুনের মন্ত্র পড়া গন্ডি কোনো পিশাচই পার করতে পারে না।
– আমরা কি করবো এখন?
– অপেক্ষা, রাত আরো ঘন হওয়ার। স্বাভাবিক থাকুন ওকে বুঝতে দেবেন না। তবে দিদিমনি যত অসুস্থ আর ক্লান্ত হবেন পিশাচের পক্ষে দিদির রূপ নকল করা ততই অসুবিধেজনক হবে। ওকে নিজের রূপে আসতে হবেই।
ইতিমধ্যে অরিন্দমকে কয়েকবার ফোন করলাম, বলতে চেয়েও পারলাম না। ও বললো আজ রাতে কোনোভাবেই ফিরতে পারবেনা। খুব কান্না পাচ্ছিল, জানি না আর কোনোদিন ওকে দেখতে পারবো কিনা। আমি মারিয়ানাকে অনেক করে বললাম বাড়ি চলে যেতে কিন্তু ওই ভীতু মেয়েটি যে আজ কোথা থেকে এত সাহস পাচ্ছে কে জানে! কিছুতেই আমাকে ছেড়ে গেলো না। বললো,
– ও আমাদের ঘাঁটাবে না, এটা ওর ডেন, হাইড আউট। আমাদের উপর আঘাত আসবে একদম শেষে তবে আমাদের গলার এই মালা অনেকটা প্রটেকশন দেবে।
রাত বাড়তে থাকল। তিয়াসকে খাবার জন্য ডাকলেও সে এলো না, বললো খিদে নেই। আমি সারাক্ষণ ভাবছি ওকে ওই বাড়িতে ঢোকাব কি করে? না হলে যে তিয়াসের মুক্তি নেই ! মারিয়ানা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওকে এরমধ্যে টানতে চাইনা আমি তাই ওকে জাগালাম না। সন্তর্পণে তিয়াসের ঘরে গেলাম, ও যে জেগে আছে আমি জানি, এটা তো ওর শিকারে যাওয়ার সময় কিন্তু ওই গন্ডির জন্য ও আটক হয়েছে আজ। দেখলাম চোখে মুখে এক অন্য অভিব্যক্তি ওর। কেমন যেন ছটফট করছে ওর চোখ। সে চোখ ঘোলাটে আর লোভাতুর। খুব চেষ্টা করছে নরমাল থাকার।
– তিয়াস মারাত্মক বিপদ হয়েছে রে..
– কি?
– তোর বাবার অফিসের একজন ফোন করে বললো, চেষ্ট পেইন হয়েছে ওর। হসপিটালে এডমিড করেছে। কিন্তু কি সব এক আতঙ্ক.. জন্তু বেরিয়েছে, রাতে একা বেরোতেও ভয় করছে, একটু যাবি আমার সাথে?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ এখুনি চলো..
ওর চোখ চক চক করে উঠলো। আমি জানি যে করেই হোক ও এই গন্ডির বাইরে বেরোতে চায়। আমি জানিনা কি অপেক্ষা করছে আমার কপালে। তবে আমি জানি তিয়াসকে বাঁচতেই হবে।
চলবে….