রম্য – রহস্য ভালবাসা

রহস্য ভালবাসা
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

 

পেনশন পেনশন। ধন্য ইংরেজ বাহাদুর। ভাগ্যিস পেন ধরা শেষে পেনশন ধরিয়ে ছিলে। নইলে, ল্যাজেগোবরে হতে হতো। এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে,বৃদ্ধ বয়সে অন্যের হাততোলা হয়ে থাকতে হতো। চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে , চোখ রাঙানি, মুখ ব্যাকানি হজম করতে হতো। রেহাই রেহাই। জয় বাবা পেনশন।

কপাল কুঁচকে লাভ নেই। সত্যি কথায় ডর নেই।
আরে মশাই , ওই যে দেখুন, যে লোকটা পার্কের বেঞ্চের কোনায় ঘাড় গুঁজে ছাতার হাতলে ভর করে বসে আছেন ছাতিম গাছের তলায়, বিশ্বাস করবেন ওই লোকটা যুবক বয়সে , এক ঘুসিতে এক গোরা পল্টনের পাঁচটা দাঁত নড়িয়ে দিয়েছিলেন ? হ্যাঁ , তাই । বিশ্বাস যেযার নিজের। এখন তেল ফুরিয়েছে , বিকল যন্ত্রের পুরনো গাড়ি। জায়গা জুড়ে পড়ে আছে। হাফ দামেও খদ্দের জুটছে না। যত্তসব।

অথচ ওনার একান্ত গলায় গলায় প্রাচীন বন্ধু ,
ইংরেজ বিদায় নেবার পরে , পেলেন সরকারি চাকরি। মেয়াদ শেষে প্রথাগত রিটায়ার্ড, এবং বর্তমানে পেনশনভোগী।আরামে আছেন । কাউকে থোড়াই কেয়ার। আপনা পেনশন জগ্ননাথ। আরে বাবা সংসারে কেউ কারোর নয়। সব সম্পর্কের উর্ধ্বে স্বার্থ। স্বার্থই আসল , সেই সত্য, নির্ভেজাল।
বাকি সব অভিনয়, ফাষ্টক্লাস অভিনয়।

ওইতো উদাহরণ বসে আছেন। জিজ্ঞেস করুন, জীবনে কী পেলেন শেষমেশ ? উত্তর একটাই , লবডঙ্কা।
সারাজীবন সংসারের ঘানি ঘুড়িয়ে , বিপ্লবী যুবা পুরুষ সিংহ , এখন তারই তৈরি করা সংসারে অপাংক্তেয় বোঝা।
যতক্ষণ তেল , ততক্ষণ সরষে । তেল হারিয়ে সরষে এখন খোল, ছিবড়ে। গরুর খাদ্য।
দুধ ফুরিয়ে যাওয়া গাই। যতক্ষণ দুধ ততক্ষণ কদর। গোয়ালঘরে আদর ছিল। জাবনা ভরা কুচো খড় ছিল। শীতে , মোটা চটের পিঠ ঢাকা চাদর।
দুধ নেই কদর নেই । এখন কশাই খোঁজা চলছে। মনোমত দাম পেলেই পগার পার। গরুটার চোখের কোলের কাছটা কেমন যেন ভিজেভিজে । আচ্ছা, গরুর কি সুখ দুখের অনুভূতি আছে ! ওদের কি কান্না পায়! কাঁদে ?

কোথায় গেল সন্ধ্যায় গোয়ালে প্রদীপ দেখানো , বচ্ছরকার শুভদিনে দুই শিং এর মাঝখানে সাদা চামড়ায় তেল সিঁদুর টিপ , ক্ষুরে ক্ষুরে জল ঢালা। দুধ শেষ, ঘি মাখন ছানা খাওয়া শেষ , সুতরাং
স্বার্থ শেষ , ভক্তি ভালবাসা সব শেষ। গোমাতা এখন গোবেচারা। দুধের ঋণ এভাবেই বুঝি শোধ হয়। ***

বারো বছর সার্ভিস দিয়ে , তেরো বছরের মাথায় ডগি মারা গেল। ডগি, আদরের পোষা কুকুর। কি সুন্দর সাদা ধবধবে তুলোর মতো নরম লোমওয়ালা। কি আবদারে মাখামাখি হয়ে , এঘর ওঘর বারান্দা খাট বিছানা সোফায় দাপিয়ে বেড়াতো। কি চুমু খাওয়ার ধুম। চুক চাক, চুকচুক।সেই ডগি নেই। সারা বাড়িতে আত্মিয় বিয়োগের যন্ত্রণা। কান্নাকাটি , চুল ছেঁড়াছিঁড়ি , চিৎকার চ্যাঁচামেচি। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। রান্নাবান্না বন্ধ। ডগির শ্মশান যাত্রার শোকবহ আয়োজন। সবাই ব্যস্ত। শোকাতুর।
এখন অবাক হয়ে ভাবছি। যা মানুষ পারে না , ভগবতী গরু পারে না,,,,,,,,
কি যাদুবলে কুকুর , মানুষ কে এমন ভালবাসা আর মায়ার বাঁধনে বাঁধতে পারে। হে ঈশ্বর , আগামী জনমে আমাকে ডগি করে পাঠিয়ো। প্র‍্যক্টিক্যাল এক্সপিরিয়েন্স ছাড়া , এই রহস্যের সমাধান অসম্ভব।

Loading

Leave A Comment