বাস্তবতা
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
শোক বা সুখ , কোনটাই প্রলম্বিত হয়না। ক্ষণচারী বলেই রক্ষে, নইলে বিপদের একশেষ হতো। অনিত্য জাগতিক বাস্তবতা। শীতকালে গায়ে ঠান্ডা জল ঢালার মতো। প্রথমে একটু ঝাঁকুনি দেবে , তারপর সয়ে যাবে। আসলে সয়েই যায়। প্রকৃতি আমাদের সেই ভাবেই গড়েছে। আমরা প্রকৃতির দাস। যতক্ষণ জীবন , ততক্ষণ দাসত্ব। রেহাই নেই। তাই রসেবশে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বড্ড শক্ত হে , বড়ই কঠিন । রসেবশে থাকা , ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। ঠাকুর বলতেন -রসেবশেই তো থাকতে চাই , তা ওই , মা বেটি থাকতে দিচ্ছে কই ??
এই হলো সার কথা । থাকতে দিচ্ছে কই। খুনসুটি করার লোকের অভাব নেই। কাঠিবাজি জিন্দাবাদ।
আপনি নুন ভাত খাচ্ছেন ? আহা রে, বেচারা।
সেই আপনি একটু উন্নতি করে , মাছ ভাত খাচ্ছেন, যাক, বেচারা বড্ড কষ্টে ছিল , ঈশ্বর মুখ তুলে চেয়েছে… সেই আপনি আরও উন্নতি করে বহাল তবিয়তে আছেন ,,,, ব্যাস,, হয়ে গেল । সহানুভূতি ফর্সা। বেমালুম উল্টো সুর…
বোলচাল দেখেছো , কেমন পাল্টে গেছে ! ব্যাটা দুদিন আগে খেতে পেতো না,, এতো বারফট্টাই আসে কোথা থেকে ? নির্ঘাত দুনম্বরী কেস। পুলিশ এলো বলে।
চেঞ্জ টা লক্ষ্য করলেন ? যতক্ষণ বেচারি , ততক্ষণ আহা,, আহা রে। যেইমাত্র ভোলবদল অমনি বোলবদল। মানব চরিত্র বেজায় কঠিন , কিছুই বুঝতে পারবে না।
চোখ টাটানো একপ্রকার ব্যামো। এ ব্যামো সারে না। প্রতিবেশীর শিক্ষিত ছেলে বিদেশে গেল। উচ্চতর শিক্ষার প্রয়োজনে। প্রতিবেশী কানাই সূর ককিয়ে উঠলেন- বাপ সারাজীবন কর্পোরেশনে কলম পিষলো, ছেলে চললো ক্যালিফোর্নিয়া। একেই বলে করিৎকর্মা। ক’টাকাই বা মাইনে বাপু। এই দুর্দিনের বাজারে… কি জানি বাবা, কি করে কি হয় । শুরু হয়ে গেল চোখ টাটানো। নিজের যোগ্যতা নেই, তাই অপরের যোগ্যতা থাকতে পারবেনা।কানাই সূরের ছেলে কোনরকমে টাল্লা খেয়ে কলেজে ঢুকেই পড়ে গেল রাজনীতির চক্করে। পড়াশোনা গোল্লায়। সঙ্গে জুটলো প্রেয়সী। বোঝঠ্যালা। গোদের ওপর বিষফোঁড়া। একা রোজগেরে বাপ, তাও প্রাইভেট কোম্পানির। টানাটানির সংসার। মুদির দোকানে ধারের খাতা চলে, তাই রক্ষে। না হলে,,,,
ছেলে সেসব বুঝলো ? সে চললো ঝান্ডাবাজি ডান্ডাবাজি করতে। কেজানে কি আছে কপালে। ঝান্ডাবাজি ডান্ডাবাজির সঙ্গে যদি ধান্দাবাজি রপ্ত করতে পারে , তাহলেই কপাল খুলবে , নইলে জীবন বরবাদ । প্রেয়সীর বিয়ের দিন , করুণ সুরে গান ধরবে——আজ থেকে তুমি অন্যের,,, গান গাইতে গাইতে, প্রিন্সেপ ঘাটে বসে আকন্ঠ চুল্লু পান। এই ভবিতব্য।
শুনেছো গিন্নি , তোমার ছেলের বন্ধু , একসঙ্গে খেলাধুলো করতো, ছাদে ঘুঁড়ি ওড়াতো, লাট্টু ঘোরাতো। সেই ছেলে পড়াশোনা করবার জন্যে চলে গেল, ক্যালিফোর্নিয়া। আর তোমার ছেলে ? কপাল কপাল , বুঝেছ গিন্নি কপাল।
গিন্নির চোখ ছলছল। আর কপাল চাপড়ে কি হবে,,,, সেকি বুঝলো? বাবা মায়ের একটা স্বপ্ন থাকে , ইচ্ছে থাকে । নিজেদের জন্যে নয়। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্যে। অন্যের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। দোষ আমাদেরই , যাইবলো , আমরা আমাদের সন্তান কে মানুষ করতে পারিনি।
বেশ বোঝা গেল , সবাই অবুঝ নয়। সন্তান, বাবা মায়ের মনের হদিস না পেতে পারে । কিন্তু, বাবা মা তাদের সন্তানকে বুঝবেনা , হতেই পারে না। এটাই বাস্তবতা।
যা বলছিলাম । শোক বা সুখ পড়ন্ত বিকেলের ছায়ার মতো প্রলম্বিত হয়না।
ক্যালিফোর্নিয়ায় বিশেষ বিদ্যায় বিদ্বান হয়ে দেশে ফিরলো বিকাশ। বিয়ে করলো নিজের পছন্দের প্রেমিকা কে। স্বামী স্ত্রী দুজনেরই এখন মোটা টাকা রোজকার। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই তারা নতুন ফ্ল্যাটের মালিক। বাবা মা , গুডবাই। টাটা।
ঠিক এই সিকোয়েন্স , নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম গান খানা জম্পেশ লাগদাই হবে।
ছেলে কে বড়োমানুষ করে তুলতে , বাবা ফতুর। বাবা রা বুঝি এমনই বোকা হয়। শাজাহান হোক কিংবা বিকাশের বাবা । পরিনতি কি করে সব একই হয়ে যায় কে জানে। হয় বাবাদের বোকা বানানো খুব সহজ , নতুবা , বাবা রা বোকা সাজতে ভালবাসে ।
কানাই সূরের ঠোঁটে বাঁকা হাসি।
বুঝলে গিন্নি , বিকাশ, লটবহর সমেত ভাগোলবা,,,
মানে… বিকাশ চলে গেল…? কোথায় ?
নতুন ফ্ল্যাটে….
সেকি…তাহলে বাবা মা….?
পুরনো বাড়িতে… হেঁ হেঁ… বলছিলে না… আমরা আমাদের সন্তান কে মানুষ করতে পারিনি ?
এবার কি বলবে… উচ্চ ডিগ্রি ধারি সন্তান, গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে , বউ সমেত হাওয়া।
সেকি গো, বয়স্ক মানুষ দুটোর কথা একটুও ভাবলো না…. হঠাৎ অসুখ বিসুখ করলে , তখন?
গান গাইবে,,, মরণ রে তুহু মোর,,, সেই গানটা।
এইবারে গিন্নির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।।যাই বলো বাপু… আমাদের ছেলে পার্টি ফার্টি যাই করুক… তোমারই মতন প্রাইভেট কোম্পানির সামান্য মাইনের চাকরি। আমাদের ছেড়ে যাইনি কিন্তু।
সূর মশাই , একটা বিড়ি জ্বালিয়ে , জুত করে ধোঁয়া ছেড়ে , বললো- এখনই নেচে উঠো না…. আগে ওকে বিয়েটা করতে দাও.. তারপরে বোঝা যাবে , কত ধানে কত চাল।
ঘরে দীর্ঘশ্বাসের ঝড় বইলো ।সময় পাল্টেছে গিন্নি , আমাদের যুগ আর নেই। সবাইকে নিয়ে সুখে দুখে একসাথে থাকার দিন আর নেই। এখন সব… তুমি আমার , আমি তোমার, খেলনা বাটি সংসার। এই আছে , এই নেই। ভ্যানিশ।।তোমার আমার সময়ে , শচীনকত্তার জমাটি গান ছিলো…
তুমি এসেছিলে পরশু , কাল কেন আসনি…
এখন আমার কি গাইতে ইচ্ছে করে জানো…
রামপ্রসাদী…
আমি সখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা…
দোষ কারো নয় গো মা। বাস্তবতা গিন্নি ঘোর বাস্তবতা ।
অনেক অনেক ভাললাগা।
আলাপী মন ওয়েব ম্যাগাজিন কে আমার আন্তরিক ভালবাসা শুভেচ্ছা জানাই।
🙏🏻🙏🏻🙏🏻