স্বপ্নপূরণ
– সোমা কর্মকার
মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ভদ্র, সভ্য ছেলে সূর্য। মা, বাবা আর দুই ভাই এই চারজন মিলে ছোট্ট সুখের পরিবার ওদের। মা শিক্ষকা, বাবা ব্যবসায়ী। পাড়ায় যথেষ্ট নাম ডাক আছে ওদের। সূর্য ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় ভালো, ব্যবহারের দিক থেকেও বিনম্র স্বভাবের।পেশায় সূর্য একজন হিসেব রক্ষক। চাকরির সুবিধের জন্য ও বাড়ী ছেড়ে অফিসের কাছাকাছি ভাড়া থাকত।
এভাবেই চলতে চলতে স্বপ্না নামক একটা মেয়েকে সূর্য ভালোবেসে প্রপোজ করে ফেলে। স্বপ্নাও ওর ভালবাসার স্বীকার করে নেয়। ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, অবশ্য বাড়ীর লোকের স্বপ্নাকে দেখে পছন্দ হয়নি তাই বিয়েতে একটু আপত্তি ছিল, তবুও ছেলের পছন্দ বলে মেনে নেয়। যথারীতি ওরা বিয়ে করে ফেলে। সূর্যর ভালোবাসায় কোনো ত্রুটি ছিল না, মনে প্রাণে ও স্বপ্নাকে ছাড়া কিছুই চিনত না। এভাবে বেশ কিছুদিন ভালোই কাটছিল। আস্তে আস্তে দেখা গেলো খুঁটিনাটি বিষয়ে কথা কাটাকাটির জন্য ওদের মধ্যে দুরত্ব বাড়তে থাকে। স্বপ্না বিলাসিতা করে প্রচুর টাকা নষ্ট করতে লাগলো। সূর্যকে ভালো পেয়ে ভুল ভাল বুঝিয়ে বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করে অনেক টাকা খরচ করতো। এভাবে চলতে চলতে যথারীতি সূর্যের আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। তাই স্বপ্নার চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারতো না। আর তাই অশান্তি দানা বেঁধে ওঠে এবং আস্তে আস্তে চরম আকার ধারণ করে, একদিন স্বপ্না সূর্যকে ছেড়ে চলে যায়। সূর্য মনে প্রাণে খুব ভেঙ্গে পড়লো, এক লহমায় ওর সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। বিষয়টা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। একা থাকতো তাই বিষয়টি কারো কাছে শেয়ার করতে পারতো না। আর যেহেতু ও প্রায় বাড়ীর অমতে বিয়ে করছে তাই বাবা মাকে ও অভিযোগ করার মুখ নেই। এসব নানা চিন্তা-ভাবনা, কষ্ট ও মনের দ্বন্দ্বে সূর্য আস্তে আস্তে কেমন একটা পাগলের মতো হয়ে গেলো। কাজ বাজ বন্ধ করে ঘর ছেড়ে একটা মন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নিলো। আসলে খুব ভালোবাসার মানুষটির থেকে এমন আঘাত ও কোন দিন আশা করেনি।
এরপর প্রায় দেড় বছর কেটে গেল একদিন অমিত নামে ওর এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো। সমস্ত কিছু শুনে ওর মাথা ঘুরে গেল ও কিছুতেই বুঝতে পারলো না কি করে সূর্যের মতো ছেলের সাথে এমন ঘটনা কেন ঘটলো। অমিত সূর্যকে অনেক করে বুঝিয়ে সুজিয়ে ওর বাড়ীতে নিয়ে এলো এবং ডাক্তার দেখিয়ে আস্তে আস্তে সুস্থ করে তোলে। আবার ও অফিস যেতে লাগলো ও অনেক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো।
প্রায় দুই বছর পরে অফিসে কর্মসূত্রে অতসী নামে একটি মেয়ের সাথে ওর আলাপ পরিচয় হলো এবং খুব ভালো সখ্যতা গড়ে উঠলো। অতসী সূর্যের কাছে ওর বাড়ীর কথা জানতে চাইলে সূর্য জীবনের অন্ধকার দিনগুলোর সম্পর্কে বিস্তারিত বললো। আলোচনা সুত্রে জানা গেলো অতসী ও ডিভোর্সী ওর সঙ্গেও এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুজনে একি পথের পথিক হওয়ায় ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো গভীর হয়। সূর্য খুব ভালো মনের মানুষ বুঝে অতসী নিজে থেকে সূর্যকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলো এবং চিরজীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু সূর্য রাজী হলো না ও বলে – ‘ভালোবাসা আর ঘর বাধার প্রতি বিশ্বাস উঠে গেছে। তাই তুমি আমার বন্ধুই ঠিক আছো’। অতসী বললো – ‘একবার বিশ্বাস করতে পারো, হয়তো ঠকবে না’।
প্রায় হপ্তা খানেক পর হঠাৎ অমিত ওকে দেখতে আসে। সূর্যের মনখারাপ দেখে অমিত কি হয়েছে জানতে চায় এবং অমিত জোর করাতে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। সব শুনে অমিত বাচ্চাদের মত করে বোঝাতে লাগলো এবং বললো – ‘দেখ আমাদের সঙ্গে হয়তো অনেক সময় অনেক দুর্ঘটনা ঘটে কিন্তু সবাই খারাপ হয় না, এই পৃথিবীতে খারাপের ব্যতিক্রম ও কিছু আছে। হয়তো ভগবান তোকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে। তাছাড়া জীবনে বাঁচতে গেলে পাশে একটা সঠিক মানুষের প্রয়োজন। একবার একটু ভেবে দেখ, দরকার হয় কিছুটা সময় নে’। তারপর প্রায় দুই সপ্তাহ সূর্য নানারকম ভাবে বিষয়টা ভাবলো। শেষে জীবনের ওপর বাজী রেখে রাজী হয়ে গেলো, ও রেজিস্ট্রি করে অমিতের উপস্থিতিতে বিয়ে হলো। আজ প্রায় ১০ বছর হয়ে গেল, একটা কন্যা সন্তান নিয়ে ওরা দিব্যি সুখেই দিন কাটাচ্ছে।
অমিতের জন্য দুটি ভেসে যাওয়া জীবন আরার কুল খুঁজে পেলো, এ এক আকস্মিক প্রাপ্তি যা দুটো জীবনকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।
—