ভোরের আলো
– রাখী চক্রবর্তী
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে”
পুব আকাশে সূর্যের লাল আভা দেখা মাত্রই বেজে উঠল শঙ্খ ধ্বনি।ইরাবতী সোসাইটির প্রতিটি বাসিন্দা সজাগ হলো।এবার ননীবালা দেবীর কন্ঠের গান শুনে ঘুম ভাঙবে ইরাবতী সোসাইটির প্রতিবেশীদের।
কৃষ্ণ নাম শুনতে কেউ অভ্যস্ত ছিল না। দু’বছর হল ননীবালা দেবী ও ওনার ছেলে সৌগত চক্রবর্তী ইরাবতী আবাসনে এসেছেন।প্রাতঃস্নান সেরে ননীবালা দেবী কৃষ্ণর ভজন করতে থাকেন রোজ।শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা..
এই তো সেদিনের কথা- সৌগত বিয়ে করে শ্রীকে যখন ইরাবতী আবাসনে নিয়ে এল।তখন ননীবালা দেবী বৌমার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিলেন। ঠাকুর ঘরের লক্ষ্মীর পটের সাথে এত মিল শ্রীর মুখের।
ঘরে লক্ষ্মীমন্ত বৌমা এসেছে। খুব খুশি হলেন ননীবালা দেবী তাই আনন্দ সহকারে ননীবালা দেবী সোসাইটির সবাইকে নিমন্ত্রণ করলেন। কীর্তনে আসার জন্য।সৌগত মার কথাতে আপত্তি করতে পারছে না। কারণ সৌগত ভাল করে জানে মা ঠাকুরের নাম, গান, কীর্তন এই সব নিয়েই থাকতে ভালবাসে।এদিকে শ্রী মুখ ফুলিয়ে বসে আছে ঘরের দরজা বন্ধ করে। ও হৈ হট্টগোল করবে বন্ধুদের সাথে। খুব বড় পার্টি দেবে সৌগত, এই আশাতেই ছিল। তা না হয়ে এখন কীর্তন শুনতে হবে ওকে। এটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
সন্ধ্যা বেলায় অতিথি সমাগমে ননীবালা দেবীর ঘর ভরে গেল। কিন্তু লক্ষ্মীমন্ত বৌ এখনও এল না। নানান মানুষ নানান রকম কথা বলছে।ৎহরিনাম শুরু হল যথাসময়ে।সৌগত অস্থির হয়ে পায়চারি করছে এঘর থেকে ওঘর। রাগ যে কম হচ্ছে তা তো নয়।রেজিস্ট্রি করার আগে বারবার বলেছিল শ্রীকে। মা ঠাকুরের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন। কোনোমতে মাকে আঘাত করা যাবে না। তখন কেন আপত্তি করেনি শ্রী।তাহলে সৌগত বিয়ে করত না। নেহাত শ্রী’র বাবা হুট করে ওর বিয়ে ঠিক করেছে অন্য পাত্রর সাথে। তাই একদিনের মধ্যে মাকে না জানিয়ে বিয়েতে মত দিয়েছিল সৌগত। কিন্তু পরিস্থিতি এমন হবে ও বুঝতে পারেনি।
ননীবালা দেবী শ্রীর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, বৌমা আমার সম্মান তোমার ওপর নির্ভর করছে, একটি বার বাইরে এসো। হরি নাম হচ্ছে, ঠাকুরের সামনে এসে একটু বসো দেখবে সব মন খারাপ ভালো হয়ে যাবে।
– আমি যাব না, ঐ কীর্তন, হরি নাম আমার ভালো লাগে না। আর আমি জোকার না, যে সবার সামনে এসে সেজেগুজে দাঁড়াব।
ননীবালা দেবী শ্রীর আচরণে খুবই মর্মাহত হলেন।অতিথিদের বললেন, বৌমার শরীর বিশেষ ভালো না, তাই ও আসতে পারল না, আপনারা সবাই প্রসাদ মুখে দিয়ে তারপর এখান থেকে যাবেন।
পরের দিন সকাল থেকে মহাধুম করে পার্টির তোড়জোড় চলছে ননীবালা দেবীর বাড়িতে।ননীবালা দেবী একটুও বিচলিত হননি, বরং মনে মনে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন শ্রীকেই ঠাকুর ঘরের দায়িত্ব দেব, একদিন না একদিন ও বদলাবেই।এদিকে রোজ সকালে শাশুড়ির গান শুনে ঘুম থেকে উঠতে শ্রীর মাথা খারাপ হয়ে যায়।সৌগতকে বলেও কোন লাভ হয়নি।এইভাবে চলছিল ননীবালা দেবীর সংসার, এর মধ্যে হঠাৎ শ্রীর খুব শরীর খারাপ, ডাক্তার বাবুকে ডাকা হল। শ্রী মা হতে চলেছে, ননীবালা দেবীর ঘরে গোপাল আসবে, কি আনন্দ।
ইরাবতী সোসাইটির প্রতিবেশীদের মিষ্টি মুখ করালেন ননীবালা দেবী।ছয় মাসে শ্রীর সাধ খাওয়ানোর দিন ঠিক হল। আজ সেই দিন, শ্রী আজ সাধ খাবে রোজকার মতো প্রাতঃস্নান সেরে ননীবালা দেবী ঠাকুরের গান গাইতে শুরু করলেন, দ্বৈত কণ্ঠে গান শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। ননীবালা দেবীও ভাবছেন কে গাইছে এত সুন্দর গানের গলা। ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে উনি দেখলেন শ্রী ঠাকুর ঘরের বাইরে বসে গান গাইছে। ননীবালা দেবী দু’হাত দিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলেন শ্রীকে,বললেন,
আমি জানতাম একদিন তুমি ঠাকুর ঘরে আসবে,আমার গোপালের মা তো তুমি, ধৈর্য ধরলে সব পাওয়া যায় মা। আজকের ভোরের আলো এত উজ্বল, এর আগে কখনও দেখিনি বৌমা।
ইরাবতী আবাসন, ইরাবতী সোসাইটির সবাই আজ কৃষ্ণ নামে মত্ত হল, শ্রীর সাধ খাওয়া উপলক্ষে সংকীর্তন হল সৌগতর ঘরে, শ্রী ঘরের লক্ষ্মী, তাই শ্রীকে ঠাকুরের আসনের পাশে বসিয়ে পুজো করছেন ননীবালা দেবী। ইরাবতী সোসাইটির প্রতিবেশীরা মুগ্ধ হয়ে হরি নাম শুনছেন আর বলছেন আমরা পাপীতাপী মানুষ আপনার মতো দেবীর সংস্পর্শে এসে আজ আমরা সবাই পুণ্য লাভ করলাম জয় শ্রী কৃষ্ণ…
সৌগতকেও বড় খুশি দেখাচ্ছে আজ কারণ ওর মার মুখে যে তৃপ্তির হাসির ঝিলিক উঁকি মারছে, মা খুশি হলে যে সৌগত ভালো থাকে।