তোমার সংসারে আমি
-বিকাশ দাস
তোমার কাজের মাসি কিছু না বলে হঠাৎ উধাও হলে,
তুমি রাগে গন গন।
তোমার চলা ফেরায় শুকনো লঙ্কার ঝাঁঝ,
যদিও সাময়িক ঝনত্কার।
তবুও নিতে ভোলো না তুমি লতা মাসির খবর,
ওর মাতাল বর করলো না তো মারধর,
না কি বাড়লো দুম করে আবার ছেলেটার জ্বর …
মাথার ভেতর হাজার প্রশ্নের জমাট ভিড় তোমার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে অবান্তর।
মাসি ফিরে এলেই ঠিকঠাক জবাব কৈফিয়েত না পেলে রাগে বলে ফেল:
এবার কাজে ফাঁকি দিলে তোর মাইনে কাটবো দেখে নিস বলেই …
তোমার ঠোঁটে এক চিলতে শুভ্র হাসির ঝিল।
মাসিও জানে তোমার দরাজ দিল।
তোমার শরীর খারাপ, তা সত্তেও হয়না ভুল তোমার।
একগাদা কাপড় চোপড় কাচতে, এঁটো বাসন কোসন ধুয়ে রাখতে,
সন্ধে সকাল বাড়ি উঠোন পরিষ্কার করে এলো চুল বাঁধতে,
আবার দু’ হাতে সলতে পাকাতে, ফুলের আলপনায় পূজোর আসন সাজাতে,
ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সময়ে সন্ধেবাতি রাখতে।
ছড়াতে ঘরের ভেতর বাহির সন্ধ্যা সাঁজাল।
সময় করে আবার ফ্রিজে জল রাখতে, বেডকভার টান টান,
সোফার কুশন ঠিক রাখতে, আনচান ।
সব কিছু পরিপাটি না হলে, তোমায় খুঁত খুঁতানি চেপে ধরে তোমার সর্বাঙ্গ অস্থিরতায়।
তোমার শরীর সাতসতেরো ঝামেলা ঝিমানো কাঁটায়,
তোমার চাউনিরা কাড়ে না কোনো ঝাপটায় ।
যেদিন তোমার নিরামীষ আমাদের জন্য একটা না একটা আমিষপদ ভোলো না রাঁধতে ।
তোমার উপোস দিনে সবার খাবারের ভুল করো না আয়োজন রাখতে।
সময় করে আত্মীয় পরিজনের নিয়ম মাফিক খোঁজ খবর প্রযত্নে রাখা।
ছোটো বড়ো সকলের সুখ দুখ এ সামিল থাকা।
কক্ষনো ভুল কর না সম্পর্কগুলো অবাধে জোর রাখতে অজুহাতের জটিলতায়।
কোন তিথি পূর্নিমা, অমাবস্যা, পুজো পার্বণ, পাঁজির বিবরণ তোমার নখদর্পণে।
সঙ্গে সব ষষ্টীর খেয়াল রাখা।
কোনো কিছুর ভুল ত্রুটির খামতি থাকে না।
সব খুঁটিনাটির দিকে তোমার কড়া নজর।
রোজকার বাজার তুমি একাই সারো নিজের হাতে,
আমার হাত খুব পাতলা, হিসেব হীন বলে।
রোজ এতো ভিড়ের মুখে আমার এলানো শরীর
তোমার দু’হাতের স্পর্শে আড়ালে আমার ঘুম জাগানো।
উষ্ণ গরম চা আমার অলস হাতে বাড়ানো। আমার স্নান সারা হলেই ,
ইস্ত্রির পাট করা জামা কাপড় আমার হাতের নাগালে রাখা,
অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি সাজিয়ে তোলা,
আমার রুমাল, চশমা, মোবাইল, বটুয়া একে একে এগিয়ে রাখা।
তোমার আলতো হাতে নধর চোখে মুখশুদ্ধি পরিবেশন।
নিজের হাতে আতরের ইষৎ ফোঁটায় আমার শরীর ভিজিয়ে,
সদর দরজা অবধি তোমার আসা।
দু’ হাত নাড়িয়ে প্রতিশ্রুতির প্রতিবেদন নিঃশব্দে জানানো
তোমার আধুত ঠোঁটের বিড়বিড়ানি… দুগগা দুগগা দুগগা।
কিন্তু ঘরে প্রবেশ বাইরে জুতো খুলেই, জুতোর প্রবেশ বারণ ঘরের ভেতর।
কখন ঠেকায় আমার হাত টানের সংসার ছিলো বিক্ষত,
লেগেছিলো পরিস্তিতির বর্গায় জোরুল আর চুনখসার আপদ।
এ সবের অভিযোগ বা সিকায়াত রাখোনি কোনদিনই তোমার কাছ ছাড়া।
বলোনি গলা বাড়িয়ে।
খুচখাচ সঞ্চয়ের কৌটো থেকে ঠিক সময় ধারের কিস্তি
শোধ দিয়েছো অভাবের কাঠে আগুন নিভিয়ে।
রোজকার রূপচর্চা, পরচর্চা বালাই তোমার অভিধানে বাতিল ও অরুচি।
বলো খামোকা উড়ান আদ্দিখেতামী ।
প্রতিদিনের অসংযত কাজের ফাঁকে, টবের মাটি কাটা,
ফুল গাছে জল । স্নান সারা । পুজো আর্চা। তুলসীর মূলে জল ঘোরানো,
মাথা ঠেকানো । সংসারের মঙ্গল চাওয়া টুকু একমাত্র তোমার কাম্য ।
মধ্য দুপরের স্তব্ধতা আঁচড় কাটে তোমার শরীরে
সারাদিনের ব্যস্ত জ্বালার আঘাত সারাতে ।
রবিবার তোমাকে বেশি করে দেখার ইচ্ছে চোখে রাখি ধরে
সকালে কাছে পাওয়া বেশি করে, স্নানের পর ভিজে কাপড়ে
চুলের জল ঝাপটানো, জলের ছিটে আমার গায়ে লাগানো। এ সুখ পাড়া পড়শীর ঈর্ষা ।
ঠোঁট ভিজিয়ে গুন গুন গান গাওয়া, হাত যখন কাজ গুছনোতে ব্যস্ত তোমার ।
চুপ চাপ কান পেতে শোনা। আচমকা গা জড়ানো ।
তোমার লজ্জার ঠেলায় গা ভাসানো ।
ফিরতে আমার রোজ দেরী হয় ।
জেনো ও সন্ধে নামলে কাছের দূরত্ব কে আরো কাছে টানার অভিসারের চঞ্চলতায়;
দু চোখ তোমার সজাগ রাখো এ জানালা ও জানালার পর্দায় ।
অথচ ভুল হয় না তোমার
গরম ভাত বা গরম ফুলকো রুটি বেড়ে দিতে ।
অন্তিমে গরম দুধ খাওযার পীড়াপিড়ি তোমার ।
গোঁসা হলেও আমার বুক জুড়াতো তোমার ভালোবাসার নিবীড় একান্তে ।
এক ভাবে বসে তোমার দু চোখ আমার খবর নিতো ।
দুপুরে কি খেলাম, কাজের চাপ কমলো কি না, হাঁটুর ব্যথা কম আছে কি না,
ওর খোঁজ পেলে কি না, আরো অনেক কিছুর খোঁজ গোঁজা থাকতো তোমার আঙুলে ।
প্রশ্নের কাঁটা ক্ষনিকের জ্বালা হলে ও এ জ্বালা ভালোবাসার চিরকালীন ।
শোবার আগে আমার বাকি ওষুধ এগিয়ে দিতে সঙ্গে জলের গ্লাস ।
আবছা আলোর সন্দিক্ষনের শিহরন অগোচরে ।
তোমার দু চোখের নীরব সরব সাক্ষাত্কারে, আমার সারা শরীরে বর্ষা নামতো ।
সারাদিনের ঝক্কি ক্লান্তির জ্বর কুল পেতো, এসে তোমার আচঁলে ।
আকাশের বিছানায় চাঁদ তখন ঘুমিয়ে পড়ে আলোর মশারিতে;
পাশা পাশি শুই পরস্পর কে ছুঁয়ে, আমার উতপ্ত শরীর শীতাপিত ।
এত কিছুর পরও….
আমার সোয়াস্তির দরজায় তোমার দুচোখ জাগিয়ে রাখো
যাতে এক চুল ব্যাঘাত না ঘটে আমার নিশিন্ত ঘুমের ।
ধন্য তুমি ধন্য
হঠাৎ দেখি কাক ভোরের আলোতে তোমার না খাওয়া
জরুরী ওষুধ পড়ে আছে অবহেলায় তোমার বালিশের তলায় ।
তখন ও তোমার হাত আমার হাতে। এ সংকোচ আমায় ভাবিয়ে তোলে ।
দুচোখ কষ্টের জলে উপচে পড়ে, নিজেকে ধিক্কারের আগুনে পুড়িয়ে দিতে ।
আমি কেন পারি না তোমার হাতে হাতে আমার হাত বাড়িয়ে দিতে ।
তোমার কষ্টের ভাগ নিতে ।
তুমিও তো পারো বলতে মুখ ফুটে ।
বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না তোমার ।
এ কি তোমার অবোধ ভালোবাসা ।
না তোমার অভিমান ? না আমার খামতি সবার নজর থেকে আড়াল রাখা ।
আজও
তোমার আদর শ্রমে সুখ সম্বৃদ্ধির ধান ফোটে আমার ঘর গেরস্থালীর সংসারে ।