স্বীকৃতি
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জি
টি.ভি.তে পরিচারিকাদের সংগঠনের মুখপাত্র সুনিতা রানে হিন্দিতে পরিচারিকাদের নানা সমস্যা, নানা অসুবিধার কথা বলে চলেছেন যার অধিকাংশটাই মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অনিমার। তিন পুরুষ ধরে অর্থাৎ অনিমার দিদিমা, অনিমার মা আর অনিমা লোকের বাড়িতে কাজ করে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, ছেঁড়া জীর্ণ পোশাক পড়ে লজ্জা নিবারণ করতে হয়, মদ্যপ স্বামীর চোখ রাঙানি ও মানবিক অত্যাচার মুখ বন্ধ করে সহ্য করতে হয়, তার ওপর নিরক্ষরতার অভিশাপ যাদের গায়ের লেবেল তারা লোকের বাড়িতে ঘর মোছা, বাসন ধোয়া, কাপড় কাচা এইসব কাজ করবে না তো কি করবে!
যে বয়সে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাবার কথা সেই বয়স থেকেই অনিমা লালমোহন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে কাজ করে খাচ্ছে। মাত্র তিনদিনের জ্বরে অনিমার মা মারা গেলে সহায়-সম্বলহীন নাতনির দু’মুঠো খাবারের জোগার করে দেয় লালমোহন বাবুর বাড়িতে অনিমার দিদিমাই। অনিমার দা মশাই যখন দ্বিতীয় বিয়ে করেন তখনই অনিমার দিদিমা স্বামীর ঘর ত্যাগ করে কাদারোডের বস্তিতে উঠে আসে। অনৈতিক কার্যকলাপের জন্য কাদারোড বিখ্যাত হলেও অনিমার দিদিমা কখনোই দেহব্যবসায় নামেনি। অনিমার মাকে নিয়ে বেনাচিতির নামকরা উকিল লালমোহন বাবুর চেম্বারে ঝাড়ু পোঁছা করে জীবন অতিবাহিত করতে শুরু করেছিলেন।
লালমোহন উকিল অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি। তিনি ওনার সহধর্মিনীর সাথে কথা বলে অনিমার দিদিমাকে নিজের বাড়িতে সবসময়ের পরিচারিকা কাজে বহাল করেন। সকাল আটটা থেকে রাত্রি আটটা। চারবেলা মা ও মেয়ের খাওয়া দাওয়া এবং একহাজার টাকা বেতন দিতেন উকিল বাবু প্রায় পনেরো বছর আগে। লালমোহন বাবুর স্ত্রী প্রথম প্রথম অনিমার মাকে লেখাপড়া শেখাতে চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন। বই খাতা থেকে ঝাড়ু, পোছাই বেশি পছন্দ ছিল অনিমার মায়ের। তবে লালমোহনবাবু স্ত্রীর কাছ থেকে সোয়েটার বানানোটা খুব ভালো শিখেছিল অনিমার মা। বস্তিতে অনেকে শিখিয়ে দিয়েছিল সে। বড় বাড়িতে বেশিরভাগ সময় কাটাতো বলে আদব-কায়দা, সহবত অনেক কিছুই রপ্ত করেছিল অনিমার মা।
পনেরোতে পা দেওয়া মাত্রই অনিমার মায়ের পাত্রস্থ করে তার দিদিমা। ছেলে অটোচালক। খাওয়া-পরার অভাব খুব একটা নেই। মোটামুটি ভদ্রস্থ মাপের বিয়ে দিতে পেরে অনিমার দিদিমা খুব খুশি ছিল। কিন্তু পোড়া ভাগ্য অনিমার দিদিমার। সুখ সহ্য হলো না। অনিমার তখন ছয় বছর বয়স হঠাৎ জ্বরে মারা গেল অনিমার মা। অনিমার বাবা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়ে করে বসল আবার। সুতরাং অনিমার জায়গা হল দিদিমার বাড়িতে। অনিমার দিদিমা উকিলবাবুর বাড়িতে কাজে যাওয়ার সময় অনিমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন রোজই। মা মরা নাতনিটিকে অত্যন্ত ভালবাসত তার দিদিমা। উকিলবাবুর স্ত্রীও অনিমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। বাগান থেকে ফুল তোলা, ঠাকুরের বাসন ধোয়া এইসব কাজ হাতে হাতে অনিমা ছোট থেকে করতে শুরু করে। লালমোহন বাবুর মেয়ের পুরনো বাতিল জামাকাপড়, জুতো এই সবকিছুর ওপর অনিমার ছিল অধিকার।
উকিলবাবুর মেয়েও চেষ্টা করেছিল অনিমাকে স্বাক্ষর করতে। কিন্তু অনিমাও বই-খাতা দেখলে পালিয়ে বেড়াতে। তবে কোনোক্রমে স্বাক্ষর হতে পেরেছিল অনিমা। এটাই ছিল তাঁর কাছে বিশাল গর্বের বিষয়। কুতিয়ে কুতিয়ে বাংলা যুক্তাক্ষর পড়তে পারতো। কিন্তু নিজের উন্নতির ব্যাপারে তার চেষ্টাও ছিল বড় কম। অনিমা ষোলোতে পা দেওয়া মাত্রই তার দিদিমা এক লোহা বিক্রেতার ছেলের সঙ্গে অনিমার বিবাহ দেন।বাংলাতে একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়’-এটি অনিমার দিদিমার জীবনে বারবার প্রমাণিত হয়।
সুন্দর চলছিল অনিমার সংসার। কোল জুড়ে একটা ফুটফুটে মেয়ে। অনিমার স্বামী নাম রাখে কুসুম। কুসুম যখন বছর তিনেকের অনিমার স্বামীর পায়ে টিটেনাস হয়। সেই ক্ষত ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। একবছর রোগব্যাধিতে ভুগে মারা যায় কুসুমের বাবা। শ্বশুরবাড়ির নিত্য লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে অনিমা ফিরে আসে দিদিমার কাছে। অনিমার দিদিমা আবারও অনিমাকে লালমোহন বাবুর বাড়িতে কাজে ঢুকিয়ে দেয়। লালমোহন বাবুর স্ত্রী এখন ভীষণ রকমের অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছেন। তেনার দেখভালের দায়িত্ব পায় অনিমা।
সকাল আটটা থেকে রাত্রি আটটা অনিমার কাজের সময়। লালমোহন বাবুর স্ত্রীকে ব্রাশ করানো থেকে শুরু করে রাতে বিছানায় তুলে দেওয়া পর্যন্ত তার কাজ। লালমোহন বাবুর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কাছে থাকে একমাত্র ছেলে ও তার স্ত্রী এবং তাদের ছোট্ট একটি মেয়ে। লালমোহন বাবুর ছেলে ও বৌমা দু’জনেই কর্মজীবী। সুতরাং লালমোহনবাবুর স্ত্রীর পাশাপাশি নাতনির দেখভাল করে অনিমা।
দেখতে দেখতে বাইশটা বছর পার করলো কুসুম। মা, দিদিমার মত বই খাতা দেখলে পালাতো না সে। বরং সারাদিন বইখাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালবাসত কুসুম। ফিরিঙ্গি স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে, দুর্গাপুর গভমেন্ট কলেজ থেকে ইংলিশ অনার্স পাস করে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেগুলারে এম.এ পড়ছে সে। বর্ধমান থেকে দুর্গাপুর যাতায়াত করেই পড়াশোনা করে কুসুম। মায়ের মাত্র পাঁচ হাজার টাকার মাইনেতে হোস্টেলে থাকা যায় না এটা কুসুম জানে।
আজ টিভিতে সুনিতা রানের সাক্ষাৎকারটা বসে দেখছিল কুসুমও। একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষে গৃহকর্ম সহায়িকাদের না আছে যোগ্য সম্মান, না আছে যোগ্য প্রাপ্য। এখনো অবধি পৃথিবীর একুশটি দেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের কনভেনশন মেনে নিলেও ভারত মেনে নেয়নি। তাইতো ভারতের প্রায় ষোল লক্ষের বেশি সহায়িকাদের নেই কোনো আইনি সুরক্ষা।
যদিও ২০১৩ সাল থেকে ‘সেক্সুয়াল হারাসমেন্ট অফ উইমেন অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস এ্যক্ট’কে মান্যতা দিয়েছে ভারত তবুও আজও গৃহকর্ম সহায়িকার বঞ্চিত তাদের যথাযোগ্য ন্যায্য অধিকার থেকে। তাদের না আছে নির্দিষ্ট ছুটি, না আছে ওভার টাইম এর মূল্য। তাদের সাথে আমরা অনেক সময়ই ক্রীতদাসদের মতো ব্যবহার করি। এইসব কথা খুব মন দিয়ে শুনছিল কুসুম। চা রুটি খেতে খেতে অনিমাকে বলে ওঠে সে- ‘মা তুমি আজ আর কাজে যেও না। আমার আজ ক্লাস নেই। তুমি আমি দু’জনেই বাড়িতে থাকব। কত দিন দুপুরে একসাথে আমরা খাই নি বল?’
– দূর, কি যে বকছিস সকাল থেকে তুই কুসুম। আমি যদি না যাই কাজে তাহলে গিন্নিমার খুব অসুবিধা হয়ে যায়। বয়স হয়েছে তো তার ওপর অসুস্থ। একা একা সব কাজ পেরে ওঠেন না।
– কেন, উনার স্বামী, সন্তান, পুত্রবধূ সবাই তো আছে। তাদের কি উচিত নয় ওনার দেখভাল করা। মাসে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে সব দায় দায়িত্ব থেকে তারা নিষ্কৃতি পেয়ে গেল। তুমিও তো মানুষ মা। তোমারও তো শরীর। এইতো সেদিন রাতে তোমার জ্বর ছিল তাও সকালে ঠিক কাজে চলে গেলে। এক দিনও কি বিশ্রাম নেওয়া যায় না।
– অনিমা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে কুসুম আমরা যে কাজের লোক। বাবুদের দয়াতেই তো তোকে এত বড় করলুম। এ কথা ভুলিস না।
– বাবুরা তো তোমাকে শুধু দয়া করে না মা। তার জন্য তুমি বারো ঘন্টা লালমোহনবাবুর বাড়িতে কাজ করো। একজন কর্মীর বারো ঘন্টা কাজ করার বেতন কি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। ওনারা তোমার শ্রমের যথাযথ মূল্য কি দিচ্ছে মা। ক্রীতদাসীর মতো তো তোমাকে খাটিয়ে নিচ্ছে।
আজও আমরা মানসিকতায় ততটা উন্নত হতে পারিনি যে প্রত্যেক মানুষকে তার যথাযোগ্য সম্মান প্রদান করব। আসলে জঙ্গলের বাস্তুরীতির মতোই আমাদের সমাজের বাস্তু রীতি চলে আসছে। দুর্বলের উপর সবলরা অত্যাচার চালিয়ে আসছে। এই পরিস্থিতি, মানসিকতার কোনদিন পরিবর্তন হবে না মা?
– দেখ কুসুম, আমি তোর মত এত লেখাপড়া শিখি নি। তবে এইটুকু বুঝি যখন কঠিন বাস্তব আমার দিকে রূঢ় হাসি হাসছিল, মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমি গরিব সহায়-সম্বলহীন এক বিধবা, আমি অশিক্ষিত, আমার খেটে খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করবার নেই, তখন কিন্তু লালমোহনবাবু আমাকে কাজে রেখে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করে দিয়েছিলেন সম্মানের সাথে আমাদের মা মেয়েকে। আমার শ্রমের তুলনায় ওনারা আমায় কম বেতন দেয় কিন্তু যখনই আমি অসুবিধায় পড়েছি তখনই ওনারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। হয়তো ওনাদের মত সকল বাবুরা হন না। কিন্তু যে বাড়িতে আমি দীর্ঘদিন কাজ করছি তাদের সাথে শুধুই টাকা সম্পর্ক? তোর বোর্ডের পরীক্ষার সময় গিন্নিমা মন্দিরে পুজো দিয়ে আসেনি? তুই পাটিসাপটা খেতে ভালবাসিস বলে গিন্নিমা তোর জন্য আলাদা করে তুলে রেখে দেয় সব সময়। পাছে যদি ফুরিয়ে যায়। এরপরও তুই বলবে ওরা আমাকে ঠকাচ্ছে!
– মা রাগ করোনা। আমি শুধু তোমার কথা বলছি না। আজও আমাদের ভারতবর্ষে গৃহকর্মের সহায়িকাদের বেতন তাদের শ্রমের তুলনায় খুবই কম। আসলে মা আমরা এখনো প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছিনা। উঁচু-নিচু ভেদ, জাতের ভেদ সব সময় উঁকি মারে আমাদের মানসিকতার মধ্য থেকে। যেদিন আমরা মানসিকতায় স্বনির্ভর হবো সেদিন আমরা গৃহপরিচারিকাদের সময়ের যথাযোগ্য মূল্য ধার্য করতে পিছপা হব না। প্রতিটি অঞ্চলে গৃহপরিচারিকাদের নিয়ে গড়ে উঠবে গৃহকর্ম সহায়িকার অ্যাসোসিয়েশন। প্রতিটি পরিচারিকা সেদিন সজাগ হবে তাদের অধিকার নিয়ে।
– অনিমার দু’ চোখ দিয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। তার কুসুম আজ কত বড় হয়ে গেছে। অনিমা কুসুমকে বলে যেদিন আমাদের দেশের প্রতিটি গৃহপরিচারিকা তোর মত মেয়ে জন্ম দিতে পারবে সেদিন নিশ্চয়ই ‘কাজের মাসি’ বলে তাদেরকে কেউ ছোট করে ডাকবে না। তারা যেদিন তাদের শ্রমের যথাযথ মূল্য পাবে সেদিন থেকে তারা স্বীকৃতি পাবে ‘মহিলা শ্রমিক।’ উঠি রে মা, অনেক বেলা হয়ে গেল। লালমোহন বাবুর স্ত্রীর পুরনো চামড়ার জুতা পায়ে গলিয়ে অনিমা নিজের কাজে রওনা হল।