Site icon আলাপী মন

গল্প- বর্ষার আগমন

বর্ষার আগমন
– রাখী চক্রবর্তী

 

 

বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কাল বৈশাখীর ঝড় বৃষ্টি হবে নিশ্চিতই। এই তো সময় ঝড় বৃষ্টি হওয়ার। ঈশান কোনে মেঘের ঘনঘটা দেখে, মন তো তাই বলে। কিন্তু অমল তো এখনও বাড়ি ফিরল না। সেই কখন গেছে বৌমাকে নিয়ে ডাক্তার এর কাছে। পোয়াতি বৌ রাস্তা ঘাটে যেন আবার বিপদ না হয়।
“আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দেব মেপে “… 

-এই তোরা ঘরে যা। যত সব বদমাইশ ছেলে পুলে। আমি মরছি ছেলে,বৌমার চিন্তায়।আর এরা আমার বাড়ির সামনে এসে হৈ হট্টগোল করছে। এই যা বলছি।

“সন্ধ্যা ভিলা”র সদর দরজায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা বৌদি এক মনে বকবক করে যাচ্ছে।আমি তখন টিউশন করে বাড়ি ফিরছিলাম।
ও বৌদি এখন এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?বাড়িতে সবাই ভালো আছে তো? এ পাড়ার সবাই জানে সন্ধ্যা বৌদি খুব চিন্তা করলে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে আর নিজের মনেই বকবক করে।

-হ্যাঁ ঠাকুরপো। অমল বৌমাকে নিয়ে কখন গেছে ডাক্তারের কাছে। এখনো এল না।

– তুমি এত ভেবো না। ওরা ঠিক চলে আসবে। ঘরে যাও। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।

গত বছর এইরকম ঝড় বৃষ্টির দিনে অমল ওর সন্তান সম্ভবা বৌকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরছিল। বৃষ্টিতে রাস্তা ঘাট খুব পিছল ছিল। অনামিকা গাড়ি থেকে নেমে এক পা এগোতে গিয়েই পা পিছলে পড়ে গেল। অমল গাড়িভাড়া মিটিয়ে পেছন ফিরেই দেখে রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা।অনামিকা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। হসপিটালে নিয়ে যাবার আগেই। সব শেষ হয়ে গেল।

অমলের স্বপ্ন, সন্ধ্যা বৌদির ছটফট নাতি নাতনির স্বপ্নই থেকে গেল, থমকে গেল ওদের জীবন।
তারপর থেকেই সন্ধ্যা বৌদি ঝড় বৃষ্টির আভাস পেলেই সদর দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। বৌমা যদি হঠাৎ করে বাড়ি ফেরে, দরজা বন্ধ দেখলে, যদি ফিরে যায়।একবছর হয়ে গেল তবুও সন্ধ্যা বৌদির মনের পরিবর্তন এতটুকু হয়নি।অমলও কেমন চুপচাপ থাকে সবসময়। পিতৃ সুখ যে ও কখনো পাবে না। ডাক্তার বাবু তো আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন অমল আর কোনদিন বাবা হতে পারবে না। অনামিকা- অমল জানত আগত সন্তানই হবে ওদের শেষ সম্বল। একটি মাত্র সন্তানকে নিয়েই ওরা সুখে থাকবে। কত স্বপ্ন দেখেছিল ওরা। বিধাতা কার কপালে কি লিখেছে সে তো আর কেউ জানতে পারে না। তা না হলে এত সাবধানে থেকেও অনামিকার কেন এই দূর্ঘটনা হল। অমল অফিস আর বাড়ি এই দুই নিয়ে থাকে। এছাড়া আর কোন কিছুতেই ওর মন নেই। মাকে সামলাতে ওর দিন রাত কেটে যায়।অমল ওর মার জন্য খুব চিন্তা করে, সারাটা দুপুর সন্ধ্যা বৌদি একা থাকে। তারজন্য অমল একটা কাজের মেয়ে ঠিক করেছে। সকাল বেলায় আসবে রাতে অমল বাড়ি ফিরলে কাজের মেয়েটি চলে যাবে।
পরের দিন খুব সকালে চামেলি কাজে এল সাথে দুই বছরের বর্ষাকে নিয়ে।সন্ধ্যা বৌদি খুব রেগে গেছে চামেলির ওপর। -আমি যে বাচ্চা পছন্দ করি না তা অমল বলেনি?
চামেলি বলল, মা একরত্তি মেয়েকে কার ভরসাতে রেখে আসব? ওর বাপটা অমানুষ। একা পেয়ে কোনদিন বেচে দেবে মেয়েকে।
সন্ধ্যা বৌদি গজগজ করতে করতে ঘরে চলে গেল।চামেলি রোজ নিয়ে আসে বর্ষাকে।সন্ধ্যা বৌদি আড়াল থেকে শুধু দেখে বর্ষাকে। আদর করে না। কথাও বলে না।একদিন দুপুর বেলায় সন্ধ্যা বৌদি হঠাৎ ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল। কে? কে! অমন করে গান গাইছে?

দুপুরে ভাত ঘুমের অভ্যাস সন্ধ্যা বৌদির বরাবরের।আদো আদো গলায় বর্ষা গান গাইছে “বিততি পলে টাপুল টুপুল নদে এল বান থিব ঠাকুলের বেয় হল তিন তননা দান”।
সন্ধ্যা বৌদি দরজার সামনে দাড়িয়ে ওর গান শুনছে।যেই বর্ষার গান শেষ হল তখন সন্ধ্যা বৌদি বলল,
– কিরে বর্ষাকে শেখাল এই গানটা? বর্ষা খিলখিল করে হেসে একলাফে সন্ধ্যা বৌদির কোলে উঠে পড়ল। সন্ধ্যা বৌদি যেন দু’হাত বাড়িয়েই ছিল। কি আদর না করল বর্ষাকে, চামেলি সব আড়াল থেকে দেখছে আর ওর চোখের জল দু’ গাল দিয়ে ঝরে পড়ছে।
সন্ধ্যা বৌদিকে আজ খুব খুশি দেখাচ্ছে।অমল বাড়ি ফিরতেই সন্ধ্যা বৌদি চামেলিকে বলল,- এবার থেকে অত তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া চলবে না তোর।অনেক রাত্রিরে বাড়ি যাবি। বেশি রাত্রি হলে থেকে যাবি এখানে। বর্ষাকে নিয়ে রাত করে বাইরে বের হবি না। কত রকম হাওয়া বাতাস আছে।
অমল খুশি হল মার কথা শুনে।অমল চামেলিকে বলল,- আমার মা আজ থেকে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরল। তোমার মেয়ের দায়িত্ব আমি নেব।
– দাদাবাবু আমি মরেও শান্তি পাব। আমি খুব খুশি দাদাবাবু।
-দাদা বলে ডাকছ যখন বোন হয়েই থাকো আমাদের বাড়িতে।

সে দিন খুব সকালে আমি কাজে যাব বলে বের হয়েছি, বৌদিকে দেখে ভাবলাম আরে এত সকালে সন্ধ্যা বৌদি!
– ও সন্ধ্যা বৌদি এত সকালে ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
– হারমোনিয়াম কিনতে। বর্ষার গান শুনতে হলে আজ রাতে আমাদের বাড়িতে এসো।

তাহলে বৌদি স্বাভাবিক হয়ে গেল। খুব ভালো লাগলো বৌদিকে দেখে।পরের দিন পাড়ার সব বাচ্চাদের নিয়ে সন্ধ্যা বৌদি অনেক আনন্দ করল। আর বলল, তোরা আমার বাড়ির সামনে খেলবি গান গাইবি,আর হ্যাঁ, বর্ষাকে কিন্তু কেউ বকবি না।

বর্ষা হাততালি দিয়ে নেচে নেচে কি আনন্দ করছে।অনামিকার ছবি হাতে নিয়ে অমল চুপ করে বসে আছে, হয়তো ভাবছে মার অলীক স্বপ্ন পূরণ হল। আজ অনেক দিন পর অমল বিকেলের আকাশটার দিকে তাকালো,সূর্যের লাল আভায় চিকচিক করে উঠল ঈশান কোনে জমে থাকা এক টুকরো মেঘ। বর্ষার আগমনে মেঘও যেন রাঙিয়ে নিল নিজেকে।

Exit mobile version