প্রবন্ধ- জনকজননী

জনকজননী
-শচীদুলাল পাল

 

 

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী”
জন্মের পর ভূমিষ্ট সন্তান ‘ওঁয়া’ প্রথম উচ্চারনে চীৎকার করে জানিয়ে দেয় তার আগমন বার্তা। “ওঁয়া” বা মাঁ শব্দটি চিরন্তন । বিশ্বের যত ভাষা আছে সদ্যজাতের প্রথম উচ্চারিত এই একটিই শব্দ”মাঁ”।ক্ষিদে পেলে ,প্রসাবে কাপড় ভিজে গেলে রোগ যন্ত্রণায়, আদরে স্নেহের আবেদনে,মায়ের সান্নিধ্য লাভের জন্য শিশুর অস্ত্র একটায়। ” মাঁ’!
গর্ভে থাকাকালীন মায়ের খাবার পুষ্টি শ্বাস প্রশ্বাস অক্সিজেন গ্রহণ সবকিছু মা করেন এবং সবই শিশু একশ শতাংশ লাভ করে।
প্রসুতি গৃহে জন্মের পর যদি সদ্যজাত যদি না কাঁদে এবং মা না বলে তাহলে এক ভয়ার্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়।
তখন পাছায় থাপ্পড় দিয়ে জোর করে ওঁয়া বা মাঁ বলানো হয়।যদি ওঁয়া বা মাঁ বলতে পারে তবেই সে জীবিত। বৈজ্ঞানিক মতে প্রথম অক্সিজেন গ্রহণ ওই ওঁয়া বা মাঁ শব্দ দিয়ে।জ্যোতিষ মতে সেই মাঁ শব্দটি প্রথম উচ্চারন করছে সেটিই তার জন্ম সময়।
মা শব্দটির মধ্যে বিধাতা যেন বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল সৌন্দর্য, সকল স্নেহ, সকল আকুলতাকে বন্দি করে দিয়েছেন। আমাদের সকলের জীবনেই মা শব্দটি যেন রক্ষাকবচ।

তাই তো যাদের মা থাকে তাদের আর কবচকুন্ডলের প্রয়োজন হয় না। শৈশব কৈশরের দিনগুলি তো পুর্ণ থাকে মা নামের রক্ষাকবচে, তা সে মা গর্ভধারিণী মা-ই হোন, আর পালিতা মা-ই হোন। মা মানেই এক মায়াবী স্নেহময়ী অবস্থান। সন্তান মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও মা কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করেন না। কথাতেই আছে, ‘কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়’। মা এক বিশাল বটবৃক্ষ। ফলফুল পাখির কূজনে যে আমাদের জীবন ভরিয়ে রাখে। জীবনে চলার পথে প্রতি মুহূর্তেই সঙ্গী থাকে সেই অজেয় অক্ষয় অনুভূতি। পরিণত বয়স পেরিয়ে একটা সময় মানুষ খুঁজে বেড়ায় সেই সুশীতল স্নেহ স্পর্শ। প্রতি মুহূর্তে সেই স্নেহময় আশ্রয়স্থল হলেন মা।
যৎ প্রসাদাং জগদৃষ্টং পূর্নোকামো যদাশিষা
প্রত্যক্ষ দেবতা তাসৌমে তস্যে মাত্রে নমঃ নমো।
অর্থাৎ যার অনুগ্রহে আমি এই জগৎ দেখতে পেয়েছি, যার আশীর্বাদে আমার কামনা পূর্ণ হয়েছে আমার প্রত্যক্ষ দেবতা সেই জননীকে বারবার প্রণাম করি।

পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমন্তপঃ।
পিতাহি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা।
এর অর্থ হচ্ছে.-
“পিতা স্বর্গ, পিতাই ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যা। পিতাকে খুশি করলে সকল দেবতা খুশি হন।”
আমরা সাধারণ মানুষ দেবতাকে চাক্ষুষ দেখি নি।কিন্তু সাক্ষাৎ পিতামাতাকে দেখেছি। সুতরাং আমদের উচিৎ পিতামাতাকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করা।

পর্দার আড়ালে নিভৃতে একজন বাবা আয়ের পিছনে ছোটেন তার সন্তানের ভালোটা তুলে দেবেন, তাকে ভালো ভাবে মানুষ করার জন্য।বাবার ঔরসে সন্তানের জন্ম। জিনে (ডি এন এ) তে সব চরিত্র, সব কিছু কাঠামো, অবয়ব পিতা থেকে লাভ করেন। সন্তান হচ্ছে পিতার প্রতিনিধি। বাবার মৃত্যুর পর সন্তান প্রতিনিধি হিসেবে থেকে যাবে এই জগতে।
পিতা তার কর্তব্য কর্ম নিষ্ঠার সাথে অলক্ষে পালন করে চলে। মঙ্গল কামনায় পিতা সর্বাগ্রে এগিয়ে চলে। প্রতিকুল পরিস্থিতিতে পিতায় একমাত্র এগিয়ে আসে।সন্তানকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পিতা বুক চিতিয়ে দেয়।হয়তো সন্তান কে হত্যা করতে এসেছে সেখানে পিতা গুলির সামনে নিজেকে এগিয়ে দেয়।সন্তানের কঠিন অসুখে রোগ ব্যাধিতে বাবা তার সব কিছু দিয়েও সন্তান কে সুস্থ করতে প্রাণপন প্রচেষ্টার ত্রুটি রাখেনা।জমি জমা ঘরবাড়ি বিষয় সম্পত্তি সে পরবর্তী প্রজন্মের জন্যই লড়াই করে রেখে যায়। মামলা মোকদ্দমা লড়ে।বাবা ত জানে তার মৃত্যুর পর সে ত কিছুই নিয়ে যাবে না। সেত সব কিছু সন্তানের জন্যই রেখে যাবে।

বিদ্যালয়ে ও সর্বত্র পিতৃপরিচয় অবশ্যম্ভাবী। স্বামীহীনা কুমারী জবালার পুত্র সত্যকামকে প্রথমে বেদপাঠ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। সে পিতৃ পরিচয় জানতে ছুটে গিয়েছিল মা জবালার কাছে।
পিতৃপরিচয় হীন সন্তান সমাজের চোখে অপাংক্তেয়। তাদের স্থান হয় ডাস্টবিনে বা অনাথালয়ে।
বর্তমানে অবশ্য আইনানুসারে মায়ের নাম লিখলেও স্কুলে ভর্তি নেবে।
পুত্রকে লাঠির সাথে তুলনা করা হয়েছে। অন্ধ খঞ্জের যেমন লাঠি তার অবলম্বন তেমনি পিতার শেষ বয়সে অবলম্বন পুত্র।কিন্তু বাবা তার নিজের সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করে দূরদেশে বা বিদেশেও পাঠিয়ে দেয় সন্তানের উন্নতির জন্য। তখন সে অবলম্বনের কথা একটুও ভাবে না।
বর্তমান সমাজে খুব কমই সন্তান পিতা মাতার সাথে থাকে।বিয়ের পর বিভিন্ন কারনে আলাদা থাকতে বাধ্য হয়।বিয়ের পর পুত্র বউমার বশীভূত হয়।বউমার মনোরঞ্জনের জন্য, এডজাস্টের অভাবে
জেনারেশন গ্যাপের শিকার হয়।সেকেলে চিন্তার দোহাই দিয়ে বাবাকে আলাদা করে দেয়।বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়।
সচরাচর দেখা যায় শাশুড়ি বউমার ঝগড়া। এর পিছনে রয়েছে ভালোবাসা। মা তার পুত্রকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। অন্যের বাড়ির একটা মেয়ে বউ হয়ে এসে যখন ভালোবাসার ভাগ বসায় সেটা মা সহ্য করতে পারেনা।যে ছেলে মাকে ভালবাসত বিয়ের পর সে বউয়ের কথামতো চলে মা সেটা সহ্য করতে পারেনা। আর সেখানেই সংঘাত। পরিনাম ঘরে ঘরে অশান্তি।
ভালোবাসা নিম্নগামী ও বিতরণী।
একটা সন্তান প্রথমে ভালোবাসে তার মা বাবা কে।পরে নেমে আসে স্বামী স্ত্রীতে। পরে সন্তানে। আরোও নেমে নাতি নাতনিতে।সংসারের এই নিয়মকে মেনে না নিলে নেমে আসে মানসিক রোগ।
মনোবিকলন।এই প্রসঙ্গে একটি সত্য ঘটনা লিখি।
এক মা তার মেয়েকে প্রাণাপেক্ষা বেশি ভালবাসতো।একদিন মেয়ের বিয়ে দিল। জামাই এলো। মেয়ে জামাইকে ভালবাসত।মা একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগল।আগে মেয়ে মায়ের কাছে শুতো। এবার সে নিয়মানুসারে জামাইয়ের সাথে এক বিছানায়।
মা তাদের ঘরে নিত্য আড়ি পাততো।কি ( চাবি)হোল থেকে দেখত।উদ্ভট দেহ মিলন দেখতো।মা মনে করতো জামাই তার মেয়েকে নির্যাতন করছে। সেটা তার সহ্য হতো না। এক রাতে মা আঁশবটি দিয়ে জামায়ের গলার নলি কেটে হত্যা করেছিল। বিচারালয়ে সে তার জবানবন্দিতে এ কথা স্বীকারও করেছিল।
জগতের শ্রেষ্ঠ প্রেম হলো পিতামাতার সন্তানের উপর প্রেম।নির্মল পবিত্র।
পিতামাতার অবদান কখনো কোনো কিছুর বিনিময়ে শোধ করা যায়না।
শোধ করার দরকার নেই।শুধু শেষ জীবনে একটু আশ্রয় একটু শান্তি একটু সহানুভূতি, প্রেম,অবলম্বনের আশ্বাস ই যথেষ্ট। কিন্তু বর্তমান অবক্ষয় সমাজে এ সবের বড়ই অভাব। তাদের চোখের জলে বর্তমান সমাজ কর্দমাক্ত। অসহিষ্ণুতায় ভরে গেছে সংসার।
যুধিষ্ঠির যুদ্ধে জয়লাভ করে হস্তিনাপুরে রাজা হবার পর প্রথম কাজ ছিল ধৃতরাষ্ট্র জ্যেঠামশায়ের দেখভাল।তার প্রতি শ্রদ্ধা সহ সমস্ত আরাম।দুর্যোধনের রাজত্ত্ব কালের অপেক্ষা যুধিষ্ঠিরের রাজ্যে অধিক শান্তিতে শেষজীবন কাটিয়েছিল ধৃতরাষ্ট্র।
ফ্রয়েডের মতে পিতাপুত্রী ও মা- পুত্রের সাথে ভালোবাসার টান চিরন্তন।
একটা ছেলে বাবার মুখ উজ্জ্বল করেনা। গোল্লায় গিয়েও পিতার মুখে চুনকালি দেয় না। কারন সবাই এই ধারনা করে যে বাপটা ত ভালো ছেলেটা গোল্লায় গেছে।
আবার একটা মেয়ে বিয়ের পর শশুর বাড়ি গিয়ে শুনতে হয় তুমি কেমন বাপের মেয়ে যে এসব জানোনা। কিংবা বংশ ভালোনা। ভালো কিছু কাজ করলে সেই বাবামায়ের মুখ উজ্জ্বল করে।
আবার একটা মেয়ের বাবা যতই নিরক্ষর গরীব সমাজবিরোধী হোকনা কেন সে বাপের বদনাম সহ্য করতে পারেনা। তার কাছে তার পিতা ও শিশু সন্তান মহান।
কোনো বউএর মন জয় করার সহজ উপায় বউটির বাবার খুব প্রংশসা করুন। তার শিশু সন্তানের অষ্টোত্তর শতনামের ন্যায় গুনগান করুন দেখবেন বউটি আপনার খুব প্রিয় হয়ে গেছে।
শিশু সহ স্বামী পরিত্যক্তা কোনো মেয়েকে আশ্রয় দেন এবং ছলচাতুরী নাকরে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন সে আপনার অত্যন্ত প্রিয় হবে।সারাজীবন আপনার প্রশংসা করবে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া আষাঢ়ের মেঘের বৃষ্টি র মতো। এই আছে এই নেই। সেখানে বাবা মা শশুর শাশুড়ির মাথা গলানো উচিৎ নয়।( অত্যধিক নির্যাতিত হলে ব্যতিক্রম)।
পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্য্যা।বংশ রক্ষার্থে পুত্র।
পুত্রের হাতে আগুন রথকে যে স্বর্গ থেকে নেমে আসতেই হবে।
তাই ছেলের সর্বশেষ কর্তব্য পিতামাতার মুখাগ্নি। বা অন্তেষ্টিক্রিয়া। এইজন্য মৃতদেহকে সংরক্ষিত রাখতে হয়।রামায়নে রাজা দশরথের মৃত্যুর সময় ভরত মামারবাড়িতে ছিল কেকয়রাজে।দ্রুতগামী ঘোড়ায় ভরতকে নিয়ে আসতে সময় লেগেছিল ১৪ দিন।এই চোদ্দ দিন দশরথের মৃতদেহ গরম তেলের কড়াইয়ে রাখা হয়েছিল।
বর্তমানে মৃতদেহ হাসপাতালের ডিপ ফ্রিজে রাখার ব্যাবস্থা আছে। ছেলে আমেরিকায় বা বিদেশ থেকে এসে মুখাগ্নি করবে বলে। ভিন্নধর্মাবলম্বী মনুষ্যসমাজ ভিন্ন পদ্ধতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য সন্তানের উপস্থিতি কামনা করে।
সারাজীবন অবহেলিত বঞ্চিত নির্যাতিত হলেও বাবা মা শেষদিনের এইটি কামনা করে প্রাণত্যাগ করে।

Loading

One thought on “প্রবন্ধ- জনকজননী

Leave A Comment