অথ দন্ত কথা
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
দাঁত। কি বলবো মশাই , মানব শরীরের এক অদ্ভুত জিনিস।
দাঁত, থাকলেও জ্বালা , না থাকলেও…
দাঁত থাকতে আমরা নাকি তার মর্ম বুঝিনা ? আমি মানলুম না। হাড়ে হাড়ে মর্ম বুঝি। বুঝিনা মানে , ইয়ার্কি করার জায়গা পাওনি , চালাকি!
জামাই ষষ্ঠী । মেয়ে জামাই যথারীতি নিমন্ত্রিত । বিগত তিন দিন যাবৎ গিন্নীর যাবতীয় ফরমায়েশ আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছি। এই চাই তাই চাই , এটা আনো সেটা আনো।
ফর্দ ফুরোয় না। ফল মিষ্টি মাছ মাংস দেরাদুন রাইস সোনামুগ ডাল পনির আরও নানাবিধ আধুনিক দ্রব্য , সব নাম জানিনা , নিউমার্কেট ছাড়া নাকি সে সব জিনিস পাওয়া অসম্ভব।
পাড়ার আসপাশের হরিমুদির আটপৌরে দোকানদার নাকি বাপের জম্মে সেসব জিনিসের নাম শোনেনি।
ঠিক আছে বাপু , তাই সই , চলো নিউমার্কেট। ভাগ্যিস নিউইয়র্কে যেতে বলেনি। বললে কি হতো , ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়।
যাক, যেকথা বলছিলুম , দাঁত । কি মর্মান্তিক ব্যাপার ভাবতে গেলে কান্না পায়।
এতো খাটাখাটুনি করে রাজ্যের জিনিস ঘুরে ঘুরে ঘাম ঝরিয়ে টাকা খসিয়ে যোগাড় করে নিয়ে এলুম। এলাহি আয়োজন রান্নাবান্না কমপ্লিট । খাবার টেবিলে সার দিয়ে সাজানো।
পঞ্চব্যঞ্জনের জিভে জল আনা গন্ধ ,
চারিদিকে ম ম করছে।
মেয়ে জামাই সহ আরও নিমন্ত্রিত অতিথি সমারোহে সারা বাড়ি গমগম করছে।
ওফ চিংড়ি মালাইকারীটা যা হয়েছে না,, ফাটাফাটি…
কেন, মটন কষা ! মারভেলাস। ফ্রায়েড রাইসের জবাব নেই।
আমি চুপচাপ কেবল শুনে যাচ্ছি। উপায় নেই রে ভাই , উপায় নেই। আমার কপালে শুধু দেখা শোনা আর গন্ধ শোঁকা ছাড়া আর কিচ্ছুটি নেই।
নিচের পাটির তিন নম্বর , আর উপর পাটির পাঁচ নম্বর , হেভিলি ড্যামেজ। মুখে জল পর্যন্ত নিতে পারছি না। মাড়ি ফুলে আলু। মুখে কিছু দিলেই , যাই যাই অবস্থা। যেন ফোরফর্টি ভোল্ট কারেন্ট মারছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে , ব্যথা না কমা অবধি কিচ্ছুটি করা যাবে না। নুন জলে কুলকুচি আর এন্টিবায়োটিক ।
হায়রে হবার আর টাইম পেলি না। কেন রে বাবা , দুদিন পরে হলে কি এমন মহাভারত বিগড়ে যেতো ! নিজের হাতে বাজার করে এনে , এখন জুলজুল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিচ্ছু নেই। নিজেই নিজের মন কে বোঝাচ্ছি …
লোভ করে না সোনা । লোভে পাপ, পাপে যন্ত্রণা। একটু ঠিক হয়ে নাও , তারপর যতখুশি খেও।
জামাই বাবাজী কাটা ঘায়ে নুনেরছিটে দিচ্ছে…
বাবা একটু খাবার চেষ্টা করলে পারতেন- মানে একটু টিপেটাপে নরম করে নিয়ে যদি…
মনেমনে বললুম ….
ওরে আহাম্মক , পারলে কিআর ব্যাঙের মতো চেয়েচেয়ে তোর কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া দেখি ? আমি কি লোভমুক্ত সন্ন্যাসী ?
কি কপাল , ওফ,, চোখের সামনে গাদাগাদা মুখরোচক খাবার , পেটে ক্ষিধে গজগজ করছে । অথচ খাবার উপায় নেই। দাঁতের ব্যথার ব্যারিকেড টপকাতে পারলুম না। জীবনের এক মোক্ষম শাস্তি।
কেউ দাঁত নিয়ে জন্মায় না। সব্বাই ফোকলা জনম পায়। আমার মাঝেমাঝে মনে হয় , আমাদের যেখান থেকে এই ধরাধামে পাঠানো হয় , সেখানে দাঁতের স্টক খুব কম। নইলে মানব শরীরের যাবতীয় সব কিছু চলে এলো , শুধু দাঁত এলো না ! দাঁতের ডিউ স্লিপ , কেন? সেই দাঁত সাপ্লাই এলো , বেশ কিছুদিন পরে। তাও আবার একসঙ্গে নয়, দফায় দফায়।বাই ইনস্টলমেন্ট।একখানি দুখানি করে , ওপর পাটি , নিচের পাটিতে দেখা দিচ্ছে।
দুধের দাঁত। তারমানে এগুলো পারমানেন্ট নয়। সময় অন্তে দুধের দাঁত বিদায় নিলে , আসবে কড়মড়ে দাঁত। সঙ্গে আক্কেল দাঁত। এবার বুঝবে ঠ্যালা , দাঁতের মর্যাদা কাকে বলে। বত্রিশ দাঁতের ছত্রিশ ব্যামো।
ডাক্তার বাবু বাঁচান,, যন্ত্রণার ঠ্যালায় যে গেলুম…।
দেখি, হাঁ করুন বড়ো করে…হুঁ… বেশ ভালোই বাঁধিয়েছেন…কি করবেন… রাখবেন নাকি ফেলবেন..?
আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করুন , আর যে পারিনা । খাওয়া বন্ধ , ঘুম নেই , যন্ত্রণার জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত… বাপরে বাপ। ও পাপ থাকার চেয়ে যাওয়াই ভালো…
গেল , কড়মড়ে প্রাপ্তবয়স্ক বয়স্ক দাঁতের একটি ব্যথা দিয়ে চলে গেল। আর ফিরবে না। প্রাপ্তবয়স্ক গেলে আর ফেরে না। শুধু স্মৃতি থেকে যায়।