অনুভব
– রাখী চক্রবর্তী
– হৃদয়ে গাঁথা আছে যে নাম সে নাম কি এত সহজেই ভোলা যাবে। আর একটু সময় দাও তিতলি, আমি ঠিক মুছে ফেলবো তোমার স্মৃতি আমার মন থেকে চিরতরে। তবে মরণের পরে কথা দিলাম তিতলি তোমাকে।
– তোমার বোঝা উচিত ছিল দীপ, তিতলি কখনও এক ফুলে সন্তুষ্ট থাকে না। এ ফুল থেকে ও ফুল, ও ফুল এ ফুলেই ঘুরে বেড়ায় তিতলি। তোমাকে আঘাত দিতে চাইনি আমি। তাই বিয়েটা করতে পারলাম না তোমাকে। অবিনাশের সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তুমি তো জানো অবিনাশ কতো বড়ো ঘরের ছেলে।
– তিতলি আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।যেও না আমাকে ছেড়ে তিতলি…
– ডাক্তার বাবু দীপের জ্ঞান ফিরছে। ঐ দেখুন তিতলি বলে চিৎকার করে উঠল।
– হ্যাঁ এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন পেশেন্ট। তবে খেয়াল রাখবেন ওনার, খুব বেশি করে। এ সব ক্ষেত্রে পেশেন্ট আবার ট্রাই করতে পারেন। নজরে রাখতে হবে পেশেন্টকে। আপনি তো দীপ বাবুর জামাইবাবু। আগে কিছু টের পাননি?
– না ডাক্তার বাবু। দীপ খুব ভালো ছেলে। একটি মেয়েকে ও ভালবাসে। তার সাথেই তো আমরা ওর বিয়ের ঠিক করছিলাম। কেন যে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করল? তা এখনও আমি বা বাড়ির লোকজন কেউ বুঝতে পারলাম না। আমি একবার তিতলির সাথে কথা বলব।
– তিতলি কে?
– দীপের ভালবাসা তিতলি। কতো আয়োজন করেছিলাম গতকাল। আই মিন তিতলিকে নেমন্তন্ন করেছিলাম আমি। বললাম, বিয়ের আগে হবু শ্বশুর বাড়ি দেখে যাও তিতলি। তিতলি বললো, ‘এতো ভালবাসা সইবে তো দাদা।’ আমি তখনও কিছু বুঝতে পারিনি। তিতলি এল না। দীপ দুপুরে খেলো না। নিজের ঘরেই বসে ছিল ও। আমি, ওর দিদি, আমার শাশুড়ি মা সবাই মিলে অনেক করে বললাম খাওয়ার জন্য। কিছুতেই খেলো না দীপ।
তারপর সন্ধ্যা বেলায় আমার মিসেস চা দিতে গিয়ে দেখে দীপের ঘরের দরজা বন্ধ। অনেক ডাকাডাকি করেও যখন দরজা খুলল না, তখন দরজা ভেঙে ওকে অচৈতন্য অবস্থায় পেলাম। মুখ দিয়ে গ্যাজলা উঠছিল। ফিনাইলের বোতলটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল।
-আর একটু দেরি হলে পেশেন্টকে বাঁচানো যেত না। এনি ওয়ে, এখন বেশি করে কেয়ার নিতে হবে পেশেন্টের। ডোন্ট ওরি। সব ঠিক হয়ে যাবে। দীপের জামাইবাবুর পিঠে হাত দিয়ে ডাক্তারবাবু চলে গেলেন।
এক সপ্তাহ পর দীপ হসপিটাল থেকে বাড়ি এল। বাড়ির সবকিছুর মধ্যেই দীপ তিতলিকে দেখছে।আর সহ্য করতে পারছে না দীপ তিতলিকে।অভিনয় করেছো ভালবাসনি তুমি আমাকে কোনোদিন..
দীপের খাটের স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়িয়ে বলছে দীপের অন্তর আত্মা, “তুই যদি তিতলিকে সত্যি ভালবাসিস তাহলে এরকম জঘন্য কাজ করতে পারতিস না।”
– আমি সত্যি ভালবাসি তাইতো নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। তিতলি কি করলো আমাকে ছেড়ে অবিনাশকে বিয়ে করবে ঠিক করল।
– পরিস্থিতি দেখ দীপ। তিতলি কি সত্যি অবিনাশকে বিয়ে করবে? তুই তো সবসময় যুক্তি দিয়ে সব কাজের বিচার করিস। তিতলির বেলায় কেন তা করলি না।
– আমার সামনে তিতলির নাম করবি না। দীপ ঘেমে নেয়ে উঠেছে, ওর চিৎকার শুনে
দীপের মা ঘরে এসে বললঝ, কি হয়েছে বাবা? খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা।
– না মা, কিছু না। আমি আর তোমাকে কষ্ট দেব না মা তোমাকে। আমি তোমাকে খুব ভালবাসি মা।আমি খুব ভুল কাজ করেছি মা। আমি সব ভুলে আবার নতুন করে বাঁচব মা। তোমাদের নিয়ে আমি খুব খুশি থাকব মা। মৃত্যু খুব যন্ত্রণাময়, তাই বোধহয় কেউ মৃত্যুকে ভালবাসে না। জীবন সুন্দর, জীবনকে তাই সবাই এতো ভালবাসে।
দীপের মা ওর মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে বললো, ঘুমিয়ে পড় বাবা। কাল ভোরের সূর্যকে তুই দেখবি এক অন্য রূপে। তুই সূর্যকে দেখে শিখবি নিজের সবটুকু আলো বিলিয়ে দিয়েও কীভাবে শান্ত থাকতে হয়। ঘুমিয়ে পড় বাবা।
পরের দিন থেকে দীপের দিন বদলের পালা শুরু হল। যে ভালবাসার জন্য দীপ নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল সেই ভালবাসার টান দীপ আর অনুভব করে না।
দীপ এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।
প্রায় একমাস পর অফিস জয়েন করল দীপ।অবিনাশ আর দীপ একই অফিসে কাজ করে।
অবিনাশকে ওর কেবিনে দেখতে না পেয়ে দীপ অস্থির হয়ে উঠল। ও এতদিন অসুস্থ ছিল, অফিসের সবাই ওকে দেখতে এসেছে ওর দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছে সবাই কিন্তু অবিনাশ তো একবারও আসেনি তবে কি…
নানান প্রশ্ন ওর মাথায় ঘুরছে এর মধ্যে অফিসের বড় বাবু দীপকে ডেকে পাঠালেন, দীপ নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল- স্যার,বলুন কি কাজ আছে?
-অবিনাশ না ফেরা অবধি ওর ফাইলগুলো আপনি দেখবেন।
– কেন স্যার অবিনাশ কি ছুটিতে আছে?
– অবিনাশ লন্ডনে গেছে। খুব শীঘ্রই ফিরবে।
দীপ মনে মনে ভাবল নিশ্চয়ই তিতলিকে নিয়েই গেছে লন্ডন, তিতলি তো আমার খোঁজ করেনি একবারও, একবারও দেখতেও আসেনি আমাকে।
যাইহোক, বড়বাবুর কেবিন থেকে ফিরে এসে দীপ অবিনাশের ফাইল চেক করে নিজের কাজ শুরু করেছে, এর মধ্যে অফিসে হৈচৈ শুনে দীপ কারণ জানতে চাইল, কেন সবাই ‘ইস’, ‘আহারে’ বলছে, কার কি হয়েছে? কেউ কিছু বলছে না, ব্যাপারটা কি! এত অস্থির লাগছে দীপের, কেউ ওর কথার উত্তর দিচ্ছে না। কিছু উপায় না দেখে ও সোজা বড় বাবুকে গিয়ে বলল, কার কি হয়েছে স্যার?
– অবিনাশ লন্ডনে যাকে ট্রিটমেন্ট করাতে নিয়ে গেছিল সে মারা গেছে আজ।
– আমি তো কিছু জানতাম না, কে তিনি? আজ মারা গেলেন..
– অবিনাশের পরিচিত এক মহিলা, নাম তন্দ্রা রায়।
ব্লাড ক্যানসার, শেষ মুহূর্ত ছিল ওনার, অবিনাশ শেষ চেষ্টা করে দেখল যদি বাঁচানো যায়। অনেক বড় মন অবিনাশের, তা না হলে বন্ধুর ভালবাসাকে এতো মূল্য দেয় কেউ?
সবটা শোনার পর দীপ মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে গেল। প্রায় তিন ঘণ্টার পর ওর জ্ঞান ফিরল, দেহের বাঁ দিকটা অসাড় হয়ে গেছে দীপের, আর কোনদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না দীপ, ডাক্তার তো সেই রকমই বললেন।
স্মৃতি শক্তি বলতে দীপ তিতলি বলে একজনকে জানে আর কাউকে চেনে না। মা, দিদি, জামাইবাবু কাউকে না।
ভালবাসাতে বুঝি এমনটাই হয়। হসপিটালে দীপের বাড়ির সবাই আছে, দীপ শয্যাশায়ী হসপিটালের বেডে। শুধু তিতলি বলেই যাচ্ছে দীপ।
রাত্রি বারোটা বাজে দীপের ডানহাতটা একটু এগিয়ে আছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দীপ ব্যালকনির দিকে, ডাক্তার নার্স সবাই অবাক হয়ে দেখছেন অবিশ্বাস্য ঘটনা, যা হওয়ার কথা না,
দীপের মা চিৎকার করে বলছে দীপ কোথায় যাচ্ছিস, ফিরে আয় বাবা,
মরণেই সুখ, জীবন…সে তো বোঝা। তিতলির পাখনার ঝাপটায় দীপের দ্বীপ আজ নিভবে, অনুভবে তিতলি ছিল, আছে, থাকবে। আমি তিতলির পাখনায় বসে ভালবাসার সাগরে ডুব দেব।
-দীপের মা চিৎকার করে বলছে, ডাক্তার বাবু দীপ কি সব বলছে,বাঁচান ওকে..
ব্যালকনির খুব কাছে চলে এসেছে দীপ। নার্স, ডাক্তারবাবু দীপকে ধরার আগেই ঝুপ করে একটা শব্দ হল, দীপের শরীর ছাদের নিচে পড়ে আছে।
ভালবাসায় কোন পাপ পুণ্য নেই, নেই কোনো হিসেব নিকেশ শুধুই পাওনাটা ভালো বোঝে ভালবাসা। তাই তো দীপকে একা রেখে তিতলি থাকতে পারবে না। ঐ যে বললাম, ভালবাসা পাওনাটা ভালো বোঝে।