গল্প – পার্বন
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জি
-গিন্নী মা চাল গুড়ি কত আনবো?
-কত আর আনবি..
-গেল বার তো পাঁচ কিলো এনেছিলাম।
-এবার কম আনিস। বড় দাদারা, ছোট দাদারা কেউই থাকছে না সংক্রান্তির দিন। তোর মলিদি, জামাইবাবু তারাও তো আসছে না এবার। কর্তা বাবাও তো পুর পিঠে খেতেই চায় না।
-ঠিক আছে বলে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল হারাধন।
মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিল অসীমা। তুষ্টুপদ’র থেকে প্রায় উনিশ বছরের ছোট সে। ফুটফুটে সুন্দর বৌমা পেয়ে তুষ্টুপদ’র মা একদম কাছ ছাড়া করতেন না অসীমাকে। তুষ্টুপদরা সাত ভাই। বিশাল এক যৌথ পরিবার ছিল তাদের। অসীমা প্রথম থেকেই গৃহকর্মে বেশ নিপুণা ছিল। রান্না বান্নার দিকে আগ্ৰহ থাকলেও শাশুড়ি ছোট মেয়ে বলে খুব একটা করতে দিতেন না।
তুষ্টুপদ দূর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে চাকরি করতো। সপ্তাহে একবার গ্ৰামের বাড়িতে আসতো। অসীমা তুষ্টুপদকে দেখে লজ্জায় দূরে সরে থাকতো। তাদের মধ্যে এতটাই বয়সের তফাত ছিল যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি প্রথম দিকে গড়ে ওঠে নি।
তবে সময়ের সাথে অসীমাও সাবালিকা হয়ে উঠেছে। প্রায় পঁয়ত্রিশটা বছর সে তুষ্টুপদর বৌ হয়ে কাটিয়ে ফেলেছে। স্বামীর সাথে সে এখন দূর্গাপুরে থাকে। তাদের যৌথ পরিবার ও আর নেই। প্রতি পৌষ পার্বণের সময় এলেই অসীমা অতীত স্মৃতি ঘাঁটতে বসে যায়। সংক্রান্তির আগের দিন বিকেলে থেকে রান্নাশালে বসে পড়তো সেজজা, শাশুড়ি আর অসীমা নিজে। সরুচাকলী, পাটিসাপটা, পুর পিঠে, দুধ পুলির গন্ধে ভরে উঠতো মন্ডল বাড়ি।কচি কাচাদের মুখ তো বন্ধই হতো না। বাড়ির ছেলেরাও তো পিঠেতে ডুবতো উঠতো। কিন্তু আজকাল তুষ্টুপদ নিজেও খুব একটা পিঠে খেতে চায় না।
তাই এবার হারাধনকে চালগুড়ি কম আনতে বলেছে অসীমা। দুই ছেলে ও বৌমারা থাকছে না, মেয়ে, জামাই প্রতিবছর আসে কিন্তু এবছর নাতনির পরীক্ষা তাই আসবে না। সুতরাং এত খাটনির কোন প্রয়োজন নেই জানিয়ে দিয়েছে তুষ্টুপদ। কিন্তু অসীমার মন মানে কী। তিনটে নারকেল কুড়িয়ে পুর বানিয়েছে,গত দু’দিন ধরে দুধ মেরে ক্ষীর বানিয়েছে, মুগ ডাল সিদ্ধ করে তার পুর বানিয়েছে পুর পিঠে র জন্য।
সংক্রান্তির আগের দিন সকলের রাতের খাওয়া হয়ে গেলে অসীমা পিঠের জোগাড় নিয়ে বসে পড়ে। তুষ্টুপদ বলে ‘ভোরে উঠতে হবে। অল্প কয়েকটা পুর পিঠে বানিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। অসীমা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেও রাত প্রায় একটা পর্যন্ত রান্না ঘরের আলো জ্বলছিল সেটা তুষ্টুপদ দেখতে পায়। অসীমা বরাবরই একটু বেশি আবেগপ্রবণ এটা তুষ্টুপদ জানতো। তাই সে চুপ থাকে। পিঠে পার্বণ এইসব অনুষ্ঠানগুলোতে আজ ও অসীমা যৌথ পরিবারকে খুঁজে বেরায়। লোকজন না থাকলে কি পার্বণ হয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, আধুনিকতার প্রলেপ মাখতে মাখতে আমারা পিৎজা, বার্গার খেতে যত উৎসাহী হই ততটা পিঠে পুলির ব্যাপারে হই না- অসীমা আক্ষেপ করে হারাধনের কাছে। হারাধনই হচ্ছে অসীমার ছায়া সঙ্গী। ছেলে মেয়েরা যখন নিজেদের জীবন নিয়ে, কেরিয়ার নিয়ে, সন্তান নিয়ে ব্যস্ত তখন হারাধনই একমাত্র ব্যক্তি যে অসীমার ফাইফরমাশ খাটার জন্য উদগ্ৰীব হয়ে থাকে।
ভোর বেলায় তুষ্টুপদ দামোদরে স্নান করতে গেল দু’ চার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে। ফিরতে ফিরতে সকাল প্রায় নটা। বাড়িতে এসে হারাধনকে উচ্চস্বরে ডাকাডাকি করলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখেন দরজাটা ভেজানো। তার মানে হারাধন উঠে পড়েছে। নিশ্চয়ই বাইরে কোথাও গেছে। অসীমাও তো ভোর ভোর ওঠে। এখন বেলা নটা তারও আওয়াজ নেই।
বাড়ির চারিদিক, ছাদ ব্যালকনি সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজেও অসীমা আর হারাধন দু’জনকে কোথাও পাওয়া গেল না। ছেলেরা গতকাল পুরী রওনা দিয়েছে। তুষ্টুপদ বাড়িতে একা পড়ে গেছে একদম। মেয়েকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে অসীমা সেখানে গেছে কিনা। মলি তো অবাক হয়ে যায়। সে বলে ‘বাবা তুমি পাড়ায় একটু খোঁজ নাও। কারোর বাড়িতে বেড়াতে যায়নি তো দু’জনে। আমি দুপুরের দিকে তোমার কাছে যাচ্ছি।’ তুষ্টুপদ অসীমাকে একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিল। কিন্তু অসীমা সেটাকে ল্যান্ডলাইনের মতোই ব্যবহার করে। তার শোবার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের ওপর মোবাইল খানার অনড় অবস্থান। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন গতি রইল না।
বেলা গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে মলিও এসে হাজির। ছেলেদেরও ফোনে জানাতেই তারা অর্ধেক রাস্তা থেকে বাড়ি ফিরে আসছে। পুরো বাড়িটা স্তব্ধ। সকলের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তুষ্টুপদ এতক্ষণে মনস্থির করে ফেলেছেন থানায় যাবার। হঠাৎ দরজায় বেল বেজে উঠল। মলি ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখে হারাধন। মলি তাড়াতাড়ি শুধায় ‘মা কোথায়? তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’
-হারাধন অবনত বদনে বলে’ কর্তাবাবা আমাকে ক্ষমা করে দিন। সব দোষ আমার। মা আমাকে আপনাকে খবর দিতে বলেছিল। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’
-তুষ্টুপদ নিজের অস্থিরতাকে আর সংযত রাখতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে-‘ মরকট, সাধারণ বোধবুদ্ধি তোমাদের লোপ পেয়েছে। বাড়ীর লোকেদের ব্যতিব্যস্ত না করলেই হয় না। বলে যেতে কি বেশি পরিশ্রম হয়ে যেত। কোথায় তোর মা?’
-মা আজ আসতে পারবেন না বাবু।
-মানে!!
-বাবু সিটিসেন্টারে ‘সাথী’ নামে যে বৃদ্ধাশ্রমটা আছে মা সেখানে।
-ওওওওওও। মলি চল আমরা সাথে। তারপর তোর মাকে দেখছি। হারাধন তুমি দয়া করে বাড়িতে থেকো।
তুষ্টুপদ ও মলি দু’জনেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে ‘সাথী’তে। দারোয়ানকে পরিচয় দিতেই দারোয়ান বলে ‘আপনি পুলি মাসীমার স্বামী। যান, যান ভিতরে যান।’
ভিতরে ঢোকা মাত্রই ভেসে আসে ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায় ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা সেকি ভোলা যায়। ‘অসীমার সাথে ওর সমবয়সী জনা দশেক মহিলা মিলে প্রাণ খুলে এই গানটি গেয়ে চলেছে। পাশে রাখা আছে পাটিসাপটা, পুর পিঠে, সরুচাকলি, দুধ পুলির অবশিষ্টাংশ। তুষ্টুপদকে কী যেন একটা সজোরে ধাক্কা মেরে জানিয়ে দেয়- অসীমার এত আনন্দ, এত আবেগ সব কিছু এতকাল লুকানো ছিল তুষ্টুপদর কাছে। এই মূহুর্তে যে অসীমাকে সে দেখছে সে অন্য অসীমা। এই অসীমা গান গাইছে নিজের জন্য। শুধুমাত্র নিজের জন্য।
-তুষ্টুপদ মলিকে বলে, থাক তোর মাকে আর ডাকতে হবে না। আজকের দিনটা ওর এখানে থাকাই ভাল।
মন ছুঁয়ে গেল। উপস্থাপনা ভারী সুন্দর।
অসংখ্য ধন্যবাদ