জিও পাঁচু দা
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
উঠলো বাই, কটক যাই।
প্রাচীন প্রবাদ। মুখেমুখে ঘুরছে, কে জানে কবে থেকে। রচয়িতা কে? কেউ জানেনা। আচ্ছা, এতো জায়গা থাকতে কটক কেন? উঠলো বাই, যাই যাই, টা টা,বাই বাই, বাট, হোয়াই কটক?
আমার এক ওড়িয়া বন্ধুকে, কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। ভেবেছিলাম, উড়িষ্যার লোক, হয়তো জানলেও জানতে পারে।
উত্তর তো দিলোই না, উল্টে আমাকে একটা প্রশ্ন করে বসলো।
বলো দেখি, মামাবাড়ি যাবার সিম্বোলিক ঈঙ্গিত কী?
বোঝো ঠ্যালা, কাঁচুমাচু হয়ে সারেন্ডার করলাম, বললাম জানিনা ভাই,
হ্যা হ্যা করে, পান খাওয়া দাঁত বার করে হেসে বললো, তাই তাই তাই, মামাবাড়ি যাই।
বললাম, কি হলো ব্যাপারটা,
সে, অবলীলায় হাত নাড়িয়ে বললো, নো ব্যাপার স্যাপার। সব কথারই মানে থাকতে হবে, তার কোনও মানে নেই, বুঝেছো ব্রাদার ।
সত্যি বলতে কী, তখন সবটা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু পরে অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম, বন্ধু আমার খুব ভুল কিছু বলেনি।
কেননা, আমরা সারা জীবনে, অনেক অর্থহীন অবান্তর কথা উচ্চারণ করি।
কখনো মহান সাজবার জন্যে, কখনো কথার প্যাঁচে কুপোকাত করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্যে, কখনো, থাক, লিস্ট লম্বা হয়ে যাবে।
কথার কথা, ভুলোনো কথা, মিথ্যে কথা, চাতুরী কথা, সাজানো কথা, শেষ নাহি রে, শেষ কথা কে বলবে?
তবে একথা হক কথার এক কথা, যারা কথার জাগলারিতে পি. এইচ. ডি , তাদের ঘিভাত আটকায় কোন সম্মুন্দি।
পাঁচু দা। এক অদ্ভুত ক্যারেক্টর । সারাজীবন নো চাকরি নো বিজনেস, খালি মুখের তোড়ে বাজিমাৎ। সবেতে আছে। ডাকলেও আছে , না ডাকলেও আছে। পাঁচুদাকে চেনে না, আট থেকে আশি , একডাকে সব্বাই চেনে। কি না জানে লোকটা। রাজনীতি, সাহিত্য, সিনেমা, ফুটবল, ক্রিকেট, আধ্যাত্ম, এককথায় সবজান্তা পাঁচুদা। যে কোনও ঝক্কি অবলীলায় সামলাতে ওস্তাদ। বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, জন্মদিন, বাড়ির দুর্গা পুজো, সবকিছুর দায়িত্ব পাঁচুদা একাই যথেষ্ট।
এহেন পাঁচুদা কিন্তু অকৃতদার। বলেছিলাম, পাঁচুদা, বয়েস তো ভালোই হলো, এবার বিয়েটা সেরে নাও।
পাঁচুদা, নিভে যাওয়া বিড়িতে দেশলাই ঠুকে আগুন ধরিয়ে বললো, দ্যাখ বিলু, জ্ঞান দিবি না। আমি কি করবো, না করবো, আমি বুঝবো।
বুঝলাম, এটা পাঁচুদার উইক পয়েন্ট। তাই চট করে ব্যোমকে গেল। একটু ঠান্ডা করবার জন্যে বললাম, রাগ করোনা দাদা, খারাপ কথা তো কিছু বলিনি, তুমি বিয়ে থা করে ঘরসংসার করবে, আর পাঁচজনের মতো,
কথা শেষ হলো না।
কি বললি, পাঁচজনের মতো? আমাকে তোর পাঁচজনের মতো মনে হয়? রামা সামা যদু মধু তুই আমি, সব এক? আমার মতো আর এক পিস খুঁজে নিয়ে আয় দেখি মুরোদ কত। আমি- আমি বুঝেছিস।
বড্ড অহমিকা বোধ। ঠিক এই ব্যাপারটাই পাঁচুদার মাইনাস পয়েন্ট। ওনার বক্তব্য হলো, বিয়ে করলে জীবন থেকে স্বাধীনতা বিদায় নেবে। পরাধীন জীবনের কোনও মূল্য নেই। হঠাৎ একটা মেয়ে এসে ছড়ি ঘোরাবে, সেটি হবে না। যদ্দিন বাঁচবো রাজা হয়ে বাঁচব।
কথার কথা, সাজানো কথা মনের কথা নয়। কথার ট্যাক্স নেই। যত খুশি চালিয়ে যাও। কেউ কথা রাখেনা, রাখেনি। কেউ ভীষ্মদেব নয়। সময় বদলায়, পরিবেশ পরিস্থিতি বদলায়, কথাও বদলায়।
পাঁচুদা একদিন বিয়ে করে বসলো। আমারা তো অবাক। একি কান্ড! পাঁচুদা থলে বগলে সকালবেলা মাছের বাজারে। ঘোর সংসারী। একেবারে আমার মুখোমুখি । পাঁচুদার কোনও ব্যাপারই না। গতানুগতিক হেসে চোখ নাচিয়ে বললো, কি ব্রাদার সব ঠিক তো?
আমি মনে মনে পাঁচুদাকে বরের সাজে দেখছি, গরদের পাঞ্জাবি, ধুতি, পায়ে কোলাপুরী পাম সু,গলায় গোড়ের মালা, মাথায় টোপর। মুখে চেকনাই হাসি। আহাহাহাহা চাক্ষুষ করা হলো না। এ দুঃখ আমার সারাজীবনে যাবে না।
বললাম, কোথায় ঠিক? সবই দেখছি বেঠিক, গোলমেলে।
তুই কি দেশের রাজনীতির কথা বলছিস?
এই হলো পাঁচুদা। কথার মারপ্যাঁচে পাশ কাটাবার চেষ্টা। আমি মালটাকে বহুদিন ধরে জানি। তাই অত সহজে আমাকে ভড়কি দেওয়া যাবে না।
তাহলে, বিয়েটা শেষপর্যন্ত করেই ফেললে, বলো,
হুঁ, করলাম, তাতে কি?
না, মানে, তুমি অন্যরকম কথা বলতে কিনা,
তাতে কী? কথা ইজ কথা, নট প্রতিজ্ঞা। চেঞ্জ হতেই পারে।
বুঝলুম, কথা আর প্রতিজ্ঞাবাক্য এককথা নয়। সেখানে বিস্তর ফারাক আছে। মাথায় থাকলে চুল, গালে থাকলে দাড়ি। কথার মারপ্যাঁচ। কঞ্চি দিয়ে বুনলে ঝুড়ি, বেত দিয়ে বুনলে ধামা।
জয় হলো তোমার ভোলা, কার সাধ্য তোমায় হারাবে।
বললুম, তাহলে তোমার সোস্যাল ওয়ার্ক?
আরে ভাই , আমার বিয়েটাও সোস্যাল ওয়ার্ক।
আমার চোখ কপালে। বলে কি লোকটা। বিয়ে সোস্যাল ওয়ার্ক?
পাঁচুদা, আমি কিন্তু হার্টফেল করবো!
তোর হার্ট, তুই বুঝবি।
ব্যাপারটা খুলেই বলো না বাপু। রহস্য কিছু তো একটা আছেই,
রহস্য খুবই সাধারণ…
পাঁচুদা সিগারেট ধরালো। এই প্রথম পাঁচুদাকে সিগারেট খেতে দেখলাম।
একি গো, তোমার বিড়ি কোথায় গেল?
শিফট করেছি, ফ্রম বিড়ি টু সিগারেট। অবিশ্যি সিদ্ধান্ত আমার নয়,
বুঝেছি, বিড়ি তোমার বউ এর অপছন্দ…
এগজ্যাক্টলী….
বড়লোক বিধবা মায়ের একমাত্র কন্যা। ত্রিভুবনে কেউ নেই। মা, একেবারে শয্যাশায়ী। খুব বেশিদিন টিঁকবে বলে মনে হয় না। ক্যান্সার। আমার হাত ধরে খুব কাকুতিমিনতি….মানে, মেয়েটির জন্যেই আরকি। বললেন ঘরজামাই হয়ে থাকতে। অনেকেই উনি বলেছিলেন, কিন্তু, ঘরজামাই থাকতে হবে শুনে, তারা রাজি হয়নি।
তাহলে তুমি রাজি হলে কেন…?
দুরবোকা, আমার তো কোনো ঘরই নেই। এ তবু একটা ঘর হলো। জামাই তো ছেলের মতোই, ঘরে থাকতে দোষ কি… না কি রে বল…?
সেতো বটেই। তাহলে পাঁচুদা, তোমার বাউন্ডুলে বদনাম ঘুচলো বলো, সঙ্গে রাজত্ব, রাজকন্যে।
হা হা হা…জিও পাঁচু দা। যুগ যুগ জিও।