জয় শ্রীরাম, জয় হো আল্লাহ!
-রীণা চ্যাটার্জী
শ্রদ্ধেয় মাননীয়রা,
একটি অভিজ্ঞতা ও পরবর্তী অনুভব ভারতের রাজধানী, নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে উপযুক্ত একটি বাহনের অপেক্ষা করছি। এক গেরুয়া বেশধারী, কপালে তিলক সুঠাম ভিক্ষুক সামনে এসে নানান আশীর্বাদ বর্ষিত করে হাত বাড়িয়ে দিল ভিক্ষার।
অবশ্যই তার বক্তব্য ছিল তার ভিক্ষা পাত্রে কিছু দক্ষিণা দিলেই ঈশ্বর আমার, আমার পরিবারের, আমার সন্তানের শীঘ্র, এবং অবশ্যই মঙ্গল করবে।
আমি আবার এই একটি ব্যাপারে বড়ো কৃপণ, আমার নিজের ভাষায় ‘আমি এই ব্যাপারে বিচক্ষণ মানুষ, দায়িত্বশীল নাগরিক’। পরিস্থিতি একান্ত অসহায় হলে আমার দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু সুস্থ মানুষ, ভবিষ্যত প্রজন্ম আর ধর্মের নামে বাড়ানো হাতে আমার মুঠো খোলে না। ভিক্ষা দিয়ে পুণ্য লোভীদের দলে নাম লেখাতে চাই না। মনে হয় ভিক্ষা সমাজকে হয়তো কর্মবিমুখ করে তোলে, আগামী প্রজন্মের মূল্যবোধ নষ্ট করে দেয়। (অবশ্যই ব্যক্তিগত মতামত। কারণ কে কোন অবস্থায় ভিক্ষা বৃত্তি বেছে নিয়েছে, সঠিক কারণ জানা সম্ভব নয়। তাই কোনো শ্রেণীকে আঘাত করা উদ্দেশ্য নয়, অজান্তে হলে ক্ষমা প্রার্থী) তাই কৃপণ, নিষ্ঠুর, অমানবিক বদনাম নিতে সানন্দে রাজী, তাতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা, আপত্তি নেই।
যাই হোক আসল কথায় আসি। অতি আশীর্বাদ বৃষ্টিতে অতিষ্ঠ হয়ে বর্তমানে রাজধানীর রাজনৈতিক অবস্থান জেনেও আমি বলে উঠলাম, “হাম আল্লা বালে হ্যায়…” উদ্দেশ্য অবশ্যই এটা বুঝিয়ে দেওয়া যে আমি ভিন্নধর্মী, তাই ভিন্নধর্মীকে ভিক্ষা দেওয়া যাবে না ( ধর্ম নিয়ে কট্টর অবস্থানটা… যাচিয়ে নেওয়া আর কি!)। আমাকে ততোধিক অবাক করে দিয়ে গেরুয়াধারী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো “জয় আল্লা, জয় হো আল্লাহ” যথারীতি হাতটা সামনে এগিয়ে।
একা ছিলাম তাই প্রথমেই হেসে উঠলাম আপন মনে, মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে। ভাবলাম ধর্ম, ধর্মবোধ কতো সহজ এদের কাছে!
পরমুহূর্তেই কেমন লজ্জা লাগলো নিজের হাসির উপর। পৌরহিত্য যদি একটি পেশা হয়, তাহলে ভিক্ষা বৃত্তিও ধরে নিলাম এক শ্রেণীর পেশা। তিনি না হয় স্বাধীন ধর্মব্যবসায়ী। কোনো পেশায় ধর্ম তো প্রতিবন্ধক হতে পারে না, গোঁড়ামি সাজে না। নমনীয়তা তো উত্তরণের চাবিকাঠি। আমার এ ভাবনার মাঝেই অবশ্য সেই ব্যক্তি সরে গিয়ে অন্য স্থানে আশার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, এ যে জীবিকার তাগিদ। তারপরেই ভাবলাম আমাদের দেশের তাবড় তাবড় নেতারা, বিদগ্ধ জনেরা যেখানে ধর্মের নামে অসহনশীল হয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করতে পারেন নিমেষে। ধর্মীয় রক্ষাকবচ পড়ে দেশ উন্নয়নের, সমাজ উদ্ধারের মিথ্যা অমৃত বাণী শোনান। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাঠগড়ায় তোলেন নিজেদের (ভোট) পাওয়ার হিসেব ঠিক রাখতে। সেইখানে উদরপূর্তির কারণে, যা জীবনের নূন্যতম চাহিদা- ভেদাভেদ মিটিয়ে দিয়ে এক কন্ঠে ‘রাম-রহিম’ উচ্চারিত হয়ে যায় অবলীলায়, ধর্ম ভেদাভেদের প্রাচীর তুলতে পারে না সেই নূন্যতম চাহিদার কাছে। সত্যিই, পেটের দায় বড়ো দায়- আমাদের নেতা, বিদগ্ধ জনেদেরও যদি এই জ্বালা থাকতো! ধর্ম মনে হয় আর মঞ্চে ফেরি হতো না, আদালতে হাজিরার দিন গুনতো না। ভীষণ দরকার ছিল তথাকথিত মাননীয়দের এই জ্বালার, ক্ষুধার জ্বালা উপলব্ধি করার। তাহলে বাড়িয়ে দেওয়া ভিক্ষার হাত সমাজ থেকে হয়তো মুছে যেত চিরতরে।
সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার- কর্তব্য, সাম্যবাদ রণনীতির অনেক নাম, অনেক কৌশল তো শুনলাম বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে। সবকিছুর বুনিয়াদ বোধ হয় মিথ্যের অবগুণ্ঠন পড়ে আছে। সব নীতি সরিয়ে দিয়ে ভিক্ষা দিয়ে নিজের কর্তব্য সারা হয়ে গেছে না ভেবে, ভিক্ষাবৃত্তির অতীত- বর্তমান-ভবিষ্যত একবার তলিয়ে ভাবা যায় না কি?
সাম্যবাদী, শান্তিকামী, শ্রেণী শোষনের বিরুদ্ধে যাঁরা, ধর্মের কাণ্ডারী নেতারা সবাই মিলে ভাববেন না কি একবারও? শুদ্ধিকরণ হোক একবার?
নগণ্য নাগরিক