গল্প- সুদিনের অপেক্ষা

সুদিনের অপেক্ষা
-রাখী চক্রবর্তী

 

 

৩’রা ভাদ্র, ১৪২৪,

খবরের কাগজে বৃদ্ধাশ্রমের বিজ্ঞাপন দেখে আমার বড় খোকা চিৎকার করে বললো, বাবা ,,পেয়ে গেছি তোমার আর চিন্তা নেই। খুব ভালো জায়গা বাবা। ওরা এককালীন টাকা নেবে। মাসে মাসে টাকা দেওয়ার ঝামেলা নেই।

-আমার চিন্তা কোথায় বড় খোকা, চিন্তা তো তোর আমার ঘর ছাড়া নিয়ে, মনে মনে বললাম।

বড় বৌমা তো আনন্দে আত্মহারা। আমি বিদায় হলে আমার ঘরে ওর বাবা মা থাকবে। বড় বৌমার ভাইয়ের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। সেখানে মাত্র তিনটে রুম। ছেলে দিন দিন বেড়ে উঠছে তারজন্য তো ঘরের দরকার। খুব মুশকিলে পড়ে গেছিল বড় বৌমার ভাই ও বড় বৌমা। শেষে চোখ পড়ল রতু সরকার লেনে আমার বাড়ির দিকে। আমার বয়স হয়েছে আমি বৃদ্ধাশ্রমে থাকতেই পারি কিন্তু ওনাদের বৃদ্ধাশ্রমে থাকার বয়স হয়নি।

আমি বুকের মধ্যে পাথর নিয়ে আমার বাড়ি ছাড়লাম। নাতি নাতনিদের ভালবাসা আবদার খুনসুঁটি সব থেকে বঞ্চিত হলাম।

রতু সরকার লেনে আমার জরাজীর্ণ বাড়িটা যেন কিছু বলতে চায়। কত ঝড় ঝাপটা গেল, বাড়িটা আমার ঠিক দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িরও মনোবলের দরকার হয়। আমার তখন বয়স কত আর..পাঁচ ছয় হবে। বাবার হাত ধরে বাড়িটা দেখতে এসেছিলাম। ২২, নম্বর রতু সরকার লেনে।সিমেন্টর চলটা ওঠা দেওয়াল, খাবলানো ইট, জানলার রডগুলোতে জং ধরে লাল লাল গুঁড়ো ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। তখন আমরা বাস্তুহারা। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেই বাড়ির চাল উড়ে গেছে ঝড়ের দাপটে। বাড়িওয়ালা জেঠু সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এ ঘরের ছাউনি আর দেওয়া যাবে না। তোমরা ঘর খুঁজে নাও ।মাথার ওপর ছাদ নেই। বাবা তখন হন্যে হয়ে ঘর খুঁজছে।মা রাস্তার ওপর রান্না করছে।
রতু সরকার লেনে ঐ বাড়িটার ভগ্ন দশা দেখেও বাবার মুখটা চিকচিক করে উঠল। বাবা বললো আমাকে- কি বলিস সোনা, ঠিকঠাক করে মেরামত করে নিলে বাড়িটা সুন্দর লাগবে তাই না। এর থেকে সস্তায় আর কলকাতা শহরে বাড়ি মিলবে না রে।
আমি বললাম, হ্যাঁ বাবা রাস্তার ওপর বাড়িটা মা’রও খুব ভালো লাগবে।
আজ সত্তর পেরিয়ে গেলাম। মায়া ছাড়তে পারিনা বাবা মার স্মৃতি, মার ঘর কন্যার সাক্ষী সব মিলিয়ে আমি পাথর হয়ে গেছিলাম যেদিন বাড়িটা ছাড়লাম।
তবে বাড়ি ছাড়ার কষ্টটা দু’বছর ভোগ করলাম, তারপর আমি চির নিদ্রায় শাহিত হলাম। খুব ভালো হলো বাবা, মা, তমসা আমার সহধর্মিণী ওদের কাছে যেতে পেরে। এবার তো কেউ আমাকে তাড়াতে পারবে না। এবার আমার শ্রাদ্ধ শান্তির আবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হল খবরের কাগজে, লেখার নিচে কালো দাগ দেওয়া যাতে সবার নজরে পড়ে,
“আমাদের পিতা স্বর্গীয় সোনা হালদার সজ্ঞানে শিবলোকে গমন করেছেন গত ৪ই মাঘ, ১৪২৬সনে। আগামী ১৫ই মাঘ, ১৪২৬ সনে আমাদের পিতার পরলৌকিক কাজ হইবে, উক্ত দিনে আমাদের সমস্ত আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে অনুরোধ ২২, নম্বর রতু সরকার লেনে আমাদের পিতৃগৃহে এসে আমাদের পিতার আত্মার চিরশান্তি কামনায় প্রার্থনা করবেন।”

আমার পরলৌকিক ক্রিয়া কর্ম করার জন্য এত আয়োজন। দুনিয়া শুদ্ধু লোক নিমন্ত্রিত হচ্ছে।ঠিকানা সেই রতু সরকার লেনের বাড়ি। হা ভগবান, যেই বাড়ি থেকে কুকুর বেড়াল তাড়ানোর মতো করে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ওরা সেই বাড়িতে আমার শ্রাদ্ধশান্তি হবে। কেন রে, তোরা বৃদ্ধাশ্রমে আমার পরলৌকিক কাজ করলি না কেন?
নিজেদের মহান প্রমাণ করবি কি করে,তাই তো।
তার জন্য এত আয়োজন, আমি কিছুতেই সইতে পারছি না এই যন্ত্রণা। এই বাড়িটা আঁকড়ে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়া পর্যন্ত আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। এ আমার বিরাট অপরাধ ছিল!
বাড়ি ছাড়লাম তোদের সুখী করার জন্য। নিত্য দিনের ঝগড়া ঝামেলা অতিষ্ঠ হয়ে গেছিলাম।আরে ঠিক সময়তে আমি মরবই। কেন এত তাড়াহুড়ো করলি তোরা! দু’বছর থাকলে কি খুব অসুবিধা হতো তোদের?
না না আমি ভুল বললাম।
এই বাড়িতে থাকলে আমি আরও অনেক বছর বাঁচতাম রে, এই বাড়ি যে আমার বাঊচার রসদ জোগাত।
আজ ১৫ই মাঘ,
সকাল হতেই আমার ফটো ফুল চন্দন দিয়ে সাজিয়ে কাঠের বেদির ওপর রেখে দিয়েছে ওরা।কত ভালবাসার বাবা আমি। স্নেহ ভক্তির ভালবাসায় মোড়া আমার ছবিখানি। এত টাকা খরচ করছিস তোরা আমার জন্য। অথচ শীতকালে একটা চাদর দিসনি আমার গায়ে দেওয়ার জন্য, কত ভালবাসা তোদের আমার ছবির প্রতি, এত দামি রজনী গন্ধার মালা…
আজ কাল পরশু প্রতি দিন খবরের কাগজে বড় বড় করে বৃদ্ধাশ্রমের বিজ্ঞাপন বের হবে। আমার মতো কত অসহায় সম্বলহীন পিতা মাতার ঠাঁই হবে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে। আবার ছেলেমেয়েরা তাদের কর্তব্য পালন করবে মা বাবা মরে যাবার পর।
হ্যাঁ, বৃদ্ধাশ্রমের ঘরগুলো খালি হবে এক এক করে, আবার নতুন অতিথি হয়ে আসবে কে জানে কার বাবা মা। হয়তো আমার বড় খোকা বড় বৌমা।চলতে থাকবে বৃদ্ধাশ্রমের বিজ্ঞাপন। চলতে থাকবে মা বাবার প্রতি অন্যায় অবিচার। এর শেষ কোথায় কেউ কি বলতে পারবে?
আর যদি এমনটা হয়, বৃদ্ধাশ্রম বলে কোনও দিন কোনও বিজ্ঞাপন খবরের কাগজ, টিভিতে আসবে না। সব ছেলে মেয়েরা বাবা মাকে নিজেদের কাছে রাখতে বাধ্য হবে। আসবে কি সেই সুদিন?
যদি এমনটা হয় তবে আমার আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি পাবে, রইলাম সুদিনের অপেক্ষাতে..

Loading

Leave A Comment