সাবধানের মার নেই
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
চুকলি করা, কিংবা উস্কে দেওয়া বিদ্যে সকলের থাকেনা। কেউ কেউ এই বিশেষ বিদ্যে নিয়েই ভূমিষ্ট হয়। জন্মগত বিদ্যে। ঈশ্বর প্রদত্ত কী? এর উত্তর একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন।
আচ্ছা, এটাকে বিদ্যে বলা কি উচিৎ হচ্ছে ? মোটেই না। কিন্তু , আমরা তো বলি চুরি বিদ্যে। আসলে বিদ্যে হলো , কোনও বিশেষ বিষয়ের পারদর্শীতা। সেই দক্ষতা , ভালো কিংবা মন্দ, যে কোনও বিষয়েই হতে পারে। তবুও বিদ্যে বা বিদ্যা শব্দটি আমরা ভালো বিষয়ের সঙ্গেই দেখতে বা শুনতে পছন্দ করি।
এখন প্রশ্ন হলো , সবকিছু কি আমাদের পছন্দসই হয়? অবশ্যই হয়না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হয়না।
মিতার বিয়ে হয়েছে চার বছর হয়ে গেল। বাচ্ছাকাচ্ছা হলো না। ফিসফাস চলছে । শাশুড়ী কপাল চাপড়াচ্ছে। শ্বশুর মুখ গোমড়া করে আছে। বৌমার সঙ্গে , কেমন যেন একটা ছাড়াছাড়া সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। মিতা অপরাধীর মতো নির্বাক। মুখে কেউ কিছু বলেনা ঠিকই , কিন্তু বাংলায় একটি মোক্ষম শব্দ আছে , ঠেস। এই ঠেসের ব্যবহার যে কি ভয়ঙ্কর , তা যার ওপর প্রয়োগ হয়েছে , কেবল সে ই তার মর্ম , মরমে মরমে উপলব্ধি করতে পারবে। অবিশ্যি , ঠেসের খোঁচা খায়নি , এমন মানুষ অন্তত আমার চোখে পড়েনি। ঠেসের খোঁচার অভিজ্ঞতা কমবেশি প্রায় সকলেরই আছে বলে আমার অন্তত বিশ্বাস।
প্রতিবেশীর মতো বন্ধু হয়না , আবার , প্রতিবেশীর মতো চুকলিবাজ হয়না।উস্কে দিতে ওস্তাদ। এ এক আশ্চর্য প্রতিভা। কোনও ট্রেনিং-এর দরকার নেই। এ বিষয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। পি এইচ ডি দেওয়া উচিৎ। ঋষি নারদের এই ব্যাপারে যথেষ্ট সুনাম কিংবা দুর্নাম আছে।
পাশের বাড়ির মতি মাসি , মিতার শাশুড়ির গলায় গলায় প্রাচীন বন্ধু। সেই সুবাদে এ বাড়িতে যাওয়া আসা আছে। নেই কাজ তো চুল বাছ। চলমান গেজেট। সারা পাড়ার লোকের হাঁড়ি কলসির খবর তার ঝুলিতে। এবাড়ির কথা ওবাড়িতে , ওবাড়ির খবর এবাড়িতে। অদ্ভুত এনার্জি। কি খায় কে জানে।
সেদিন এলেন সন্ধ্যেবেলা। ঢুকে গেলেন পারুর ঘরে। পারু মানে, মিতার শাশুড়ি। আসল নাম পার্বতী। অপভ্রংশ হয়ে পারু। এবার শুরু হবে , কেচ্ছার সিরিয়াল।
শুনেছ , নন্দর নাতি হয়েছে!
পার্বতী , টিভিতে “জ্যান্ত কালি ” সিরিয়াল দেখছিল। রিমোট টিপে বন্ধ করে দিল।
তাইনাকি , কবে হলো ?
কালই তো,নার্সিংহোমে । সিজার করে হয়েছে তো…
পারু ঠোঁট উল্টে বললো -সিজার এখন জলভাত। বাচ্ছা হলেই সিজার।তাছাড়া, সিজার না হলে, নারসিং হোমের বিল মোটা হবে কীভাবে ! আজকাল সবই ব্যবসা।যাক, বউ ভালো আছে তো?
মতিমাসি একগাল হেসে বললেন, হ্যাঁ ! মা , বাচ্ছা দুজনেই ভালো আছে।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে , পারু শ্বাস মিশিয়ে বললো,যাক বাবা , ভালোয় ভালোয় সব মিটলেই ভালো।
এই কথাটা আশীর্বাদ নাকি আফসোস , ঠিক বোঝা গেল না।
সাপুড়ে যেমন বিণে ফুঁ দিয়ে সুর তোলে , মতি মাসি ঠিক সেই ভাবে সুর করে বললেন- তোমারই কপাল মন্দ। নইলে এদ্দিনে তুমিও নাতি নাতনির মুখ দেখতে , ঠিক কিনা বলো?
এই লোক গুলো , লবি তৈরি করতে ওস্তাদ। নিজের কথার পক্ষে সম্মতি আদায় কোরে , সেফ গার্ড জোন বানিয়ে নেয়।
পারু বিশেষ পাত্তা না দিয়ে বললো- আর ওসব বলে কি হবে , হলে হবে , না হলে…
পারু কে থামিয়ে দিয়ে , মতি মাসি গাঁক করে উঠলেন, না হলে মানে ? এখন সেই আগের মতো আছে নাকি । কত ভালো ভালো ব্যবস্থা বেড়িয়েছে আজকাল। ওইতো , সোনুর মেয়ে হলো। কি সব আজকাল হয়েছে , কি যেন বলে ?
তোমার ছেলে কে বলোনা , সোনুর কাছে খোঁজখবর করতে পারে তো!
পারু ব্যাজার মুখে বললো- তুমি থামো দেখি। সকলের সব সহ্য হয়না। তাহলে আর লোকে দত্তক নিতো না। তাছাড়া ওসব শুনেছি নাকি অনেক ঝক্কিঝামেলার ব্যাপার। টাকাপয়সাও তো শুনেছি অনেক লাগে!
মতি মাসি যেন একটু হতাশ হলো। কিন্তু হাল ছাড়লো না। -তা লাগে… কিন্তু এইভাবে হাল ছেড়ে দেওয়া তো কাজের কথা নয় , নাকি বলোনা… তা, বৌমা কি বলে ?
দাবার চালে নৌকো এগুচ্ছে । সাবধান। রাজা সামলাও।
বৌমা কি বলবে । তারও তো ইচ্ছে হয় মা হবার। কোন মেয়ে মা হতে চায় না বলো?
মতি মাসির কপালে ভাঁজ পড়ছে । গম্ভীরমুখে বললো, আর তোমার ছেলে , সে কী বলে?
পাশার দান ফেলে, ওজন বুঝতে চাইছে। কেয়াবাত মতি মাসি…
আমার ছেলে বরাবরই চুপচাপ, মুখে কিছু বলে না। কিন্তু, আমি তো মা, বুঝতে পারি, ওর মনটাও আঁকুপাঁকু করছে। সন্তান কে না চায় ।
মনেহচ্ছে চিঁড়ে ভিজবে না। মতি মাসি উঠে পড়লেন।
দ্যাখো কী হয় । এখন তো আর তাবিজ মাদুলির যুগ নেই। ডাক্তার ভরসা। যা ভালো বোঝো করো। আমি আর কী বলবো! যাই… একবার ভুলোদের বাড়ি যাবো। ওরা পুরী গিয়েছিল , প্রসাদ এনেছে। ফোন করেছিল। আসি কেমন ।
মতি মাসির করুণ প্রস্থান। খেল জমলই না। দেখাযাক ভুলোদের বাড়িতে যদি খেদ মেটে।
চুকলিবাজ দের কখনও বিশ্বাস করতে নেই। সব্বাই জানে, তবুও ভুল করে। আরেবাবা, এই সহজ অঙ্কটা মাথায় ঢোকেনা কেন। যে লোক, যদুর কথা মধুর কাছে চুকলি করছে , সেই লোক, অবশ্যই মধুর কথা যদূর কাছেও চালান করবে। অবধারিত ভাবে করবে।
বৌমা , এতক্ষণ আড়ালে থেকে সবই শুনেছে। মতি মাসি চলে যাবার পর , শাশুড়ীর ঘরে এলো। অনুযোগের সুরে বললো- মা, ওনাকে সত্যি কথাটা বললেনা কেন?
পারু হেসে বললো , শিখে রাখো, কিছুকিছু মানুষ এমন আছে , যাদের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হয় , নইলে, পস্তাতে হয়।
বৌমার তিন মাস চলছে। প্রেগন্যান্ট।