গল্প- কাঙালি ভোজন

কাঙালি ভোজন
-পারমিতা ভট্টাচার্য

 

 

আজ চাটুজ্যে বাড়িতে যোগ্যি চলছে।মোহনপুর গ্রামের সবথেকে ধনী পরিবার হলো মনোহর চাটুজ্যের পরিবার।তাদের তিন পুরুষের সুতোর ব্যবসা কলকাতায়।পরিবারের বেশিরভাগ লোকই থাকে কলকাতায়।কিন্তু বছরের প্রথম দিনে তারা সবাই মোহনপুরের এই গ্রামের বাড়িতে এসে হাজির হন তিন চার দিনের জন্য।বছরের প্রথম দিনেই চাটুজ্যেদের বাড়ির সামনের খোলা মাঠে প্যান্ডেল বানানো হয়।বহু গরীব দুঃখীকে পেটভরে খাওয়ানো হয়,আর সাথে শীতের পোশাক,কম্বল প্রভৃতি দান করাও হয়। সাত পাড়ার লোকে ধন্য ধন্য করে মনোহর চাটুজ্যেকে।

আজ সকাল থেকেই নিতাইয়ের মনটা খারাপ।এমন মন খারাপ তার প্রায়ই হয়।মুখ গোমড়া করে পেল্লাই বাড়ির ভাঙা দাওয়ায় প্লাস্টার খসা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে সে।নিতাইদের বাড়িটা তিনতলা,কিন্তু এখন প্রায় ধ্বংসাবশেষটুকু যাইহোক করে টিকে আছে আর কি।বাড়ির ছাদে বট অশ্বত্থের ঝুরি ,সাথে দেওয়ালের গায়ে পুরু শ্যাওলা আর আগাছার উপস্থিতি।নিতাইয়ের বয়স বছর পনেরো।তাদের অবস্থা চিরকাল এমন দুর্দশাগ্রস্ত ছিলনা। খুবই স্বচ্ছল পরিবার ছিল।মাএর মুখে তাদের অতীতের গল্প শুনতে শুনতে নিতাইয়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে।কিন্তু সে নিরুপায়।কারণ টাকার জোর তাদের নেই।একসময় জমিদার বাড়ি ছিল তাদের বাড়ি।কত লোকের আশ্রয়স্থল ছিল এই মজুমদার পরিবার।কত আলোর রোশনাই ছিল এই পেল্লাই বাড়িটা ঘিরে।আর আজ! একটা ঘরে যাইহোক করে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে তারা থাকে।বৃষ্টির দিনে ছাদ চুঁইয়ে জলে ভেসে যায় সব।ভাঙা বাড়িতে সাপ আর শেয়ালের সাথে বসবাস করতে হয় তাদের।নিতাইয়ের মাও পরের বাড়ি কাজ করে যাইহোক করে সংসার চালায়।
নিতাইদের আগে সুতোর বিরাট করবার ছিল কোলকাতায়, নিতাইয়ের দাদুর গদাধর মজুমদারের আমলে।তখন ইংরেজ আমল। মূলত এই সুতোর কারবারেই ফুলে ফেঁপে ওঠে ওদের জমিদারী।তখন এই জমিদার মনোহর চাটুজ্যে নিতাইদের সুতোকলের একজন কর্মী ছিল। তাদের অবস্থা খুবই করুণ থাকার দরুণ নিতাইয়ের দাদুই মনোহর চাটুজ্যেকে এই কাজটা দেয়। পরে সে সুপারভাইজারও হয়ে যায়। বয়স্ক গদাধর মজুমদার বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ক্যাশের সব দায়িত্ব ছেড়ে দেন মনোহর চাটুজ্যের উপর। কারণ নিতাইয়ের বাবা মানবেশ মজুমদারের বিষয় বুদ্ধি কিছুই ছিলনা বলতে গেলে। সে ছিল বাবু মানুষ।গান বাজনা,ছবি আঁকা,বইয়ের মধ্যেই ডুবে থাকতো সর্বক্ষণ। এই সুবর্ণ সুযোগেই গদাধর মজুমদারের মৃত্যুর পর তার ব্যবসা করায়ত্ত করে মনোহর চাটুজ্যে। সব শেষ হয়ে যায় মজুমদার পরিবারের। অন্যদিকে ফুলে ফেঁপে ওঠে মনোহরের পরিবার। নিতাইয়ের বাবাও অল্প বয়সে নিউমোনিয়ায়  আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।

           আজ তিনদিন হলো নিতাইদের ফ্যান ভাতে নুনটুকুও জোটেনি।মাসের শেষ সপ্তাহটা ওদের এভাবেই কেটে যায় ।তবুও ওরা কখনো কারো কাছে হাত পাতে না। হয়তো বনেদিয়ানাই এর জন্য দায়ী। আজ মনোহর চাটুজ্যের বাড়ি মহাভোজ। যত গরীব দুঃখী আজ চলেছে ওখানে। নিতাইয়ের বন্ধু তপন বেলায় এসে নিতাইকে তৈরী থাকতে বলে গেছে। দুজনে মিলে
চাটুজ্যেদের বাড়ি খেতে যাবে। নিতাই প্রথমে না করে দেয়। তপন কিন্তু নাছোর বলে , ‘ মাংস খাবি,পায়েস খাবি,মিষ্টি খাবি।সারাবছরের এই একটা দিনই তো খেতে পাবি ভালোমন্দ।বাকি সারা বছরই তো ফ্যানভাত আর শাক সেদ্ধ।’ একপ্রকার জোর করেই টানতে টানতে তপন নিতাইকে নিয়ে গেলো চাটুজ্যেদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে নিতাই দেখে আজ যেনো সেখানে মেলা বসেছে। হাজার হাজার লোকে লোকারণ্য।মাইকে হেঁকে কম্বল , পোষাক বিতরণ করা হচ্ছে। হঠাৎই নিতাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো মনোহর চাটুজ্যে। একদৃষ্টে তার খর্বাকার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো নিতাই।তখন মনোহর চাটুজ্যে তাকে বললো , ‘ পেটভরে খেয়ে যাস,তোদের মতো কাঙালিদের জন্যই তো বছরে একটা দিন এসবের আয়োজন করি। সারাবছর শাক পাতা সেদ্ধ আর ফ্যানভাত খাস।একটা দিন তাই কাঙালি ভোজন করাই।আর শোন, যাবার সময় একটা চাদরও নিয়ে যেতে ভুলিস না যেনো।’
একটা হিম স্রোত বয়ে গেলো নিতাইয়ের সারা শরীর বেয়ে। মনে হলো কে যেনো ঠাস ঠাস করে কতকগুলো চড় কষিয়ে গেলো গালে। মনোহর চাটুজ্যের কথাগুলো অট্টহাসির মতো তার কানে বাজতে লাগলো। তাদেরই সম্পত্তি গ্রাস করে চাটুজ্যেদের এতো রমরমা,আর তাকেই কিনা আজকের দিনে এতো লোকের সামনে অপমান করা। মাঠের ভিড় ঠেলে পুকুর,রাস্তা,জমি পেরিয়ে রুদ্ধশ্বাসে সে দৌড় লাগালো।অবশেষে বাড়ির উঠোনে এসে ধপ করে বসে পড়লো সে।ঘরের ভাঙা দরজা ঠেলে ছুটে এলো মা।ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কী হয়েছে?’ নিতাই কিচ্ছু বললো না।শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো।আর জিজ্ঞেস করলো, ‘ মা আমরা কি কাঙালি? ‘ মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ তোর মতো সাত রাজার ধন মানিক আছে যার ঘরে সে কখনও কাঙালি হতে পারে? ‘ শান চটা মেঝেতে বসে পরম স্নেহে মা ছেলেকে ফ্যানভাত খাওয়াতে লাগলো। বছরের প্রথম দিনের এই তৃপ্তি যে পরমান্নতেও নেই সেটাই অনুভব করলো নিতাই।

Loading

Leave A Comment