অন্য উৎসব
-রাখী চক্রবর্তী
ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে, জোনাকির আলোতে ক্ষীণ আলো আঁধারের গাঁয়ের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রোজ রাতে় আমি বাড়ি ফিরি ।হোমিওপ্যাথি ডাক্তারখানাতে আমি কাজ করি।সংসারে আট জনের পেট, তাতে কি ঐ কটা টাকাতে চলে ।একদিন নরুল খুড়ো আমার মাকে বলল, কলকাতায় ভালো কাজ আছে। যদি সম্ভব হয় টগরকে আমি একটা ভালো কাজের ব্যাবস্থা করে দিতে পারব।
আমার মার মুখটা উজ্বল হয়ে গেল খুড়োর কথা শুনে।
মা বলল, শিক্ষিত মেয়ে আমার, লোকের বাড়ি যেন কাজ দিও না ঠাকুর পো।
আমার মার চোখে আমি শিক্ষিত। ক্লাস ফাইভ অব্দি পড়েছি তো তাই। অন্য ভাই বোনেরা তো ইসকুলেই যায়নি। আমার মা খুব গর্ব করে গাঁয়ের বৌ ঝিদের বলে, ইসকুলের গণ্ডি পেরিয়েছে আমার টগর।
এতো রকমের আলো হয়! আমি তো কলকাতায় না এলে জানতেই পারতাম ন। আলোতেও এত কারুকার্য হয়! রাত বলে তো মনেও হচ্ছে না,
আজ বড়ো দিন। তাই শহর সেজেছে বুঝি।
আমাদের গাঁয়ে বড়দিনের কোন উৎসব হয়না। ঘটা করে নবান্ন উৎসব পালন করি আমরা। নতুন গুড়, নতুন ফল দিয়ে ঠাকুর পুজো করি আমরা।যার যতটুকু আছে। কোনও কার্পণ্য নেই এই উৎসবে। লক্ষ্মী পুজোও হয় আমাদের ঘরে। তবে পটে। ঘরেতে অভাব তাই বড় করে কোন পুজো আমাদের ঘরে হয় না। জমিদার বাড়িতে দুগ্গা পুজো খুব বড় করে হয়। আমরা সবাই গেছিলাম জমিদার বাড়িতে ভোগ খেলাম, আমাদের গাঁয়ে সবচেয়ে বড় উৎসব হল দুর্গা পুজো, বিশুদার সাথে আমার আলাপ হয়েছিল জমিদার বাড়িতে, তাও দু’বছর হল। আমি বিশুদাকে ভালবাসি কিন্তু মনে মনে। বিশুদাকে বলব বলব করেও বলতে পারিনি।
গতবছর দোল উৎসব পালিত হল খুব ঘটা করে জমিদার বাড়িতে। আমরা গায়ের ছেলে মেয়েরা সবাই গেছিলাম দোল উৎসবে জমিদার বাড়িতে।সবাই আবির নিয়ে একে অপরের মুখে দিচ্ছে এর মধ্যে বিশুদা লাল আবিরে ভরিয়ে দিল আমার মাথা, গাল। এ এক অন্য অনুভূতি।
আমি সেদিন এক অন্য উৎসবে মেতেছিলাম। আমি বাড়ি ফিরে আয়নায় আমার নতুন রূপ দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেছিলাম। আমার সিঁথিটা লাল। কোনো নতুন বধুর থেকে কম লাগছে না আমাকে দেখতে। সেদিন থেকে কতদিন চুল ভেজাই নি। পাছে বিশুদার দেওয়া লাল আবির উঠে যায়। যেদিন সন্ধ্যা বেলায় বিশুদার দাদা বিশুদার বিয়ের নিমন্ত্রণ করে গেল সেই রাতে কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেও আমি স্নান করে মাথার লাল আবিরের চিহ্নটুকু ধুয়ে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে কোনো উৎসবে আমি সামিল হতাম না।বিশুদাকে ভোলার জন্যই নরুল খুড়োর সাথে আমি কলকাতায় এলাম।
ট্রেনে উঠব বলে যখন ইসটেশনে বসে ছিলাম তখন আমার সিঁথি, মন পুরো ফাঁকা। ট্রেনে উঠে কেন জানিনা গাঁয়ের সবার কথা খুব মনে পড়ছিল, অথচ সখিদের মুখগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল, চারদিক ধোঁয়ায় ভরে গেল। আমার মা ভাই বোন সবার চেহারা কেন এত অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে তা তো বুঝতেই পারছিলাম না। যাইহোক ট্রেন থেকে নেমে বাসে উঠলাম। কলকাতা নামটাই যেন আমার কাছে সার্থক হল। কতদিনের ইচ্ছা পূর্ণ হল। এতো আলোতে আমার চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো, কলকাতা রূপবতীও বটে।
আমাকে রাস্তার এক ধারে দাঁড় করিয়ে নরুল খুড়ো বলল, একটু দাঁড়া এখানে, আমি এখুনি আসছি।
আমি বললাম, খুড়ো সব উৎসবেই কি এত সুন্দর করে সাজে কলকাতা, নাকি আজ বড়দিন বলে এত আলোতে পথঘাট সেজেছে?
খুড়ো বলল, কলকাতা স্বপ্নপুরী রে, সব সময় উৎসব হয় এখানে, তুইও সাজবি গুচবি। তুইও ভালো থাকবি, উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবি না রে তুই, তাক লাগিয়ে দেব তোকে বুঝলি টগর, একটু অপেক্ষা কর।
আমি দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ আমার নজর গেল একটা রজনীগন্ধার মালার দিকে, রাস্তায় পড়ে আছে মালাটা। আর কেউ দেখেও দেখছে না মালাটা। আমি মালাটা কুড়িয়ে নিই। কেউ আবার দেখল না তো? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম,
না, কেউ দেখেনি। মালাটা বরং হাতে পেঁচিয়ে রাখি। এত সুন্দর রজনীগন্ধার মালা।
এমন সময় একটা মাঝবয়সী লোক আমার কাছে এসে বলল, খদ্দের ধরবে বলে দাঁড়িয়ে আছো ফুলকলি? হাতে রজনীগন্ধার মালা। দারুণ লাগছে মাইরি।
– আমি খুড়োর জন্য অপেক্ষা করছি। আমাকে খুড়ো বলল, তুই একটু দাঁড়া আমি আসছি। সেই কখন গেছে..
– কেমন দেখতে বলো তো তোমার খুড়োকে?
– লম্বা ,ফর্সা
– ওও তাই বলো, উনি তোমার খুড়ো, আমাকে পাঠিয়েছে। চলো আমার সাথে।
– কোথায় যাব?
– কালীঘাট। একটু খানি পথ। চলো
– এটা কোন জায়গা?
– পার্ক স্ট্রিট। তুমি এই শহরে নতুন এসেছো তাই না
-হ্যাঁ, খুড়ো আমাকে নিয়ে এসেছে। আমরা খুব গরিব। মাস্টার মশাইয়ের ইসকুলে কাজ দেবে বলল তো। মা রাজি হয়ে গেল। মাস গেলে মাইনে দেবে। সংসারে কিছুটা হাল ফিরবে। আর কত দুর কালীঘাট।অনেক তো হাঁটলাম।
– ঐ দেখো, কালীঘাটের মন্দিরের চূড়ো।
– ঐ মেয়েগুলো ফুলের মালা গলায় দিয়ে এত রাতে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
– চুপ, বেশি প্রশ্ন করছো। মুখ বন্ধ রাখো। মাস্টারের বাড়ি এসে গেছে।
সে রাতে আমার চিৎকার কেউ শোনেনি। সবাই বড়দিনের উৎসব পালন করছে। আর আমি বড় রাতের শেষ কখন হবে তার অপেক্ষা করছি
রাত যেন শেষ হতে চাইছে না। বড়দিন হলে রাত তো ছোট হবে তাহলে আমার কেন রাত শেষ হচ্ছে না?
টগরী ও টগরী নতুন বাবু এসেছে ঘরে বাতি জ্বালা।
আমার মতো মেয়েদের কাছে রোজই উৎসব,
সাজ শয্যা দিয়ে রাত শেষ করি, আবার নতুন ভোরের জন্য অপেক্ষা করি না কিন্তু, আবার পরের রাতটা কোন বাবুর অন্ধ ভালবাসায় স্বপ্ন দেখতে দেখতে বধুর সাজে ঘর কন্যা করতে করতে ভোর হয়ে যাবে। নতুন সূর্য উঠবে, কলকাতা ঝলমলিয়ে উঠবে। বাবুদের চাহিদা মিটবে। টাকা পাব, গাঁয়ে মার কাছে সেই টাকা পাঠাব, আমার পরিবার প্রতিটা উৎসবে সামিল হবে। ব্যাস এইটুকু,
এ বছরে আমাদের ঘরে নবান্নর উৎসব পালিত হবে খুব ঘটা করে, পৌষ লক্ষ্মীর পুজো হবে আমাদের ঘরে।
আজ আমার নাম সার্থক হল বুঝি। হ্যাঁ টগর, বারো মাস দেবতার চরণে ঠাঁই পাওয়া ফুল হল টগর, আর আমি বাবুদের চরণে নিবেদিত হই আজ, কাল, পরশু, বারো মাস। এ এক অন্য উৎহব আমার কাছে, যে উৎসবে মাততে আমার সারা শরীর আমার মন আমাকে লজ্জায় ফেলে। তবুও এই এক অন্য উৎসবে মাতি আমি রোজ, এ উৎসব আমাকে অন্ন দেয়, আমার মার মুখে হাসি ফোঁটায়, এই উৎসবের চাদরে মুড়ে নতুন করে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখি আমি, স্বপ্ন দেখতে তো মানা নেই।