এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজার বড়দিন
-জুয়ান বস্চ
অনুবাদ- বর্ণালী জানা সেন
ঐ দূরে একটা গাছের আবছা অবয়ব দেখা যায়যেন! ঐ তো ঐ বিশ হাত দূরে। রাত তবে ভোর হয়ে আসছে।অনুমানে কোন ভুল ছিল না, কিন্তু এই এই অনুমানের ওপর নিজের ভাগ্যটাকে ছেড়ে দিয়ে বড় ভুল করে ফেলেছিল এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজা। দিনের আলো ফুটছে। এবার তো একটা গা ঢাকা দেওয়ার জায়গা না হলেই নয়। ফেরার অপরাধী সে। কিন্তু কোথায় লুকোবে? রাস্তার ডানদিকে ওই পাহাড়গুলোর কোনও একটার গুহায় নাকি বাঁ দিকে আখের খেতে? আখের খেতই ভালো। ওখানে লোকের নজর পড়বে কম! আর এই সিদ্ধান্তটাই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াল মেন্ডোজার। আজ ২৪ ডিসেম্বর। কাল বড়দিন। আকাশে-বাতাসে খুশির সুর। সকালের মিঠে রোদের আদর গায়ে মেখে আখের খেতে আয়েস করে শুয়ে পড়ে সে।
সকাল সাতটা। মেন্ডোজার প্ল্যান মাফিকই সব এগোচ্ছে। এদিকের রাস্তায় এখনও কেউ আসেনি। ঠান্ডা বাতাসে একটা জোলো ভাব। বোধহয় বৃষ্টি হবে আজ। তবে এ আর নতুন কী! প্রতিবার বড়দিনের আগেই তো এখানে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টিও না হলেও বা কী! মানুষের ফুর্তিতে আজ আর কোনও লাগাম পড়বে না। যত রাজ্যের লোক কোম্পানির দোকানে গিয়ে জুটবে। পাঁইট পাঁইট মদ গিয়ে সকাল থেকে হল্লা মাচাবে। আজকে যে সবাইকে আনন্দ করতে করতে হবে। এটাই যে দস্তুর। কিন্তু সে যদি পাহাড়ের দিকে যেত তাহলে একটা না বিপদ হতই। কথায় বলে না সাবধানের মার নেই। পাহাড়ের দিকটাকে সে হাতের তালুর মতো চেনে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে কুঁড়ে বানিয়ে অনেক মানুষ থাকে সেখানে। তারা ওখানে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে, ভুট্টা-শাক-সব্জি বোনে। এরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে চিনিকলের দোকানে বেচতে যায়। আর সে যদি এদেরই কোন একজনের নজরে পড়ে যায়! আর রক্ষে নেই তাহলে। কথা পাঁচ কান হতে সময় লাগবে না। বাতাসের মতো হু হু করে খবর ছড়িয়ে পড়বে। এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজার ওপর হুলিয়া রয়েছে। এখানে কেউ তাকে লুকিয়ে রাখার সাহস করবে না। যে রাখবে সেও প্রাণে মরবে। এখানে সবাইকে পাখি পড়া করে একটা কথা শেখানো হয়েছে…মেন্ডোজার কোনও খবর পেলেই কোতোয়ালিতে জানাতে হবে।
সকালের নরম রোদে…ঠান্ডা বাতাসে মেন্ডোজার মনটাও একটু শান্ত হয়। দিনের বেলায় এখানেই সে সবচেয়ে নিরাপদ! এখানে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। ভাগ্যদেবী একটু মুচকি হাসেন।
ঠিক এইসময় মান্দিতোর মা-ও ঠিক একই কথা ভাবছিল। দোকানে ঐ মোদো-মাতালগুলো ভিড় জমানোর আগেই যদি পা চালিয়ে মান্দিতো সক্কাল সক্কাল সেখানে পৌঁছে যেতে পারে! লোকের বাড়ি কাপড় কেচে…মুরগি চরিয়ে কয়েক পয়সা জমিয়েছে মান্দিতোর মা। মুরগি চরাতে ঐ পশ্চিমে কতদূর যেতে হয় তাকে! প্রায় আধ বেলার হাঁটা পথ। বড়দিনের জন্য কত কষ্ট করে পয়সা কটা সে জমিয়েছে! আজ সে মান্দিতো-কে দিয়ে দোকান থেকে একটু ময়দা, কড মাছের একটা টুকরো আর একটু চর্বি আনাবে সে। সে গরিব হতে পারে কিন্তু আজ এই আনন্দের দিনে বাচ্চাগুলোকে কি সে উপোসী রাখতে পারে? আর কিছু না হোক একটু কড মাছ খেয়েই নাহয় তারা বড়দিন পালন করবে।
তাদের ছোট্ট গ্রামটা পাহাড়ের দিকে। গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। রাস্তার একদিকে আখের খেত…আর অন্যদিকে ধূসর বন্ধ্যা জমি। গ্রামে সবমিলে প্রায় চোদ্দ, পনেরোটা মতো বাড়ি। বাড়ির ছাদগুলো তালপাতা দিয়ে ছাওয়া। মেন্দিতো পয়সা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় একটু দাঁড়ায়। চিনি তৈরির মরশুমে এ রাস্তায় গাড়ির ভিড় লেগেই থাকে। গাড়ি ভর্তি আখ যায় চিনিকলের দিকে। আকাশটা আজ ঝক ঝক করছে। সবুজ আখের খেতে নরম রোদ ঠিকরে পড়ছে। সকালের মৃদুমন্দ বাতাসে মনে যেন ঘোর লেগে যায়। কিন্তু দোকানটা সেই কতদূর! সে কি এতটা রাস্তা একা একা যাবে নাকি? এতটা পথ সে একা একা যায় কী করে? কিন্তু সঙ্গীই বা সে পায় কোথা থেকে? যেমন ভাবা অমনি কাজ। একছুটে সে চলে যায় এক পড়শির বাড়ি। ছয় সপ্তাহ আগে ওদের একটা কালো কুকুর ছটা বাচ্চা দিয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটাকে বাড়ির মালিক একে ওকে দিয়ে দিয়েছে। এখন রয়েছে মাত্র একটা। জীবনে স্নেহ-ভালোবাসা বিশেষ পায়নি মান্দিতো। কিন্তু নিজের যত আবেগ…যত ভালোবাসা সব এই কুকুরছানাটার ওপরই সে উজাড় করে দিয়েছে। ন বছর মাত্র বয়স। কিন্তু জীবন তাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। তার ছোট মাথার বুদ্ধিতে সে জানে কুকুরছানাটা কিছুতেই অতদূর হাঁটতে পারবে না। কোলে নিয়েই যেতে হবে। কিন্তু ছানাটাকে সে নেবেই। আগুপিছু না ভেবেই সে ছুটে যায় ওফেলিয়াদের বাড়ি… ‘মিস ওফেলিয়া আমি আজাবাখ-কে একটু নিয়ে যাচ্ছি’। এই বলেই সে কুকুর নিয়ে ছুট। কুকুরের মালিক কী বলল না বলল তা আর শোনার ধৈর্য নেই। সে অনুমতি চেয়েছে। ব্যস। কুকুরটাকে কোলে নিয়ে ছুটতে ছুটতে একসময় চোখের আড়ালে চলে যায়। আর তখন থেকেই শুরু হয় এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজার ভাগ্যের খেলা।
সকাল নটা। মান্দিতো যে রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছে সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে মেন্ডোজা। এমন সময় মান্দিতোর কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আখের খেতের দিকে ছুটে যায় কুকুরছানাটা। ছোট্ট তুলতুলে একটা শরীর। এতটা দূর আসতে নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে পড়েছে। তাই আখের খেতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে চায়। আর নাহলে এদিক-ওদিক ছুটে ছুটে একটু খেলতে চায়। একটা বাচ্চার গলা কানে আসে মেন্ডোজার। বাচ্চাটা একতা কুকুরের নাম ধরে ডাকছে… ‘আজাবাখ…কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া…দাঁড়া বলছি’। শিরদাঁড়া দিয়ে হিমশীতল শ্রোত বয়ে যায় মেন্ডোজার। এই বাচ্চাটা পুলিশের কোন চর-টর নয়তো? আকাশটা পরিষ্কার। আখের ঘন জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে যতটা দেখা সম্ভব তা দেখার চেষ্টা করে। নাহ, বাচ্চাটাকে তো দেখা যাচ্ছে না। মেন্ডোসা বোকা-হাবা নয়। মাথায় সে যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে। বাচ্চাটা যদি দেখে ফেলে যে সে এখানে লুকিয়ে রয়েছে তাহলে বিপদ। তার চেয়ে এখানে পিছন ফিরে শুয়ে মটকা মেরে পড়ে থাকবে। আর টুপি দিয়ে মুখটা আড়াল করে নিলে আর কোনও চিন্তা নেই।
আখের ক্ষেতে তিড়িং, বিড়িং করে ছুটছে কুকুরছানাটা। খেতের মাঝে আস্ত একটা মানুষকে শুয়ে থাকতে দেখে কুকুরছানাটা ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। তার পেছনে ছুটতে ছুটতে মান্দিতোও চলে আসে। কিন্তু সেখানে এসেই তার চক্ষু চড়কগাছ! ঐ লোকটা খেতে ওভাবে শুয়ে আছে কেন? কোন নড়া চড়া নেই! লোকটা কি তবে মরে গেছে। ওটা তাহলে লাশ! ভয়ে কুঁকড়ে যায় মান্দিতো। ভূতে ধরার আগেই তাকে এখান থেকে ছুটে পালাতে হবে। কিন্তু আজাবাখকে তো ফেলে যাওয়া যাবে না। ওটার ঘেউ ঘেউ-তে বিরক্ত হয়ে ভূতটা হয়তো ওর গলাই টিপে দেবে। আজবাখ-কে ছাড়া সে যে পালাতেও পারছে না। এখানে আর মুহূর্ত দাঁড়ালে সে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তার শরীরে আর নড়ার মতো শক্তি নেই। ভূতগ্রস্থের মতো সে তাকিয়ে থাকে মরা লোকটার দিকে। কুকুরটা লোকটার পাশে বসে ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। লাশটা যেকোনো মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে তার টুঁটি চেপে ধরবে। মনে সাহস এনে লাশটার দিকে এগিয়ে কুকুরটাকে একহাতে তুলে পড়ি-কি-মরি করে ছুট লাগায় মান্দিতো। আখের ধারালো পাতায় হাত-পা-মুখ ছড়ে যায়। কিন্তু সেদিকে তার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রাণভয়ে সে ছোটে। ছুটতে ছুটতে সে একেবারে দোকানে এসে থামে। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীর…মনে চোরা আতংক…মান্দিতো ভাবে এক্ষুনি বুঝি সে মাথা ঘুরে পড়বে। আঙুলটা দেখিয়ে ভাঙা গলায় একটাই কথা সে বলে উঠতে পারে… ‘ঐ যে ওখানে আদেলা-তে একটা লাশ পড়ে রয়েছে’?
‘কী? এ ছোঁড়া বলে কী!’…পেছন থেকে এই বাজখাঁই গলা শুনে মান্দিতোর-তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। হবে নাই বা কেন? চিনিকলের স্টেশন চিফ সার্জেন্ট রেই-এর হাব, ভাব, হাঁটা, চলা দেখলে যেকোনো মানুষের বুক-ই ভয়ে দুরু দুরু করে। দোকানে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর কৌতূহল বাড়ে। বাচ্চা ছেলেটা যা বলেছে তা কি সত্যি!
বড়দিনের আগে আজ তো লাশের সুরতহালের জন্য লা-রোমানার জাজ-কেও পাওয়া যাবে না। গলা অবধি গিলে কোথায় সে আজ ফুর্তি করে বেড়াচ্ছ! তবে সার্জেন্ট পিছু হঠার পাত্র নন। বাচ্চাটার কথাটাকে তিনি পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছেন না। পনেরো মিনিটের মধ্যেই দুজন পুলিশকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। লাশটা যেখানে পড়ে রয়েছে সেখানেই যেতে হবে তাঁকে। ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখতে হবে। দু-পয়সার মজা লুটতে দশ-বারোজন লোকও তাঁর পিছু নেয়। ভাগ্য যে তার এমনভাবে বিরূপ হবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজা।
ভাগ্যদেবীর কাছে সে তো বেশি কিছু চায়নি। বউ-বাচ্চার সঙ্গে সে বড়দিনের আগের রাতটা কাটাতে চেয়েছে। কতদিন সে ওদের দেখে না! ঐ দূরে সেইবো প্রদেশে পাহাড়ের গোপন ঘাঁটি থেকে পায়ে হেঁটে এতটা দূর এসেছে সে। দিনের বেলায় সে গা-ঢাকা দিয়ে থেকেছে…আর সারা রাত ধরে হেঁটেছে। এই ভাবে কেটে গেছে দিনের পর দিন…রাতের পর রাত। কোনও ঘরবাড়ি, খেতখামারের ধারে কাছে ঘেঁসেনি সে। কখন কে দেখে ফেলে! এ তল্লাটের সবাই জানে সে একজন ফেরারি আসামী। কর্পোরাল পমারেস-কে সে খুন করেছে। কেউ তাকে দেখে ফেললে অনর্থ হয়ে যাবে। একমাত্র নিনাকে আর বাচ্চাগুলোকেই সে দেখা দেবে। বড়জোর দু-এক ঘণ্টা। এর বেশি সে নিনার কাছেও থাকতে পারবে না। তবু তার কাছে ওইটুকুই যথেষ্ট। তার জন্য সে সব কষ্ট সইতে পারে। আজ ছ’মাস হল তাড়া খাওয়া পশুর মতো সে ছুটে বেড়াচ্ছে। আজ এখানে, কাল ওখানে। সেন্ট জনস-ডে তেই তো কান্ডটা ঘটল। তার হাতে বেমালুম খুন হয়ে গেল কর্পোরাল পমেরেস। সেই থেকেই তার ফেরার জীবন।
আজ তাকে নীনার কাছে…বাচ্চাদের কাছে যেতেই হবে। যে করেই হোক। কোনও এক অদৃশ্য…আদিম শক্তি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে যাকে ঠেকানোর ক্ষমতা তার নেই। বউকে বুকে জড়িয়ে ধরা…বাচ্চাদের গল্প শোনানোর মধ্যে যে আনন্দ তা কিন্তু অবিমিশ্র নয়। মেন্দোজা জানে তার মধ্যে একটু ঈর্ষাও রয়েছে। একবার সে তার সুখের নীড়টাকে দেখতে চায়। ফেলে আসা দিনগুলোকে আর একবারের জন্য ফিরে পেতে চায়। এই তো যেন সেদিনের কথা। সারাদিন খাটুনির পর সন্ধে বেলা সে খেত থেকে ফিরত। কুপির টিমটিমে আলোয় বাচ্চারা তাকে ঘিরে বসত। তার মজার মজার গল্প শুনে বাচ্চারা সব হেসে গড়িয়ে পড়ত। সে জানে ঐ দিনগুলো…ঐ হাসিকান্নার দিনগুলো আর ফিরে আসবে না তার জীবনে। ধুলোমাখা রাস্তা দিয়ে সে শরীরটাকে কোনোমতে ঠেলে নিয়ে যায়। বর্ষা এলেই এই পথ পুরো খানা-খন্দে ভরে যাবে। পদে পদে মৃত্যু আজ ওঁত পেতে রয়েছে। সব বাধা পেরিয়ে আজ তাকে যেতেই হবে বাড়ি।
এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজা এক কথার মানুষ। কোনও মন্দ স্বভাব তার নেই। তবে তার আত্মসম্মান বোধ প্রবল। তাই সেন্ট জন্স-ডেতে কর্পোরাল পমেরেস যেখন যখন তাকে অকারণেই এসে ঠাসিয়ে থাপ্পড় মেরেছিল তখন সে চুপ থাকতে পারেনি। তার আত্মসম্মানবোধ তাকে চুপ থাকতে দেয়নি। তারও হাত উঠে গিয়েছিল। আজ সে এক ফোঁটাও মদ ছোঁয়নি। কিন্তু তাও সে টলছে। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে সে। বাড়ি ফেরার প্রবল ইচ্ছেটাই আজ তাকে চালিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আজ স্বয়ং ভগবানও তাকে আটকাতে পারবেনা। বড়দিনের আগের এই রাতটা সেবাড়িতেই কাটাবে… বউ বাচ্চাদের সঙ্গে। নিনা আর বাচ্চাগুলো কত কষ্টের মধ্যে রয়েছে। আজ এই আনন্দের দিন তাদের হাতে এক পয়সাওনেই! বাচ্চাগুলো হয়তো বাবার জন্য কান্নাকাটি করছে। ভাবতেই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায় মেন্ডোজার।
কিন্তু তার সব পরিকল্পনা আজ ঘেঁটে গেল। বাচ্চাটা গিয়ে কীকরবে তার ওপরই এখন সবকিছু নির্ভর করছে। ভাগ্যতার এখন সুতোর ওপর ঝুলছে। বাচ্চাটা কিমুখ বন্ধ রাখবেনা কিসব কিছু ফাঁস করে দেবে। বাচ্চাটার পায়ের ধুপ ধাপ শুনে মনে হয়েছে সেছুটতে ছুটতে পালিয়েছে। ভেবেছে হয়তো খেতের কোন মুনিষ কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তবু সাবধানের মার নেই। এই খেত থেকে পালিয়ে অন্য একটাতে আশ্রয় নেওয়াই বুদ্ধিমানের। কিন্তু সে কাজেও তো বিপদ কম নেই। এর মধ্যে কেউ যদি আসা-যাওয়ার পথে তাকে অন্য খেতে ঢুকতে দেখে ফেলে! তাহলেই তো খেল খতম! না না…তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে সে এখানেই নিরাপদ। রাত নটায় সে এখান থেকে বেরোবে। পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগারোটা…সওয়া এগারোটা নাগাদ সে বাড়ি পৌঁছে যাবে। এর পর কী করতে হবে সে জানে। জানালা দিয়ে ফিসফিস করে সে বউকে ডাকবে… ‘শুনছ, দরজাটা শিগগির খোল…এই যে আমি এসেছি’। চোখের সামনেই সে যেন এখন নিনাকে দেখতে পাচ্ছে…আলুথালু বেশ…চুলে তেল নেই…চিরুনি পড়েনি। শুধু কালো চোখদুটো তার চকচক করছে। আজ তাকে বাড়ি যেতে হবে। এটাই এখন তার বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য। তার আগে নিজেকে কিছুতেই ধরা দেবে না মেন্ডোজা। এখন বরং একটু ঘুমিয়েই নেওয়া যাক।
কতগুলো ভারি বুটের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। শোনা যায় একটা বাচ্চার গলা… ‘এই যে সার্জেন্ট এখানে…এখানেই লাশটা পড়ে ছিল’।
‘কিন্তু কোন খেতে? এটাতে নাকি অন্যটায়?’
‘না না এখানেই’…আশ্বাস দেয় বাচ্চাটা।
বাচ্চাটার শেষ কথাটা নিয়ে তো ভাবতে হয়ে। ‘এখানে’ বলতে সে কী বুঝিয়েছে? এনকারনেশিয়ন যেখানে লুকিয়ে আছে সেটা? নাকি পাশেরটা? নাকি সামনেরটা? গলা শুনে মনে হয় সার্জেন্ট আর বাচ্চাটা একটু দূরেই আছে…মনে হয়ে দুটো খেতের মাঝের রাস্তাটায়। বাচ্চাটা কোন খেত দেখিয়েছে তার ওপরই নির্ভর করছে সবকিছু। তাকে ধরার জন্য লোকজনেরা সব কাছাকাছিই চলে এসেছে। এখন আর বসে বসে ভাবলে চলবে না, কিছু একটা করতেই হবে…জলদি। খুব সাবধানে বুকে ভর দিয়ে অন্য খেতে যাওয়ার চেষ্টা করে সে…খুব সাবধান থাকতে হবে। যেন কোনও শব্দ না হয়। হলেও লোকেরা যেন ভাবে… ‘এ কিছু না…এতো পাতার শনশন’। তাকে এক্ষুনি এখান থেকে সরে যেতে হবে। ওদিকে শোনা যায় সার্জেন্টের কর্কশ গলা… ‘নেমেসিও তুমি ওইদিকে যাও…আর আমি যাচ্ছি ঐ পাশে…সলিতো তুমি এখানেই থাকো’।
লোকগুলো এখন রাগে গজগজ করছে। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে মেন্ডোজা অন্য খেতের দিকে এগোতে থাকে। লোকগুলোর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারে যে তাকে ধরার জন্য বেশ অনেকজনই এখানে এসেছে। ব্যাপারটা তো ভালো হচ্ছে না। তার জন্যও নয়…আর বাচ্চাটার জন্যও না…তা সে যেই হোক না। সার্জেন্ট রেই আর তার শাকরেদ নেমেসিও আরোয়ো আখের খেত তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলে। তাদের ভারি বুটের তলায় কচি আখের চারাগুলো একেবারে পিষে যায়। তাদের হাত-পা ছড়ে। এত খোঁজাখুঁজির পরেও কোনও লাশ মেলে না। তবে কি সব ভুয়ো খবর!
‘এই বাচ্চা এদিকে শোন…লাশটা কি এখানেই ছিল? তুই ঠিক দেখেছিস?’
ভয়ার্ত গলায় মান্দিতো বলে… ‘হ্যাঁ, এখানেই তো ছিল।
এইসব বাচ্চা-কাচ্চাদের কথায় ভরসা নেই নেমেসিওর… ‘স্যার, ছেড়ে দিন। ছেলেমানুষ। কী বলতে কী দেখেছে। আমি বলছি এখানে কিচ্ছু পাওয়া যাবে না’।
সার্জেন্ট কটমট করে তাকাতেই বুকের ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে যায় মান্দিতোর… ‘না স্যার। আমি আজাবাখকে নিয়ে এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তা কুকুরছানাটা আমার কোল থেকে নেমে ছুটতে শুরু করে’…এই বলে কোল থেকে কুকুরটাকে নামিয়ে রাখে মান্দিতো… ‘তারপর হল টা কী…ও ব্যাটা ছুটতে ছুটতে ওদিকে চলে যায়…
বাচ্চাটাকে ধমকে থামিয়ে দেয় সার্জেন্টের আরেক শাকরেদ সলিতো রুইজ। ওত বক বক শোনার আর ধৈর্য নেই তার… ‘এই ছোঁড়া, লোকটাকে দেখতে কেমন’।
ভয়ে কেঁপেই যাচ্ছে মান্দিতো… ‘আমি ওর মুখ দেখিনি। শুধু জামা-কাপড় দেখেছি। মুখটা টুপি দিয়ে ঢাকা ছিল। এই যে এই ভাবে পাশ ফিরে শুয়েছিল লোকটা’।
‘কী রঙের প্যান্ট পরেছিল?’
‘নীল…আর হলদে জামা। মাথায় কালো টুপি…
ভয়ে গলা দিয়ে আর আওয়াজ বেরোয় না মান্দিতোর। পা কাঁপে। বুক দুর দুর। কান্না পেয়ে যায়। এ নিয্যশ ভূতের কাণ্ড। ভূতেরা চাইলে সব করতে পারে। ভূতটা ইচ্ছে করেই এখান থেকে সটকে পড়েছে যাতে মান্দিতো সবার কাছে মিথ্যুক হয়ে যায়। এই ভূত সুযোগ পেলেই তার ঘাড় মটকাবে।
মান্দিতো যা ভাবে ভাবুক, কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল এত খোঁজাখুঁজির পরও লাশের কোন চিহ্ন মেলে না। অন্তত এই খেতে। অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় এখেত থেকে ওখেতে গিয়ে লুকোয় মেন্ডোজা। অন্য খেতে গিয়েই আবার বিপদ আসে। ঠিক ঐ পথ দিয়েই কুকুরটাকে কোলে নিয়ে আসছিল বাচ্চাটা। লাশ খুঁজে না পেয়ে বাচ্চাটকে এক রকম ভাগিয়েই দিয়েছিলেন সার্জেন্ট। এবার বাড়ি ফেরার পথে সে দেখে লাশটা নিজেই নিজেই অন্য একটা খেতের মধ্যে গিয়ে ঢুকছে। হ্যাঁ হ্যাঁ এটা তো সেই লাশ! জামা কাপড় সব তো এক!
‘এই তো সার্জেন্ট এখানে…এই তো এদিকে গেল’…এই বলে জায়গাটা দেখিয়ে দেয় মান্দিতো।
ভয়ে আর কোনও কথা বলতে পারে না সে। সার্জেন্টকে জায়গাটা দেখিয়েই দে ছুট…একেবারে বাড়িতে এসে সে থামে। কী উটকো ঝঞ্ঝাটে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল সে! ওদিকে বাচ্চাটার গলা শুনে সার্জেন্ট তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে ছুটে আসেন।
নেমেসিও এখনও সেই একই কথা বলে যায়… ‘ছেলেমানুষের কথা কিছু ধরবেন না স্যার’।
কিন্তু সার্জেন্ট ঘাঘু লোক। ডাল মে কুছ কালা তো জরুর হ্যায়… ‘দেখো কিছু না কিছু তো আছে বটেই। সবাই মিলে খেত ঘিরে ফেলো’।
শুরু হল চিরুনি তল্লাশি। অথচ শিকারিরা এটাও জানে না যে কীসের শিকারে চলেছে তারা। সকাল গড়িয়ে এখন মাঝ দুপুর। তল্লাশির জন্য ছোট ছোট দল তৈরি হয়। প্রতিটা দলে একজন সৈন্য আর জনাকয়েক মুনিষ। দলগুলো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে খোঁজ শুরু করে। বড়দিনের আগে সবার পেটেই দু-এক পাত্তর পড়েছে। তাই সবার উত্তেজনাটাও একটু যেন বেশি-ই। ওদিকে ঈশান কমে জমে ওঠে মেঘপুঞ্জ। সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে জলভরা কালো মেঘ। এই বৃষ্টি নামল বলে! এখন চারদিক থেকে লোকজন ঘিরে ফেলেছে মেন্ডোজাকে। সার্জেন্টের দলবল নাহয় জানে না তারা কীসের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মেন্ডোজা তো জানে! তাকে ধরার জন্যই এতসব আয়োজন। সেন্ট জন্স-ডে তে যা ঘটেছিল তারই প্রতিশোধ নিতে এসেছে এরা।
সৈন্যরা সব কোথায় রয়েছে এখান থেকে বুঝতে পারে না সে। শুধু জানে তাকে পালাতে হবে…যে করেই হোক। সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে সে এখেত ওখেত ছুটে বেড়ায়। হ্যাঁ এবার সে অনেকটা দূরে চলে এসেছে। এখানে সে যদি চুপচাপ ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে তাহলে কেউ তাকে ধরতে পারবে না। তারপর সে অনায়াসে ন’টা নাগাদ বেরিয়ে যাবে। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি রয়েছে। কেউ যেন তার কানে কানে এসে বলে যায়… ‘পালাও, পালাও’। সে খেতের মধ্যে ছোটাছুটি করতেই থাকে। আর এই করতে গিয়েই ধরা পড়ে। দূর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে ওঠে… ‘ঐ যে ও পালাচ্ছে। ধর্ ধর্। ওকে দেখতে পুরো এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজার মতো’।
মেন্ডোজার নাম শুনে সবাই মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। তবে এই সেই খুনি…যে এতদিন সবার চোখে ধুলো দিয়ে বেড়াচ্ছে!’
‘সবাই ওদিকে চল’…গর্জন করে ওঠেন সার্জেন্ট। যেদিকে আসামীকে দেখা গিয়েছিল সেই দিক লক্ষ্য করে রিভলভার হাতে সার্জেন্ট ছুটে যান।
কালোমেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। কেমন যেন বিশ্রী দমবন্ধ করা, গুমোট পরিবেশ। তবে শিকারিদের সেদিকে লক্ষ্য নেই। তারা এখন শিকারের গন্ধ পেয়েছে। আখের খেত দুমড়ে-মুচড়ে, পায়ে মাড়িয়ে তারা ছুটছে। আসামীকে হাতেনাতে ধরা চাই। ঐ দূর থেকে আবার মেন্ডোজার চেহারাটা দেখা যায়। ঝড়ের বেগে সে ছুটছে। তার দিকে ভালো করে বন্দুকটা তাকও করতে পারল না সলিতো রুইজ।
সার্জেন্ট চেঁচিয়ে নির্দেশ দেন… ‘যাও…তুরন্ত চিনি কলে যাও। আরো কয়েকজন সেনাকে পাঠাতে বলো’।
শিকারিরা এলোপাথাড়ি ছোটে। ঠিক কোন দিকে যাবে ঠাহর করে উঠতে পারে না। সব গুলিয়ে যায়। একবার খেতে ঢুকতে যায়…পরের মুহূর্তেই পিছিয়ে আসে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। চিনিকল থেকে আরো তিনজন সেনা আসে। সঙ্গে ন, দশজন মুনিষ। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা নানান দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দূরে একজন সেনা আর জনাকয় মুনিষকে দেখা যায়। তারা গুলি চালাতেও পারে না…যদি কোনও নিরীহ পথচারী মারা পড়ে! চিনিকল থেকে পিল পিল করে লোকজন বেরিয়ে আসে। মেয়েরাও বাদ যায় না। আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারে নাতারা । যাকে সামনে পায় তাকেই জিগ্যেস করে… ‘এখনও কি ধরা পড়েনি?’
এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজা অত সহজে দমার পাত্র নয়। মরার আগে সে কিছুতেই মরবে না। আখের খেত আর পাহাড়ের মাঝবরাবর যে রাস্তাটা চলে গেছে বেলা তিনটে নাগাদ সেখানে ওঠে মেন্ডোজা। রাস্তা থেকে ঝাঁপ দিয়ে সে পাহাড়ে উঠতে যাবে এমন সময় পিঠে তীব্র যন্ত্রণা। বুলেটটা সোজা এসে বিঁধেছে তার শিরদাঁড়ায়। পলক ফেলতে না ফেলতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। একটা নয়, দুটো নয় পরপর চোদ্দটা বুলেট এসে বেঁধে মানুষটার শরীরে। কথার বলে না শয়তানের শেষ রাখতে নেই। সেনারা গুলি চালিয়েই যায়। এর মধ্যে বৃষ্টি নামে। সকাল থেকে আকাশজুড়ে যে মেঘের সাজ শুরু হয়েছিল তাই এখন সহস্রধারায় ছড়িয়ে পড়ে মাটির বুকে।
এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজা মরে কাঠ। তার মুখে কোনও গুলির দাগ নেই…কোন বিকৃতি নেই। কিন্তু মাউজারের গুলিতে দাঁতগুলো সব বিচ্ছিরিভাবে ভেঙে গেছে। কাল বড়দিন। এই হতভাগ্য লোকটা এতটা পথ উজিয়ে শুধু বাড়িতে ফিরতে চেয়েছিল… জীবিত বা মৃত। বৃষ্টি থামার লক্ষ্মণ নেই। সার্জেন্ট রেই মনে মনে কিছু একটা ছক কষেন। লাশটাকে নিয়ে এখন কী করা যায়! লাশটাকে যদি পশ্চিমে বড় রাস্তায় নিয়ে যায় তাহলে দিনের দিনই মারকোইস-এ পৌঁছনো যাবে। তাহলে আজই ক্যাপ্টেনের হাতে বড়দিনের উপহারটা তুলে দিতে পারবেন তিনি। আর তা যদি না হয় তাহলে এটাকে বয়ে বয়ে নিয়ে যেতে হবে চিনিকলে। সেখানে আবার কোম্পানির ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ট্রেন আবার বেশিরভাগ সময়তেই লেট।সময়মতো আর মারকোইসে পৌঁছনো যাবেনা। কিন্তু বড় রাস্তায় গেলে অনেক গাড়িঘোড়া পাওয়া যাবে। যেকোনও একটা গাড়ি বালরি থামিয়ে যাত্রীদের ধমকে নামিয়ে লাশটা নিয়ে উঠে পড়তে পারলেই হল।
‘ঘোড়ালাও…জলদি…এই লোফারটাকে বড় রাস্তায় নিয়ে যেতে হবে’…হাঁকদে্ন সার্জেন্ট।
ঘোড়া পাওয়া যায়না। আসে একটা দুবলাগাধা। মুষলধারে বৃষ্টি…কোনো বিরামনেই। কচি আখের পাতায় ঝরে পড়ে জলের দানা। আর সময় নষ্ট করতে চাননা সার্জেন্ট। বড্ড তাড়া। কয়েক জন মুনিষ মিলে লাশটাকে গাধার পিঠে যতটা সম্ভব ততটা শক্ত করে বাঁধে। গাধাটাকে নিয়ে রওনা দেন সার্জেন্ট। পেছন পেছন দু-জন সেনা আর দু-তিনজনলোক। সার্জেন্ট বলে্ন এইবৃষ্টি-বাদলা রমধ্যেই সবাই কে যেতে হবে। থামলে চলবেনা।
বৃষ্টিতে রাস্তা ঘাট পিছল। রাস্তা জোড়াগর্ত। গাধাটার পাহড় কেযায়… জল কাদার মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এরমধ্যে তিন-তিনবার লাশটা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যায়। সৈন্যসামন্তরা প্রথমে প্রথমে টুপি দিয়েই মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করে… তারপর তালপাতা কেটে, গাছের ছালকেটে মাথাঢাকে। বৃষ্টির বেগবাড়লে কিছুক্ষণের জন্য সবাই আখের খেতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। জলের তোড় আর থামেই না। এর মধ্যেই আবার চলা শুরু। কারোমুখে কোন কথা নেই। মাঝে মাঝে নৈশব্দ চিরে ভেসে আসে দু-একজন সেনার গলা…‘ বেজম্মাটাকে দেখ একবার’… ‘এতদিনের কর্পোরালপ মেরে সের আত্মা শান্তি পেল’।
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝড়-জলের জন্য আজকের সন্ধেটা যেন ঝুপ করে নেমে এসেছে। অন্ধকারে এখন পথ চলা দায়। কোথাও জল জমে রয়েছে… কোথা ও বড়গাড্ডা। পা-টিপে টিপে সবাই এগোয়। সন্ধে সাতটা নাগাদ বৃষ্টিটা অনেক ধরে আসে। হঠাৎ-ই একজন মুনিষ চেঁচিয়ে অঠে… ‘ওই যে ঐ দূরে একটা আলো দেখতে পাচ্ছি’।
‘হ্যাঁ ঐ গ্রাম থেকে’…এই কথা বলেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায় সার্জেন্টের। এই প্ল্যানটা ভেঁজে তার কলিজাটা একটু ঠান্ডা। ব্যাটা মরেছে তো কী হয়েছে। যে পাপ সে করেছে তাতে আরো কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। মিনিট পনেরো পর অবশেষে একটা কুঁড়ে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় সৈন্য-সামন্তের দল। কর্কশ গলায় আবার চেঁচিয়ে ওঠেন সার্জেন্ট… ‘লাশটার বাঁধন খোলো…আর ওটাকে ঐ ঘরের ভেতর ছুঁড়ে ফেলে দাও। কতক্ষণ আর ভিজব’! এখন গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি পড়ছে। একটু পরেই হয়তো থেমে যাবে। সার্জেন্ট দেখে তার লোক-লস্কর অনেক কসরত করে বাঁধনটা খুলেছে। ঠিক এই সময় কুঁড়ের দরজায় গিয়ে টোকা দেন সার্জেন্ট। মহিলা দরজা খুলতেই তার পায়ের ওপর লাশটাকে ছুঁড়ে দিয়েই তারা পালায়। মহিলা তো হতবাক। কিছু একটা ভারী জিনিস এসে পড়ল মনে হয়! আরে এতো একটা লাশ! মেন্ডোজার লাশ! জলে-কাদায়-রক্তে মাখামাখি। দাঁতগুলো কী বিচ্ছিরিভাবে ভেঙেছে! মানুষটাকে আর চেনাই যায় না! এ যেন মেন্ডোজার প্রেতাত্মা! পায়ের কাছে পড়ে থাকে নিথর মাংসপিন্ডটার দিয়ে সে তাকিয়ে থাকে ভাবলেশহীন। অনেকক্ষণ পর পুরো ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে তার…বেরিয়ে আসে বুকফাটা আর্তনাদ… ‘ওরা ওকে মেরে ফেলেছে…এনকারনেশিয়নকে মেরে ফেলেছে ওরা…আমার বাচ্চারা যে অনাথ হয়ে গেল!’
মায়ের কান্না শুনে বাচ্চারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মাকে জড়িয়ে ধরে তারাও কাঁদে। শুধু ছোট ছেলেটা ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপে… ‘মাম্মা…মাম্মা…ওই লোকটা… ঐ লাশটাকেই তো আমি সকালে আখের খেতে দেখেছি’!