.. তবুও একটু ভাবুন
-রীণা চ্যাটার্জী
সুধী,
স্তব্ধতা ভর করেছে মনে, বুকের ওপর একরাশ দমচাপা কষ্ট, কলম ভেবে পায় না কি লিখবে.. কি লিখবে না.. কারণ বোধহয় অসহায়তা। একটু যখন বড়ো হলাম, মা বলতো, “আগে মা হ’ তবে বুঝবি..” না আমি বা আমরা বোধহয় আমাদের সন্তানদের এই কথা বলতে পারবো না, অন্তত বোধসম্পন্ন অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের এই কথা বলতে পারবেন না। আমরা অভিভাবকরা যে আশঙ্কা আর দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি, কি করে ওদেরও বলি– ওদেরও হোক এই অভিজ্ঞতা।
ওরা (ছাত্রছাত্রীরা) কিছু বলবে না, শুধু লেখাপড়া করবে। মেরুদন্ডহীন সরীসৃপ তৈরী হবে। এটাই বোধহয় প্রশাসনের ইচ্ছে, রাষ্ট্রবাদীদের ইচ্ছে, কিছু বিশিষ্ট নাগরিকদের ইচ্ছে। বিদ্রোহ বা বিপ্লব ধারণাটাই বদলে গেছে সমূলে, তাই এখন ছাত্রবিক্ষোভের নতুন নাম ‘দেশদ্রোহিতা’। কিন্তু আগামী যে ওদের.. আজকের পোঁতা বিষবৃক্ষের ফল যে ওদের ভবিষ্যতের পথে কাঁটা ছড়াবে, সেটা বলার কি অধিকার ওদের নেই?
ওরা যা করছে সব অন্যায়, অভিনয়, শয়তানি, সাজানো, মিথ্যে। আর ওরা এতোই তুখোড় ভন্ড যে ওদের সাজানো মিথ্যে শয়তানির অন্যায় অভিনয়ের কাছে ক্ষমতার শিরোমণিরা হার মেনে শুধু মাত্র একটু শক্ত হাতে সামলানোর চেষ্টা করছেন.. এর বেশী কিছু নয়।
রক্ত নাকি রঙ পরীক্ষার দাবী করছেন। বা দু’দিনেই মাথার ফেট্টি ছোট্ট হবার প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতির কথা মাথায় না রেখেই। অনেকেই মন্তব্য করছেন ছাত্ররা পড়তে গেছে পড়াশোনা করুক, সবেতেই মাথা গলানোর কি দরকার, বা কেউ বলছেন সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। কেউ বা ছাত্রদের বয়সের প্রশ্ন তুলছেন- প্রথমে বয়সের প্রসঙ্গে বলি, আমরাই কিন্তু কথাপ্রসঙ্গে জ্ঞান দিই শেখার কোনো বয়স নেই, তাহলে ছাত্রাবস্থার সীমারেখা কি দিয়ে টানা হয়? আর শুধু পড়াশোনা করে যাদের শান্ত থাকতে বলা হচ্ছে, তাদের যে পড়ানো হয়েছে,
“আঠেরো বছর বয়স কি দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি
আঠেরো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি…”
তাই আঠেরো এগোয়, “..সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে..” হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা সবাই জানি আঠেরো মানে এক প্রতীকি বয়েস- তারুণ্যের প্রতীক। আর তাই “..তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা..” নিয়ে “..এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো..”
তর্কে মাতি আমরা, তর্কের সুর উত্তেজিত হতে হতে উত্তপ্ত হয়ে উঠুক। ঘরে বসে নিরাপত্তার বেষ্টনীতে বসে সোস্যাল মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তুলি- আর সন্দেহের তির ছুঁড়ে দিই ওদের দিকে। থামুন একটি বার- একবারের জন্য নাহয় ভেবে দেখুন, ওরা সবাই আমাদের সন্তান- নিজের নাহলেও আত্মীয়, প্রতিবেশী, পরিচিত কারোর। বুকটা কিরকম ধড়ফড় করে উঠলো না? হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি হচ্ছে কি? সব ভুলে মনে হচ্ছে না ছুটে যাই, গিয়ে দেখি কেমন আছে প্রিয় মুখটা, হয়তো বা খুব আদরের মুখটা? এবার একবারো কি মনে হলো ওটা রক্ত না রঙ? মনে এলো? ওরা শয়তান! না, মনে হবে না- হতে পারে না। কারণ নিজের সন্তানকে সবাই চেনে- তারা ঠিক কেমন? কোন পরিস্থিতিতে কেমন কাজ করতে পারে!
বিশ্বাস করতে কিম্বা হয়তো মনে করতে ভুলে গেছি আমরা যুগ যুগ ধরে বিপ্লবের কান্ডারী কারা? মনে রেখেছি হয়তো স্মৃতির পাতায় মহান বিপ্লবীদের- ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, বাঘাযতীনদের নাম। মালা পড়াই ছবিতে, গল্প শুনি- শুধু ওঁদের বয়সটা ভুলে গেছি।
ভাববেন নাকি একবার ওঁদের বয়সের কথা?
ওঁরা ছিলেন বলে আমরা স্বাধীন ভারতের নাগরিক, ওঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন তাই অত্যাচারীর গদি টলেছিল, ওঁরা ভেবেছিলেন, ভাবতে শিখিয়েছিলেন।
আমাদের সন্তানরাও আজ আমাদের ভাবতে শেখাচ্ছে, একটু ভাবি সবাই। নাহলে হাজার যতীন জন্মাবে বাঘাযতীন আর হবে না।
ভগৎ সিং নামের সাথেই থেকে যাবে। রাম- রহিমের ফাঁদে ক্ষুদিরাম হারিয়ে যাবে। নরেন্দ্র জন্মাবে, বিখ্যাতও হবে দেশজোড়া নামে- কিন্তু বিবেকানন্দ আমরা পাবো না। তাই সন্দেহ নিয়ে নয় ভালোবাসা আর বিশ্বাস নিয়ে ওদের পাশে কি দাঁড়ানো যায় না? ওদের এই অসম, দুঃসাহসী লড়াইয়ে ওদের বলা যায় না- আমরা আছি পাশে বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দিয়ে, অপেক্ষা করছি ওদের জন্য আহ্লাদী কোলের মিঠে ঘ্রাণ নিয়ে। যদি ভুলও হয়- অবিশ্বাস নয়, সঠিক পথ বলে দিতে আমরা যেন পাশে থাকি।
জানি, অনেকেই হাসবেন। হাসুন, ঠোঁট বেঁকিয়ে ব্যঙ্গের হাসি। অসুবিধা নেই। ফুরসৎ হলেই না হয় ভাববেন- ওই ভিড়ে হাঁটা, রক্তাক্ত সাহসী বাচ্চারা আমার, আমাদের। দেখবেন অন্য বোধ, অন্য ভাষা আসবেই- অবশ্যই যদি ভাবতে খুব দেরী হয়ে না যায়- আজকের সময় যে ভীষণ অস্থির …
অস্থিরতা ভরা সময়ে সকল কলমকে কুর্ণিশ জানাই।
সকল স্বজন সাথী সাহিত্যিক, পাঠকদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আলাপী মন- এর পক্ষ থেকে।