দি এম্পটি আর্থ (দ্বিতীয় অংশ)
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
………………
পর্ব – ৬
…………….
ডক্টর দিবাকর চৌধুরী বহুদিন পর দেশে ফিরেছেন। আজকাল তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস খুব একটা করেন না। নানা গবেষণার কাজেই ব্যস্ত থাকেন তিনি। মেডিক্যাল সাইন্সের জগতে বেশ বড় রকম ক্রান্তি যে তিনি নিয়ে এসেছেন সেটা বলাই যেতে পারে। বেশ কিছু মারণ রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছেন তিনি। বিগত বেশ কিছু বছর তিনি অ্যামেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন নিজের নতুন গবেষণার কারণে। কোলকাতার এক বড় হোটেলে আজ তার সাংবাদিক সম্মেলন। সম্মেলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ঘরে ঢুকলো তার সেক্রেটারি আদিত্য বর্মন।
‘আপনি কি রেডি স্যার?’
ডক্টর দিবাকর চৌধুরী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলেন। পিছনে ফিরে তাকিয়ে বললেন – ‘আদিত্য, এসো এসো। হ্যাঁ, আমি রেডি। এখান থেকে গাড়ি করে গেলে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছতে পনেরো মিনিটও লাগবে না। এখনও হাতে অনেক সময় আছে।’
ডক্টর চৌধুরীর দিকে এগিয়ে এলো আদিত্য। বলল – ‘জানেন স্যার। কেমন অদ্ভুত লাগছে আমার। এমন একটা জিনিস এর আগে তো কোনও দিন হয়নি। ব্লাড ব্যাংক জানা ছিল। এবার অরগ্যান ব্যাংকও খুলে গেল।’
অট্টহাস্য করে ডক্টর চৌধুরী বললেন – ‘এখনও খোলেনি আদিত্য, খুলবে। জীবনের সত্তরটা বছর এমনি কাটিয়ে দিইনি আমি। মাথার চুল এমনি সাদা হয়ে যায়নি আমার। চিরকাল চেষ্টা করেছি মনুষ্য জাতির জন্য কিছু করে যাওয়ার। আদিত্য, পরবর্তী কালে মনুষ্য জাতির ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল নয়। প্রত্যেক মানুষকে একে অপরের সাহায্যে আসতে হবে। তবেই হয়তো আমরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবো। মনুষ্য জাতির কাছে আমার একটাই অনুরোধ। যদি তারা বেঁচে থাকতে একে অপরের সাহায্যে না আসতে পারে, তাহলে অন্তত মৃত্যুর পর অপরের সাহায্যে আসুক। কথাটা শুনতে অদ্ভুত লাগলেও কিন্তু এটা ঠিক কথা। আমার নতুন আবিষ্কার মানুষকে মৃত্যুর পরেও অন্যের উপকারের ক্ষেত্রে অনেক সাহায্যে আসবে। ভাবো আদিত্য, একবার ভেবে দেখো…. মৃত্যুর দশ মিনিটের মধ্যে সেই ইনজেকশনটা দিয়ে দিলেই বহু মানুষের উপকার হতে পারে। মৃত মানুষের বহু অঙ্গ.. যেমন কিডনি, লিভার, ফুসফুস আরও অনেক অঙ্গ বহু দিন পর্যন্ত ভালো থাকবে। অরগ্যান ব্যাংক খুলে সেখানে শরীরের সেই অঙ্গগুলোকে স্টোর করে রেখে দেওয়া যাবে। সেগুলো অনেক দিন পরেও অন্যের কাজে তো আসতে পারবে। কোলকাতাতেই খোলা হবে দেশের প্রথম অরগ্যান ব্যাংক। বেশ কিছু হিউম্যান অর্গ্যানের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আপাতত সেগুলো দিয়েই কাজ শুরু করা যাক।’
পর্ব – ৭
……………….
প্রায় বিকেল পাঁচটা বাজে। কোনও একটা কাজে নিজের অফিস থেকে বেরোলো অর্চিষ্মান। গাড়ি করে যেতে গিয়ে হঠাৎ রাস্তার এক ধারে দেখতে পেল প্লুটোকে। প্লুটো তাদের ফ্ল্যাটের পাশেই থাকে। বয়স আন্দাজ পনেরো বছর। ছেলেটা লেখাপড়ায় ভালো, সুন্দর ক্রিকেটও খেলতে পারে। সুন্দর চেহারা তার। অর্চিষ্মানের সাথে প্লুটোর বেশ বন্ধুত্ব। প্লুটো প্রায়ই অর্চিষ্মানকে বলে – ‘আমি তোমার মত তুখোড় অফিসার হতে চাই। কাজ করতে চাই এন এস ডব্ল্যূ’তে।’
অট্টহাস্য করে অর্চিষ্মান তখন বলে – ‘কিন্তু তুমি তো ভালো ক্রিকেট খেলো। ভালো খেলোয়ার হবে তুমি।’
‘না গো। আসলে কি জানো? নিজের বডি ফিট রাখার জন্য খেলাধুলো খুব দরকার। তাই খেলি।’
‘ছেলেটা একা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে করছেটা কী? স্কুল তো অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে হবে।’ মনে মনে ভাবলো অর্চিষ্মান।
নিজের গাড়ি নিয়ে এগোতে গেল সেই দিকে। প্লুটো স্কুল ড্রেসেই আছে। মানে স্কুল শেষে নিজের বাড়ি যায়নি সে। হঠাৎ অর্চিষ্মান দেখলো প্লুটোর সামনে সাদা রঙের এক বড় গাড়ি এসে থামলো। এই গাড়িকে চেনে না সে। প্লুটোর বাবার নিজের গাড়ি আছে। কিন্তু এটা সেই গাড়ি না। গাড়ির চালকের পাশের দরজাটা খুলে গেল। প্লুটো গাড়ির ভিতরে ঢুকলো। গাড়ির ভিতরে প্লুটো ছাড়া আর কে আছে, সেটা দেখতে পেলো না অর্চিষ্মান। প্লুটো গাড়িতে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিলো। এক অজানা গাড়িতে প্লুটোকে যেতে দেখে কিছু একটা সন্দেহ হলো অর্চিষ্মানের। অর্চিষ্মান পিছু নিলো সেই গাড়ির। বেশ খানিক এদিক ওদিক ঘোরার পর সেই সাদা গাড়িটা বালিগঞ্জের এক বড় অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে থামলো। অর্চিষ্মান নিজের গাড়ি বেশ কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়েছিল সে দিকে। সে দেখলো গাড়ি থেকে প্লুটো নামার সাথে সাথে চালকের আসন থেকে এক মহিলা নামলো। প্লুটোর দিকে বেশ হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে নিজের একটা হাত রেখে তাকে ভিতরে নিয়ে গেল। মহিলাকে চেনে না অর্চিষ্মান। একবার ইচ্ছে হলো ভিতরে গিয়ে দেখার, কিন্তু গেল না সে।
পর্ব – ৮
……………
বেশ গভীর রাত। অনেকক্ষণ হয়েছে অনন্যা ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম নেই অর্চিষ্মানের চোখে। নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে সে। একাগ্রচিত্তে কিছু দেখে যাচ্ছে সে। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলো অনন্যার। অর্চিষ্মানকে জেগে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো – ‘এখনও জেগে তুমি? কী ব্যাপার?’
মোবাইলের দিকে তাকিয়েই অর্চিষ্মান বলল – ‘আজ দু’দিন হলো অনন্যা, আমি নিজের তদন্ত শুরু করতে পারলাম না। তোমার রেফারেন্স হিসেবে দেওয়া প্রফেসার গুহ’র বইয়ের বিষয় অনেক পড়লাম। অনেক তথ্য জানতে পারলাম। তথ্যগুলো সঠিক হলেও জানি না কেন সেগুলো আমি মানতে পারলাম না। মনুষ্য জাতির বিলুপ্তের সম্ভাবনা তিনি দিয়েছিলেন প্রায় একশো বছর। বইটা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল। তাহলে বেশিরভাগ মানুষই আজ বিষাক্ত রেডিয়েশনের ফলে নিজের পুরুষত্ব হারিয়ে ফেলতো। খুব সম্ভব আমিও তার সাইড ইফেক্ট থেকে রক্ষা পেতাম না।’
‘কিন্তু এমনটা হচ্ছে অর্চিষ্মান। তুমি সার্ভে রিপোর্ট দেখো। আগের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে মহিলারা পুরুষের সঙ্গ ত্যাগ করছে। তাদের মধ্যে লেসবিয়ানের প্রবণতা অনেক বেশি মাত্রায় সজাগ হয়ে উঠেছে। এর পিছনে কোনও তো কারণ হবে।’
লেসবিয়ানের কথাটা বলতেই অর্চিষ্মানের মনে পড়ে গেল সপ্তর্ষির বাল্য বন্ধুর কথা। সে এখনও হাসপাতালে ভর্তি। অনন্যাকে সব কথাটা বলল সে। সব শুনে অনন্যা বলল – ‘তাহলে আমি ভুলটা কী বললাম তোমায়? অধিকাংশ বিবাহিত মহিলারা আস্তে আস্তে যদি লেসবিয়ান হয়ে যায় তাহলে দেশের জনসংখ্যা বাড়বে কী করে?’
‘সে সব তো ঠিক আছে অনন্যা। কিন্তু আমার একটাই প্রশ্ন। এই বিষাক্ত রেডিয়েশন কি শুধুমাত্র ইন্ডিয়াতেই আছে? রেডিয়েশন তো চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিদেশে তো বিজ্ঞান আমাদের দেশের থেকে অনেক বেশি উন্নত মানের। রেডিয়েশনের কুপ্রভাব তো বিদেশে আরও বেশি হওয়া উচিত। তাহলে সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে হ্রাস দেখা দিচ্ছে না কেন?’
বেশ ভালো প্রশ্ন তুলেছে অর্চিষ্মান। অর্চিষ্মানের প্রশ্নে চুপ থাকলো অনন্যা। নিজের মোবাইলটা অনন্যার হাতে দিয়ে অর্চিষ্মান বলল – ‘এই ভিডিওটা ভালো করে দেখো অনন্যা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতের হ্রাসের বিষয় সার্চ করতে গিয়ে এই ভিডিওটা পেলাম। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পুরনো ভিডিও।’
অনন্যা ভালো করে ভিডিওটা দেখলো। একটা মঞ্চ, কেউ একজন মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছে। মঞ্চের সামনে চেয়ারে বসে আছে বহু লোক। প্রায় কুড়ি মিনিটের ভিডিওটা মন দিয়ে দেখলো অনন্যা। সব শেষে বলল – ‘ভদ্রলোকটি কে?’
‘চিনতে পারলে না? একসময় বেশ ভালোই বিখ্যাত ছিলেন ইনি। তারপর হঠাৎ করে একদিন উধাও হয়ে গেলেন। এই বক্তৃতাটা দেওয়ার প্রায় পনেরো দিনের পর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পুলিশে মিসিং রিপোর্ট লেখানো হয়, কিন্তু কিছুই করতে পারে না পুলিশ। বাড়িতে ছিল তার স্ত্রী এবং দু’ বছরের ছেলে। পরবর্তী কালে তার স্ত্রী এবং পুত্র কোথায় চলে যায়, কেউ জানে না।’
‘স্ত্রী এবং পুত্রও মিসিং?’ প্রশ্ন করলো অনন্যা।
‘হুম। তারাও মিসিং। অদ্ভুত রহস্যময় কেস ছিল। ভদ্রলোকের নাম ডক্টর অনুপম ব্যানার্জী। শেষ বারের মত তাকে দেখা গিয়েছিল ডক্টর দিবাকর চৌধুরীর সাথে।’
‘ডক্টর দিবাকর চৌধুরী!’
‘ইয়েস ম্যাম। ডক্টর দিবাকর চৌধুরী.. যিনি আজকের দিনে মেডিক্যাল সাইন্স জগতে বিখ্যাত নাম। তিনি নাকি খুব ভালো বন্ধু ছিলেন অনুপম ব্যানার্জীর। এই ভিডিওটা ভালো করে দেখো অনন্যা। ডক্টর ব্যানার্জী একটা কথায় বিশেষ জোর দিয়েছেন। ওষুধের আসল কাজ হলো মানুষকে সুস্থ করা এবং মানুষের জীবন রক্ষার। মূল্য বৃদ্ধির কারণে ওষুধের দাম দিনে দিনে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। যে কারণে অধিকাংশ মানুষের কাছে লাইফ সেভিং ড্রাগ পৌঁছতে পারছে না। মেডিক্যাল সাইন্স যদি অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তুলতে না পারে তাহলে সেটা মেডিক্যাল সাইন্সের জন্য বিরাট পরাজয়। ওষুধের দাম কমাতে হবে। ওষুধের এমন দাম রাখতে হবে যাতে বহু গরীব মানুষের কাছে সে ওষুধ পৌঁছতে পারে। এটা হলো ডক্টর ব্যানার্জীর বক্তৃতার প্রথম বিষয়। এবার তার বক্তৃতার দ্বিতীয় বিষয় দেখা যাক। মূল্য বৃদ্ধির কারণ। এটা আমরা প্রত্যেকেই জানি যে আকাশ ছোঁয়া মূল্য বৃদ্ধির মুখ্য কারণ হলো অপ্রত্যাশিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর নিয়ন্ত্রণ আনা খুবই দরকার। যদি আমরা চুপচাপ বসে থাকি তাহলে কিছুতেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব না। তার জন্য কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। এক নতুন ধরনের ওষুধের গবেষণার কথা বলেছিলেন তিনি। কী ওষুধ সেটা জানা যায়নি। কারণ তার গবেষণা পুরো হয়নি।’
অর্চিষ্মানের মোবাইলটা এতক্ষণে খাটে রেখে দিয়েছে অনন্যা।
‘যখন গবেষণা পুরো হয়নি তখন এটা নিয়ে চিন্তা করে কী লাভ?’ অনন্যা জিজ্ঞাসা করলো।
‘একটু ভাবো অনন্যা। ডক্টর ব্যানার্জীর ভালো বন্ধু ছিলেন ডক্টর চৌধুরী। ডাঃ ব্যানার্জীকে শেষবারের মত তার সাথেই দেখা যায়। ডাঃ ব্যানার্জী কম মূল্যে ওষুধের কথা বলেছিলেন। পরবর্তী কালে ডাঃ চৌধুরী বহু মারণ রোগের ওষুধের আবিষ্কার করেছেন। প্রত্যেকটি ওষুধের মূল্যই কিন্তু কম। আজও ডাঃ চৌধুরী স্বল্প দামে গরীবের মধ্যে ওষুধ পৌঁছনোর কথা বলেন। কিছু তো একটা আছে অনন্যা যেটা আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে। একবার ডাঃ ব্যানার্জীকে ঝাঁকিয়ে দেখলে কেমন হয়?’
‘না, একেবারেই না। বলতে গেলে অসম্ভব।’ কথাটা উচ্চ কন্ঠে বললেন আবির্ভাব গাঙ্গুলী।
আবির্ভাব গাঙ্গুলীর কেবিনে বসে আছে অর্চিষ্মান।
‘কিন্তু কেন স্যার? প্রবলেমটা কোথায়?’
‘অদ্ভুত ব্যাপার তো? কোথায় প্রবলেম সেটা তুমি বুঝতে পারছো না? অর্চিষ্মান, আজকের দিনে ডক্টর দিবাকর চৌধুরী শুধুমাত্র ডক্টর কিম্বা গবেষক নন। তিনি একজন সেলিব্রেটি লেভেলের মানুষ। আজ যদি তার কাছে এন এস ডব্ল্যূ’র কোনও অফিসার জিজ্ঞাসাবাদ করতে পৌঁছে যায় তাহলে খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে। তার পর যদি কোনও সঠিক প্রমাণ না থাকে আমাদের কাছে তাহলে মিডিয়ার অসংখ্য প্রশ্নের বাণ কিন্তু আমাদের দিকেই ধেয়ে আসবে। তখন সামলাতে পারবে তো মিডিয়ার সেই তীক্ষ্ণ প্রশ্নগুলোকে? তুমি যা যা তথ্য আমায় দিলে, সেগুলো যদি আমি মেনেও নিই তাও তোমাকে ডক্টর চৌধুরীর থেকে কোনও প্রকারের জিজ্ঞাসাবাদ করতে আমি বারণই করবো।’
খানিক চুপ থেকে অর্চিষ্মান বলল – ‘ব্যাপারটা খুব গুরুতর স্যার। আমরা এটা পরিস্কার বুঝতে পারছি, এক সময় ডাঃ অনুপম ব্যানার্জী যে পদ্ধতিতে কাজ করার কথা বলেছিলেন সেই পদ্ধতিতেই পরবর্তী কালে ডাঃ দিবাকর চৌধুরী কাজ করতে শুরু করেন। এক সময় দু’জনের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্বও ছিল। স্যার, আমার বিশ্বাস ডাঃ ব্যানার্জীর অন্তর্ধানের কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে ডাঃ চৌধুরীর কাছে। সবটাই কাকতালীয় হতে পারে না। আর ডাঃ ব্যানার্জীর অন্তর্ধানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অনুপাতে হ্রাস হওয়ার রহস্যটাও। স্যার, আমার এক বন্ধু কাজ করে এক নামী নিউজ চ্যানেলে। আমি তার মাধ্যমে ডাঃ ব্যানার্জীর এক ইন্টারভিউ’এর ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে পারি। যদি তিনি রাজি হোন, তাহলে কেল্লা ফতেহ। আমি না হয় তার ক্যামেরা ম্যান হয়েই ভিতরে প্রবেশ করবো।’
পর্ব – ১০
…………….
অনেক্ষণ হলো সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। কোলকাতার রাস্তা ঘাট এখন আলোয় ঝলমল করছে। একটু আগেই একটা রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়েছে অর্চিষ্মান আর স্বপ্নীল বর্মন। সে কাজ করে এক বিখ্যাত নিউজ চ্যানেলে। আবির্ভাব গাঙ্গুলী থেকে অনুমতি পেয়ে গেছে অর্চিষ্মান। কিন্তু তিনি বলে দিয়েছেন – ‘খুব সামলে অর্চিষ্মান। একটুও যেন এদিক ওদিক না হয়। তাহলে আর ডিপার্টমেন্টের মান সম্মান থাকবে না।’
অনুমতি পাওয়ার পরেই অর্চিষ্মান ফোন করেছিল নিজের বন্ধুকে।
‘এক এমন খবর যা দুনিয়া কাঁপিয়ে দিতে পারে। আজ সন্ধ্যায় দেখা কর, তোকে সব বলবো।’
রেস্তোরাঁতে বসে অর্চিষ্মানের মুখে সব কথা শুনে স্বপ্নীল বলল – ‘তথ্যটা যদি এক পার্শেন্টও ঠিক হয় তাহলে সত্যি এ খবর দুনিয়া কাঁপাবে। কিন্তু ডাঃ চৌধুরী ক্যামেরার সামনে সব কথা বলবে কেন?’
‘সে কখনই ক্যামেরার সামনে সব কথা বলবে না। প্রশ্ন আমি করবো। আমাকে নিজের আসল পরিচয় দিতেই হবে। যাদের জানার তারা এটাই জানবে যে মিডিয়ার লোক এসেছে ইন্টারভিউ নিতে। ঘরের ভিতরে যে এন এস ডব্ল্যূ’র এক অফিসারও আছে, সেটা কেউ জানবে না। আমি জানি আমাকে ছদ্মবেশ নিতে হবে। তার জন্য আমি প্রস্তুত।’
‘ঠিক আছে। আমি ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করছি।’
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে দু’জনেই নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেল। বেশ কিছু দূর এগোবার পর রাস্তার এক মোড়ে অর্চিষ্মান কাউকে ঘাড় হেঁট করে বসে থাকতে দেখলো। অর্চিষ্মানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে চিনতে দেরি করলো না। গাড়ি দাঁড় করিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল অর্চিষ্মান।
‘তুমি এত রাতে এখানে কী করছো?’
প্লুটো ঘাড় উঠিয়ে অর্চিষ্মানের দিকে তাকালো। তার চোখ দু’টো কেমন ফুলে গেছে।
‘কী হয়েছে প্লুটো?’ অর্চিষ্মান তার পাশে বসলো। প্লুটো আবার ঘাড় হেঁট করলো।
‘তোমার যদি কোনও সমস্যা থাকে তাহলে আমায় বলতে পারো। আমি চেষ্টা করবো সাহায্য করার।’
এবার প্লুটো নিজের মুখ খুলল। বলল – ‘আমার সাহায্য কেউ করতে পারবে না। তুমিও না।’
‘চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? বলো।’ প্লুটোর মাথায় হাত রেখে অর্চিষ্মান বলল।
মাথায় হাত রাখতেই প্লুটোর দু’ চোখ বেয়ে জল বেরিয়ে এলো। কাঁদতে কাঁদতে প্লুটো যা বলল তার সারমর্ম হলো, প্লুটো এক মহিলাকে ভালোবাসতো। মহিলাটির সাথে হঠাৎই একদিন তার আলাপ হয় এক বাস স্ট্যান্ডে। মহিলাটির নাম মেঘমিত্রা। প্লুটোর মিশুকে স্বভাব। খুব তাড়াতাড়ি মহিলাটির সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলল সে। প্লুটোর স্কুল শেষ হলে তারা প্রায় দেখা করতো। বহুবার মেঘমিত্রা প্লুটোকে বালিগঞ্জে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেছে। মেঘমিত্রা সেই ফ্ল্যাটে একাই থাকতো। মেঘমিত্রাকে দেখতে সুন্দর। সে প্রায়ই প্লুটোর সামনে নিজের বস্ত্র পরিবর্তন করতো। বয়ঃসন্ধিতে পা রাখা প্লুটো ড্যাবড্যাব করতে তাকিয়ে থাকতো মেঘমিত্রার মসৃণ দেহর দিকে। প্লুটোর কথায়, তাদের মধ্যে প্রথম শারীরিক সম্পর্ক হয় গতকাল। কিন্তু তার পর থেকে মেঘমিত্রার কোনও পাত্তা নেই। প্লুটো বহুবার তাকে ফোন করেছে, কিন্তু বন্ধ পেয়েছে তার ফোন। তার ফ্ল্যাটে গেছে, কিন্তু বন্ধ পেয়েছে তার ফ্ল্যাট। প্লুটো মেঘমিত্রাকে ভালোবেসে ফেলেছে, তাই নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না।
অর্চিষ্মানের মনে পড়ে গেল সপ্তর্ষির বন্ধু শায়কের কথা। শায়ক আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। বিয়ের পর কোনও দিনই সে নিজের স্ত্রীকে শারীরিক সুখ দিতে পারেনি। তাই তার স্ত্রী আজ লেসবিয়ান। তার মানে কি শায়ক চিরকালই এমন ছিল? যদি শায়কের কথায় বিশ্বাস করা যায় তাহলে নিজের বয়ঃসন্ধি কালে সে নিজের এক শিক্ষিকার প্রেমে পড়েছিল। তার সাথে একবার শারীরিক সম্পর্কও হয়েছিল শায়কের। সেই শিক্ষিকাকে যে সে সেই বয়সে তৃপ্তি দিতে পেরেছিল সেটা এখনও স্বীকার করে শায়ক। তাহলে হঠাৎ করে তার শরীরে এমন ভয়ংকর পরিবর্তন ঘটল কেন? শায়ক খুব একটা নেশা করে না যার ফলে তার শারীরিক ক্ষমতার পতন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তাহলে কারণটা কী? হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো অর্চিষ্মানের। সপ্তর্ষি তাকে বলেছিল যে শায়কের সেই শিক্ষিকা তার পর কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছিল। শায়ক পরে জানতে পেরেছিল যে, সে চরিত্রহীন ছিল। শায়কের একাধিক বন্ধুর সাথে নাকি তার গোপন সম্পর্ক ছিল। কোনও মহিলা কি শুধুমাত্র নিজের শারীরিক খিদে মেটানোর জন্য এমন কাজ করবে? তাহলে তো সে শায়কের সাথে একাধিকবার মিলিত হতে পারতো। খেলা করতে পারতো সে শায়কের সাথে। শায়কের ঘটনাটা প্রায় বাইশ বছর আগেকার। এতদিন পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। শুধুই কি শায়ক আর প্লুটো? শায়কের বন্ধুরাও তো আছে। আছে হয়তো আরও অসংখ্য ছেলে। একটা ট্যাক্সিতে বসিয়ে প্লুটোকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় অর্চিষ্মান। নিজে এগিয়ে যায় বালিগঞ্জের দিকে।
চলবে….