গল্প- মাতৃঋণ

মাতৃঋণ
-মানিক দাক্ষিত

আজ পাঁচদিন হলো রতনের মা নিখোঁজ। থানায় ডায়েরী করে রতন উদভ্রান্তের ন্যায় চারদিকে হন্যে হয়ে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরিবারে মাকে নিয়ে চারটি প্রাণী। এখন
তিন। স্ত্রী, আট বছরের ছেলে টিঙ্কু আর নিজে। তিন বোন। সবাই বিবাহিতা। বাবাই মেয়েদের দেখেশুনে ভাল ঘরে বিয়ে দিয়ে গেছেন। গতবছর হঠাত্‍ স্ট্রোক হয়ে মারা
গেলেন। বাবার অঢেল বিষয় সম্পত্তির দেখাশোনার দায়িত্ব বর্তালো একমাত্র ছেলে রতনের ওপর। প্রথমটা ঘাবড়ে গেলেও বুদ্ধিমতী স্ত্রীর আন্তরিক সহযোগিতায়
ধীরে ধীরে বিষয়-সম্পত্তির বিষয়টা বেশ ভালভাবেই রপ্ত করে নিল। হঠাত্‍ মা নিখোঁজ হয়ে রতনের হিসাবটা কেমন যেন গরমিল হয়ে গেল। মায়ের শোকে রতন আজ পাগলপ্রায়। পাড়ার নানাজন নানা কথা বলে।
কেউ বলে-“রাক্ষসী বউটার জন্যেই ভালমানুষ শাশুড়ীটা স্বামীর ভিটে ছেড়ে বিবাগী হয়েছে। বড্ড দজ্জাল! কেবল একলা খাবো, একলা পড়বো!”
কেউ বলে- রতনটতো বউয়ের কথায় ওঠে-বসে।এক্কেয়ারে ভেড়ুয়া! এইসব দেখেশুনে কোন ছেলের মা সংসারে থাকতে পারে বলো!”
রতনের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে কেউ বলে-“বেচারা! মায়ের শোকে শেষমেষ ছেলেটা যেন মারা না পড়ে!” কথার খেই
ধরে ওপাড়ার পদীপিসি মনের আবেগে সুর করে বলে- “থাকবে না! মা বলে কথা! পৃথিবীতে মায়ের মত জিনিস আর কি আছে!”

আট বছরের টিঙ্কু সারা বাড়ী একা একা ঘুরছে। বাড়ীটা কেমন যেন থমথমে ভাব। স্বাভাবিক ব্যস্ততার চাকাটা কেমন যেন থমকে গেছে। কেউ এখন আর তাকে
খাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছে না। পড়ার জন্যে চোখ পাকাচ্ছে না। বাবাটা কেমন যেন হয়ে গেছে!
টিঙ্কু মাকে প্রশ্ন করে-“বাবা ঠাকুমাকে খুব ভালবাসতো, তাই না মা?”
আঁচলে চোখ মুছে মা বলে-“হ্যাঁ বাবা, সব ছেলে-মেয়েরাই মাকে ভালবাসে। ছেলে-মেয়েদের কাছে মা অনেক বড় বাবা।” বিজ্ঞের মত চোখ দু’টো বড় করে টিঙ্কু মাকে বলে-“মা স্বর্গের থেকেও বড়, তাই না মা?” মায়ের সংক্ষেপে উত্তর, “হ্যাঁ”।
সহজ সরল টিঙ্কু নিষ্পাপ ফুলের মত মুখটা মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করে- “তুমি ঠাকুমাকে ভালবাসতে?”
মা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। সামনে বসে
থাকা তিন ননদের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে- হ্যাঁ, আমরা সবাই তোমার ঠাকুমাকে ভালবাসতাম। তোমার ঠাকুমাতো আমারও মা।” রাগে অভিমানে আট বছরের টিঙ্কু চীত্‍কার করে ওঠে-“মিথ্যুক, তুমি এক নম্বরের মিথ্যুক। তুমি মিথ্যুক, বাবা মিথ্যুক। ভালবাসতে তো জমি-জায়গা নিয়ে সারাক্ষণ দু’জনে মিলে ঠাকুমার সাথে ঝগড়া করতে কেন!  ঠাকুমা কেন একা বসে বসে কাঁদতো! কেন তোমরা আমায় ঠাকুমার কাছে
যেতে দিতে না!” শিশুটার দু-গাল বেয়ে ঝরে
অবিরল অশ্রুধারা।

গত সন্ধ্যায় রতন থানার বড়বাবুকে বেশ কড়া করে দু-কথা শুনিয়ে এসেছে। বলেছে- “পুলিশের লোকগুলো সব অকর্মার ঢেঁকি। কোন কর্মের নয়। জলজ্যান্ত মানুষটা আজ পাঁচদিন নিখোঁজ। এখনও পর্যন্ত মানুষটার কোন হদিস মিলল না! করেন কি
আপনারা! নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমান!
নাকি পাওনা না পেলে গাওনা গান না!”
রাগে চীত্‍কার করে উঠেছেন বড়বাবু- “সাট-আপ, বাড়ী যান। কালকেই মাকে ফিরে পাবেন।”
রতনের ঠোঁটে অবজ্ঞার হাসি। মুখে বিড়বিড় করে বড়বাবুর বলা দু’টি শব্দ উচ্চারণ -“ফিরে পাবেন!”
পরের দিন বেলা দশটা। বাড়ীভর্তি লোক রতনের বাড়ীতে। থানার বড়বাবু সদলবলে ঢুকলেন।
রতনের প্রশ্ন-“মাকে পেয়েছেন?”
বড়বাবুর চটজলদী উত্তর- “পেয়েছি”
দু’জন ছাড়া বাড়ীভর্তি লোকের চোখে-মুখে প্রাপ্তির উল্লাস। রতনের বিস্ময় প্রশ্ন- “কোথায়?”
রহস্যময় মুখে বড়বাবু হাসতে হাসতে বললেন- “সেটা তো আপনি বলবেন!”
রতন রেগে যায়- “তার মানে?”
বড়বাবুর চোয়াল শক্ত হয়- “মেরে হাড়গোড় সব ভেঙে দেবো। সত্যি কথা বলুন, মা কোথায়?”
বড়বাবুর রক্তচোখ দেখে রতন একটু ঘাবড়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে- “কি বলছেন আপনি!”
বড়বাবুর চোখে-মুখে আত্মপ্রত্যয়-“ঠিকই বলছি, নিজের জালে নিজেই জড়িয়েছেন। আপনার দেওয়া বয়ানের সাথে আপনার স্ত্রীর বয়ান কিছুটা মিললেও আপনার ছেলের দেওয়া বয়ান সম্পূর্ণ আলাদা। আপনার এবং আপনার স্ত্রীর দেওয়া বয়ানে আপনার মা নিখোঁজ হয়েছিলেন সন্ধ্যাবেলায়। কিন্তু আপনার ছেলে বলেছে, রাতে শোবার সময় ঠাকুমার সাথে বাবা-মায়ের তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। সুতরাং.. রতন ভেঙে পড়ে। শীতেও তার শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম পড়ে। বড়বাবুর একটার পর একটা জেরার মুখে সে জেরবার হয়। স্বীকার করতে বাধ্য হয় সম্পত্তির লোভে সেদিন রাতে তার মাকে সে নিজের হাতে
খুন করেছে। চোখ পাকিয়ে বড়বাবু গর্জন করে ওঠেন-“লাশ কোথায়!”
রতন মাথা নীচু করে কাঁচু-মাচু হয়ে বলে- “সেপটিক ট্যাঙ্কে।”
বাড়ীভর্তি লোক হতভম্ব–হতবাক! শরীরের রক্ত সবার যেন হিম হয়ে আসছে..গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। কি ভয়ংকার ভাবে মাতৃঋণ পরিশোধ ছেলের!
বড়বাবু রাগে অন্ধ হয়ে সজোরে লাথি মারেন
রতনের পেটে। রতন হুমড়ী খেয়ে পড়ে টেবিলের ওপর। মাথা ফেটে যায়। জ্ঞান হারায় সে। টেবিলে সযত্নে রাখা কাঁচে বাঁধানো মায়ের ছবিটা বড়বাবুর পায়ের সামনে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে। বড়বাবু
সপ্রতিভ ভাবে তাকান ছবিটার দিকে। চমকে ওঠেন। এ-তো কোন নারীর রূপ নয়! এ-তো শাশ্বতকালের চিরন্তন জননীর রূপ। বুকে তাঁর একরাশ যন্ত্রণা! মুখে তাঁর করুণ আকুতি…যেন বলছেন- “বড়বাবু,
আমার রতনকে মারবেন না। অবুঝ। ক্ষমা করে দিন।”

Loading

One thought on “গল্প- মাতৃঋণ

Leave A Comment