লবি বনাম ঈশ্বর দা
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
কী চাও? লেখক , কবি, সাহিত্যিকের তকমা পেতে? তাহলে, কালক্ষেপ করোনা । লবিতে নাম লেখাও।
লবি চাই লবি। লবির আমি লবির তুমি করতে হবে। তেল দাও তেল, নইলে কপালে ঢংঢং। তুমি কোথায় কী দু’চার খানা রদ্দিমার্কা গল্প, কবিতা লিখেছ , সেগুলো ভদ্রলোকের পাতে দেওয়ার উপযুক্ত কিনা , সেসব মারো গুলি। কে কার ছ্যাঁদা দেখবে , অত সময় কই। লবিতে নাম লেখাও , দল পাকাও, গায়েগায়ে মাখামাখি করে গদগদ গলায় , দাদা দাদা, দিদি দিদি করো। লবির মাতব্বর দের ডাকা , নিজের ঢাক নিজেই পেটাও অনুষ্ঠানে, যথাযথ নিয়ম মেনে উপস্থিতি দিয়ে, ব্যাগার খাটো। গান গাইতে গাইতে দলবেঁধে, প্রভাত কিংবা সান্ধ্য ফেরী করো , চাঁদা দিয়ে সদস্য পদ নাও। টাকা দিয়ে ম্যাগাজিনে লেখা ছাপাও। পিকনিকে যাও। বৃক্ষরোপন অনুষ্ঠানে , লালপেড়ে শাড়ী জরিয়ে , শঙখ , উলুধ্বনি দাও।
অথচ , আপনি চেয়েছিলেন কবিতার মাঝে থাকতে।হয়ে গেলেন, লবির সদস্য। লেখালেখি গেল চুলোর দুয়ারে। এখন কেবল লবির দাসত্ব , তথাকথিত সাহিত্য সভায় করতালি দেবার যন্ত্র।
নেপোয় দই মারবে । নাম ফাটবে লবির মাতব্বর দের। আপনার কপালে ঢুঁঢু ।
রাধিকা বসু। সারা সপ্তা, সারা মাস, সারা বছর, তারচেয়ে বলা ভালো জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় কাটিয়ে দিলেন , স্বঘোষিত কবি মহোদয় দের ডাকা সারস্বত সভার সভাপতি কিংবা প্রধান অতিথির গুরুদায়িত্ব পালন করে।
কে এই রাধিকা বসু। কী পরিচয় ? এককথায় বলাযায় ইনিও স্বঘোষিত কবি। কী করে কবি হওয়া যায় ! কবি হওয়া যায় নাকি , দোকানদার হবার মতো? যায় । লবি লবি, স্রেফ লবি করে ভেজাল কবি অবশ্যই হওয়া যায়।
বাঁশবনে শিয়াল রাজা। গোঁজামিলের কবিতা পাবলিক নেবে কেন? তারা সব বোঝে। ওখানে ফাঁকিবাজি ক্যাচ কট হয়ে যাবে।
রাধিকা বসুর হাল কি আর বলবো। যে কোনও ওই ভেজাল কবিদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখুন । দেখবেন উনি মঞ্চ আলো করে বসে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওনাকে সম্বর্ধিত করা হবে। গলায় উত্তরীয় পরিয়ে , হাতে ফুলের তোড়া ধরিয়ে দেওয়া হবে। হাততালি হবে না , কিন্তু মাইকে হাততালি দেবার আবেদন জানালে, মৃদু টকাটক একটু শোনা যেতে পারে, তবে তা শুধু ক্ষণিকেরই নয়, নিষ্প্রাণও বটে।
এবার উনি বক্তব্য রাখবেন। উচ্চগ্রামে বাঁধা কন্ঠস্বর, একই মুখস্থ বুলি আওড়াবেন। নিজের লেখা একই কবিতার পুনরাবৃত্তি হবে।
হবেই তো। এছাড়া আর উপায় কী। আছেই তো ওই দু-এক খানা সম্বল। সাহিত্যের কথা বিশেষ পাওয়া যাবে না , তবে ফলাও করে আত্মপ্রচারের বাণী পাওয়া যাবে।আর পাবেন, নিকটবর্তী পাশের রাষ্ট্র এবং বাংলা ভাষার প্রতি তার কী অপরিসীম ভালবাসা, তার মোক্ষম বিজ্ঞাপন।
নবীন, এখন এই দলে নাম লিখিয়েছে। বিভিন্ন সাহিত্য সভায় হাজিরা দেয়। একেবারে পিছনের সারিতে বসে, জুলজুল করে তাকিয়ে দ্যাখে। মঞ্চে বসে থাকা লোকগুলোর বক্তৃতা শোনে। বোঝবার চেষ্টা করে, ওরা ওখানে, মানে উঁচুতে কেন! কোন দক্ষতা বা যোগ্যতা, ওদের উঁচুতে বসিয়েছে! এরা কারা? এদের নামও শোনেনি কখনো। এদের কথায় বিশেষ কিছুই নেই , যা ভাবতে শেখায়, মন আন্দোলিত হয়, মনেহয় ছুট্টে গিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ চাই , নাহঃ, তেমন কিছুই হয়না।
তবুও ওদের কথার শেষে, নিয়ম বশতঃ হাততালি দিতে হয়। ইচ্ছে করে না, তবুও দিতে হয়, নিয়ম।
নবীনের ভালো লাগে না। আজকাল তাই , এইরকম সভা গুলো এড়িয়ে যেতে চায়। ও ভাবে, এইভাবে অকারণ সময় নষ্ট না করে, এইসময় টুকু সে পড়বে। কিছু লিখবে। এদের কাছে কিছু জানার বা শেখার নেই। এইতো সময় , এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। অনেক দূর যেতে হবে। অনেকটা পথ। সভার ভীড় বাড়ানো হাততালি দেওয়া দর্শক হয়ে কী লাভ?
ঠিকই তাই। লাভ কী? এটাই মোক্ষম প্রশ্ন। লাভ ক্ষতির অঙ্কটা ঠিকঠাক বুঝতে পারা চাই। নবীন, দক্ষতা যোগ্যতার খোঁজ করছে। কিন্তু ওর কচিমাথা বুঝতেই পারেনি, ওখানে একটি বিশেষ জিনিস চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে , তার নাম, লবি। লবি তে গা ভাসাতে, দক্ষতা যোগ্যতার প্রয়োজন হয়না। শুধু তেলের দরকার হয়।হ্যা হ্যা করে হেসে, ট্যাংট্যাং করে গায়ে গা ঘসে যাও। দুহাত তুলে বলো, আমি আছি, আমি আছি। আমি তোমাদেরই লোক। বিশ্বাস অর্জন করো। শত্রু মিত্র বাছাই করতে শেখো। চুটিয়ে চুকলি করো। যখন যেমন, তখন তেমন পলিসি ধরো। খুঁজে খুঁজে, নামজাদা লোকেদের বাড়িতে মিষ্টির বিগ সাইজ বাস্ক নিয়ে যাও। ভাব জমাও। ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসো। জোঁকের মতো কামড়ে ধরো। রক্ত চুষে খেয়ে, টইটম্বুর গায়ে গতরে হয়ে , তাল বুঝে, ঝুপ করে খসে পরো। ব্যাস কম্ম ফতে। আর তোমাকে পায় কে। যাও, এবার তুমিও মঞ্চের মধ্যমনি হয়ে, জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা ঝাড়ো। এখন তুমিও কেউকেটা।
সেবার কলকাতা বইমেলায় ঈশ্বর দা র সঙ্গে দেখা। নবীন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো, বললো,,,
চিনতে পারছেন ?
নবীন, এখন আর নবীন নেই। চুলে পাক ধরেছে। মুখেও সময়ের ছাপ।
ঈশ্বর দা, একটুক্ষণ নবীনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন , লাভক্ষতির অঙ্কটা মিলিয়ে দিয়েছো দেখছি।
নবীন লজ্জা পাবার ভান করে বললো ,,,,,
কি যে বলেন,,, ভালো আছেন ঈশ্বর দা?
ঈশ্বর, নবীনের চোখে চোখ রেখে বললেন,,,,
খুব ভালো আছি , মনে। তবে, শরীরটা বুড়িয়ে গেছে।
নবীন, স্বান্তনা দেবার মতো করে বললো,,,,,,
তা ঠিক। কিন্তু এই বয়সেও তো নিজের পায়েই চলছেন , লাঠি নির্ভর তো হননি।
ঈশ্বর , মৃদু হেসে বললেন ,,,,
কোনও কালেই লাঠি নির্ভর হইনি। হতে চাইনি। অবলম্বন বড্ড খারাপ জিনিস। একবার অভ্যেস হয়ে গেলে, পরিত্যাগ করা মুশকিল। গুল্মলতা আর বৃক্ষের মধ্যে তফাৎ নিশ্চয়ই জানো। বৃক্ষ কেবল মাটিকে আশ্রয় করে আকাশ ছুঁতে চায়। গুল্মলতা চায় , বৃক্ষের অবলম্বনে আকাশ দেখতে। কিন্তু , মজার ব্যাপার কি জানো, কোনও কারণে বৃক্ষটি ধরাশায়ী হলে,, হা হা হা,,,,,,
ঈশ্বরের ওই হাসির মধ্যেই বাকি কথা গুলো লুকিয়ে ছিল। নবীনের তা বুঝতে অসুবিধে হলোনা। শুধু তাইনয়, এই কথার অভিমুখ যে তারই দিকে, তাও অন্তত তার বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। কেননা, সে-ও যে শেষপর্যন্ত এই সহজ পথটাই বেছে নিয়ে ছিল। নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে, লবি তে গা ভাসিয়ে ছিল। তাতে তার চলার পথ সুগম হয়েছিল। নানান সাহিত্য কমিটির মাতব্বর দের সঙ্গে ওঠাবসা , সঙ্গে রাজনৈতিক চাটুকারি যোগাযোগ। সুতরাং, এই হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে হাসতে পারলো না। বরঞ্চ একটু গম্ভীর গলায় বললো,,,,,,
সময় কিন্তু পাল্টে গেছে ঈশ্বর দা। আপনাদের সময় আর এই সময়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক, সেটা নিশ্চয়ই মানবেন।
ঈশ্বর স্বগতোক্তি করলেন ,,,,,,,,
সময় , কাল।,,,,,, কালের নিয়মে সময়ের বদল।
কিন্তু নবীন, নিয়মের কোনও বদল হয়েছে কী?
ধারা ? সহজে, বিনা পরিশ্রমে, অযোগ্যতা দুর্বলতাকে ধামাচাপা দিতে যে অনৈতিক পথ নেওয়া হতো , সেই প্রচলিত ধারার কোনও পরিবর্তন হয়েছে কী? না, হয়নি । হবেও না। তবে, একথাও ঠিক, আম আর আমড়া, সমমর্যাদা পায়না। যার যেথা স্থান, সে ঠিকই,,,,,,,,,,
ঈশ্বর দা কথা থামিয়ে দিলেন। নবীন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশ্বর দা , একটু ইতস্ততভাবে বললেন,,,,,,
কিছু মনে করোনা নবীন। আমি বোধহয় একটু বেশি বলে ফেলেছি।,,,,,
না ঈশ্বর দা , আমিই আসলে বেশি প্রত্যাশা করে ফেলেছি। লোভ ঈশ্বর দা লোভ। যশস্বী হবার লোভ। আপনাদের দেখে বড় হিংসে হতো। আপনার মতো লেখক দের সমকক্ষ হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, আজ বুঝতে পারি। ওই যে আপনি বললেন , যার যেথা স্থান। আম আর আমড়া। খুবই সত্যি কথা। লবি করে, আপনাদের মতো লেখক দের কাছাকাছি আসতে হয়তো পেরেছি। কিন্তু সাধারণ পাঠকের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারিনি। তাদের মনের সবটুকু জুড়ে , আপনার মতো প্রকৃত সাহিত্যিকের পাকাপোক্ত বাস। সেখানে আমার মতো লবিবাজ ভেজাল লেখক অপাংক্তেয়। আমাদের স্থান, ভেজাল সাহিত্য সভার উঁচু মঞ্চে। আর, আপনি আছেন , যোগ্যতায় দক্ষতায় প্রতিভায় পাঠক মনের মনিকোঠায়।
আপনাকে আর একবার প্রণাম করবার অনুমতি দিন ঈশ্বর দা।
নবীন নিচু হয়ে প্রণাম করতে গিয়ে দেখলো, সেখানে কেউ নেই। হাতের আঙুল ঠেকলো মাটিতে, বইমেলার ধুলো তে। মেলার মাইকে তখন ঘোষকের কন্ঠস্বর,,,,,
প্রখ্যাত সাহিত্যিক আমাদের অতি প্রিয় , প্রাণের লেখক , ঈশ্বর রায়ের অবিস্মরণীয় স্মৃতির উদ্দেশ্যে, উপস্থিত আমরা সবাই , একমিনিট নীরবতা পালন করবো।
নবীন , মখ তুলে , সন্ধ্যার কালো অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে , হাজারো তারার মধ্যে, ঈশ্বর দা কে খুঁজছিল। নবীন নিশ্চিত, সাহিত্যিক ঈশ্বর রায় , নিজস্ব উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করবেন চিরকাল। কোনও লবির প্রয়োজন হবেনা।।