দু’জন চরিত্র
-সন্দীপ দাস
১
বিকেলের পড়ন্ত রোদ কাঁচ ভেদ করে এসে পড়েছে টেবিল নম্বর আটের ঠিক মাঝখানে। প্রফেসর শঙ্কুর মত হাবভাবে অভ্যস্ত নায়ক বসে পার্কের ওখানেই। সামনাসামনি আজ প্রতিদিনের মত দুই হৃদয়। মিস শতরূপা এবং মিস্টার ঘটক। পেশায় দু’জনেই প্রফেসর। তবে ঘটকের কলেজ কর্মক্ষেত্র ইনস্টিটিউট অফ গো অন্বেষণ যেখানে গরুদের বিষয়ে বিভিন্ন রকমের শিক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে। আর শতরুপা চাকরি করে ওমেন বিউটি এন্ড স্কিন কেয়ার সেন্টারে, যেটি কলেজ কম বিউটি পার্লার বেশি বলাই চলে । আজ হঠাৎ করে এই দেখা নয়। কলেজের ছুটির পর দু’জনে এখানেই রোজই দেখা করে, শুধু ওই রবিবার ও সোমবার বাদ। ওইদিন যথাক্রমে ঘটক বাবু ও শতরুপার সেন্টার বন্ধ থাকে। সারাদিনের কাজের ব্যস্ততার পর দু’জনের এই ঘন্টাখানেকের আলাপচারিতাই আমাদের গল্পের সূত্র।
আজ সোমবার। দূরে চার্চের বড় ঘড়িটা ঢং ঢং করে পাঁচবার বেজে উঠলো। প্রফেসর ঘটক হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময়টা মিলিয়ে নিলেন একবার।
“এত দেরি করে না আজকাল। কি যে করে এতক্ষণ ধরে” , নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে চলেছেন তিনি, “এদিকে দু’ কাপ কফি শেষ হতে চললো। এর জন্য একদিন পথের ভিখারি হতে না হয় আমায় …… “
বলতে না বলতেই সামনে কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকতে দেখা গেল মিস শতরূপাকে। ঘটকের দিকে হাতটা নেড়ে এগিয়ে গেল চার নম্বর টেবিলের দিকে। চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে না বসতেই উল্টো দিক থেকে গম্ভীর গলায় ভেসে এলো, “পাক্কা পঁচিশ টাকা আই মিন পঁচিশ মিনিট লেট।” শতরূপা হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা একবার দেখে নিয়ে, তারপর উত্তর দিলো, “সরি জানু। একটু দেরি হয়ে গেলো। আসলে কি জানোতো ….. সব বলছি …. আগে দু’ কাপ কফি বলোতো। আজকেরটা আমার তরফ থেকে।” ঘটক পকেট থেকে একটা ডায়েরি আর পেন বার করে কি যেন লিখলেন আর তারপর জোরে হাঁক দিলেন …. “ওয়েটার ; টু কফি.. “
আসলে কি হয়েছে বলতো। আজ না ….. শতরুপার কথাটা শেষ হতে না হতেই মি.ঘটক বলে উঠলো , “আর কতদিন বাহানা দিয়ে যাবি বলতো নিশ্চই আজও হয় হেঁটে এসেছিস নয় অন্যের বাইকে। নিশ্চয়ই আজও তোর পার্স অফিসে ফেলে এসেছিস নয় বাড়িতে। নিশ্চয়ই আজও ….. পার্কে দেখা করতে আসবি আর পরের ঘাড় মটকাবি বারবার তা তো হতে পারে না রে।”
শতরুপার মুখ লাল হয়ে উঠলো। অপমান আর কত সহ্য করবে সে এভাবে। কিন্তু তবু সমস্ত রাগ সে হজম করে নিলো গরম কফির কাপে দু’ চুমুক দিয়ে।
পরিস্থিতি কয়েক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ। কফির পাত্রে ক্রমাগত চুমুক দিয়ে চলেছে তারা দু’জনেই। এভাবেই আধ ঘন্টা কেটে গেলো। হঠাৎ শতরূপা নিজের মধ্যেই বিড়বিড় করে উঠলো, “আমি কারুর ঘাড় ভেঙে খাই না। ঘাড় ভেঙে খাই ….. হু!!!! “
অভিনব ঘটক এর মধ্যে একটা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে নিজে ধরালো আর একটি বাড়িয়ে দিলো শতরুপার দিকে। শতরূপাও কিছু খুচরো পয়সা অভির দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে মনে করিয়ে দিল, “কুড়ি আছে। আজ এটুকুই ছিল। খাতায় মাইনাস করে রাখিস। বাই দা ওয়ে এই দামি সিগারেট কবে থেকে স্যার?”
অভিনব, লাইটারের আগুনটা শতরুপার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো , ” বাওবাসা। আমার ছাত্রদের। ওরাই দিয়েছে।”
শতরূপা বেশ অবাক হলো শুনে। মুখ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে বললো, “বাবা। তোর কত কদর রে কলেজে, এই খুশিতে পার্টি হয়ে যাক।”
মুহূর্তের মধ্যে উল্টো দিক থেকে উত্তর এলো, “বেশ কালকেই চলে আয়। সোনার বাংলা। দুপুর দু’টো.. দেরি করিস না যেন।”
“এমন একটা সিচুয়েশনে দেরি করা যায় নাকি” , হাসতে হাসতে উত্তরটা ছুঁড়ে দিয়েই দরজা ঠেলে বেড়িয়ে গেলেন ম্যাডাম। বিল পে করে অভিনব স্যারও ফলো করলেন তাকে।
২।।
আজ বেশ অস্থির লাগছে অভিনব ঘটককে। সোনার বাংলায় দল বেঁধে সকলেই উপস্থিত। শুধু ওই চিরাচরিত নিয়ম মেনে শতরূপা গড়গড়ি এখনো এসে উপস্থিত হন নি। এদিকে ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরা তাকে কত ভালোবাসে সেটা দেখানোর জন্য নিজেই এলাহী আয়োজন করেছেন। কিন্তু ম্যাডাম না এলে সবই বেকার। রাত জেগে মুখস্থ করে আসা ডায়লগ থেকে মেনু – সব টোটাল ওয়েস্ট।
নিজের মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন ঘটক স্যার।
“ইটস ইম্পসিবল টু বি ইম্পসিবল দ্যাট সি মিস আস।” আর তার মধ্যেই রাগে দাঁত ঘষতে ঘষতে মোবাইলটা বার করে ফোন লাগলেন তিনি।
“হোয়ার আর ইউ মাদাম? চিৎকার করে বলে উঠলেন। অপর দিক থেকে কোনো উত্তর এলো না, উল্টে কানেকশন কেটে গেল। আরো দু’ একবার সে চেষ্টা করলো বটে কিন্তু অপর দিক থেকে বারবার ফোন কেটে দেওয়া হলে ঘটক স্যার নিরুপায় দাঁড়িয়ে রয়ে গেল। দরজার কাছে দু’ একবার উঠে গিয়ে সে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু ফল কিছুই হলো না। কাউকেই কাছে পিঠে দেখতে না পেয়ে তার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো এবার। এভাবেই নির্দিষ্ট সময় থেকে প্রায় চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেলো। শতরুপার দেখা নেই। এদিকে রাগে ফুসছেন অভিনব স্যার। হঠাৎ পিছন থেকে দুই সিনিয়ার ছাত্র, দরজিয়া দে ও বন্ধ কর তার পিঠে দু’টো টোকা দিয়ে বললো, “স্যার, ষাঁড়ের মত মুখ করে কাকে খুঁজছেন?” ব্যাস আর পায় কে? এই কথা শুনে অভিনব স্যারের রাগ সপ্তম আকাশে গিয়ে ঠেকলো। চিৎকার করে বলে উঠলেন তিনি, “হট আপ। আই সারচিং বাদাম। ইউ ডোন্ট আন্ডার স্ট্যান্ড।” দরজিয়া হালকা হেসে যা উত্তর দিলো তাতে স্যার বেজায় ক্ষেপে উঠলেন। সে বলল, “স্যার বাদামি ইজ স্লিপিং ইন বেড অফ …..। ” ব্যাস আর পায় কে! অভিনব স্যারের স্ত্রী হলেন বাদামি। রেগে বাংলা হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে এক বিচিত্র ভাষায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, “মোজাক করতা হয় আমার ইস্ত্রি কো লেকর। আই কিল ইউ।” মুহূর্তের মধ্যে সে এক বিচিত্র পরিবেশ তৈরি হয়ে উঠলো গোটা রেস্টুরেন্টে। অভিনব স্যার একবার জুতো ছোঁড়েন আর চিৎকার করেন, বন্ধ কর…. কিল ইউ অল। আবার চিৎকার করেন, দরজিয়া দে …. কিল ইউ অল। রেস্টুরেন্টের মালিক তো হতবাক। কে কাকে কিল করবে কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।
ঠিক এমন এক মুহূর্তে পিছন থেকে এক যুবতীর হাসি শুনে থমকে দাঁড়ালেন স্যার। পিছন ঘুরে দেখেন শতরূপা ম্যাডাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন। অভিনব স্যার হাত থেকে জুতোটি মাটিতে ফেলে তৎক্ষণাৎ এগিয়ে গেলেন তার দিকে। বিচিত্র অবস্থার মধ্যেও এক গাল হাসি নিয়ে বললেন, ” বেল গম ” । ম্যাডাম হাসতে হাসতে এক বিশাল প্যাকেট অভিনব স্যারের হাতে ধরিয়ে বললেন , ” গিফটটা বলবেন কেমন লাগলো ? আর আজ যা খেল দেখালেন , তাতে পার্টি হয় না আর । গরুর পাঠশালায় থেকে থেকে আপনি পুরো ষাঁড় হয়ে গেছেন , স্যার । যা সম্মান করে না সবাই …. উফ কি ডেয়ারিং ইংরেজি ” । এটুকু বলেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন ম্যাডাম ।
স্যার কিছুক্ষন চুপ থাকার পর আস্তে করে হাঁক দিলেন , ” নকুলদানা , প্যাকেটটা খোল তো বাবা ” ।
স্যারের মুখ থেকে কথা খসতে না খসতেই নকুল স্যারের হাত থেকে প্যাকেটটি খুলতে শুরু করে দিল । কিন্তু একি ! এক নয় অন্তত বারোটা প্যাকেট মোড়া রয়েছে ভিতরে । একটার ভেতর আর একটা সুন্দর করে সাজানো । শেষ প্যাকেটটি খুলতেই ছাত্রের তো চক্ষু ছানাবড়া । একটা খাম ও পাশে একটা চিঠি রয়েছে । স্যার এর হাতে সেটাই সযত্নে তুলে দিলেন নকুল ।
অভিনব স্যার উপহার হিসেবে এটা আশা করেন নি কোনদিন । খামের ভেতরে একটা জামা প্যান্টের ও একটা শাড়ির ছবি সযত্নে রাখা । চিঠিতে লেখা আছে , ” টাকা কম ছিল তাই কিনতে পারি নি । আপনাদের দুজনকে ভারী মানাবে । দোকানের নাম ছবির পেছনে দেওয়া আছে । ওখানে গিয়ে আমার নাম বললেই দিয়ে দেবে ওরা । আপনি কিনে নিন আর টাকাটা ওই খাতায় লিখে রাখুন , আমি পরে চুকিয়ে দেবো । আর হ্যাঁ , কাল ড্রেসটা পড়ে এসো । একবার দেখবো কেমন লাগছে তোমায় ।
ইতি
শতরুপা “
চিঠি আর খামটা বন্ধ করতে করতে অভিনব স্যার খুবই নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলো , ” ডেয়ারিং মানে কি রে ” ? সমবেত কণ্ঠে উত্তর ভেসে এলো দারুন স্যার ।