জীবন নদী
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
ছন্দা, রান্নাঘরে চা তৈরিতে ব্যস্ত। শীতের সকাল, অলসতা কাটাতে চায়ের জুরি নেই। হঠাৎ ছাদের ওপর দমাদম শব্দ। কী হলো ব্যাপারটা। কে যেন ছাদের ওপর তাথৈ নিত্য করছে। কার এমন বেয়াক্কেলে কাজ! কে সেই নরাধম। পুরনো মান্ধাতা আমলের বাড়ি। চারিদিকে ফুটিফাটা হয়ে আছে। বর্ষায়, ঘরে জল টপকায়। কী আশ্চর্য রে বাবা। থামার নাম নেই, দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। ছন্দার শরীর যেমন ভারী, গলার আওয়াজও তেমন বাজখাঁই। হাঁক দিলেন- এই, কেরে…? কে লাফাচ্ছে ছাদে? ছাদ ভেঙে আমাদের চাপা দিয়ে মারতে চাইছে কে…?
ছাদ থেকে জবাব এলো- আমি, কেন? কী হয়েছে?
উনি, এবাড়ির কর্তা, সাধন দত্ত। ইনিও বিপুল বপুর অধিকারী। ওনার শরীরের নজরকাড়া অংশ হলো, ভুঁড়ি। ভুঁড়ি তো নয়, ঠিক যেন একটা বিগ সাইজ ধামা।
ছন্দা, রেগে কাঁই! তুমি ! আশ্চর্য… বলিহারি যাই বাপু। ওই বিশাল বপু নিয়ে তুমি ওই ফাটা ছাদে, তাথৈ নেত্য শুরু করেছো? বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে নাকি? হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লে কী সব্বনাশ হবে, সেই জ্ঞান আছে? নেমে এসো, চা হয়ে গেছে।
সাধন বাবুর ঠোঁটের গোড়ায় অনেক কথাই এসেছিল, চায়ের কথা শুনে, সেগুলোকে আবার যেখান থেকে এসেছিল, সেখানেই পাচার করে দিলেন। নেশা অতি বিষম বস্তু।
সাধন দত্ত, হাটখোলার বনেদি বংশের বংশধর। রাজত্ব গেছে বটে, কিন্তু রাজরক্তের আগুনে তেজ যায়নি। যাবেও না। আভিজাত্যের অহংকার বড় অভিমানী, তাকে ত্যাগ করা অসম্ভব।
চায়ে চুমুক দিয়ে ছন্দা বললেন- কী ব্যাপার, বুড়োবয়সে নাচানাচি শুরু করলে যে?
সাধন বাবু ব্যাজার মুখে বললেন- নাচানাচি নয়, ব্যায়াম।
ছন্দা যেন আকাশ থেকে নেমে এলো। ব্যায়াম ? তুমি? কবে থেকে?
-আজই শুভ সূচনা করলাম।
ছন্দা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। এই অলস, নিষ্কর্মার ঢেঁকি, ব্যায়ামে মনোনিবেশ করবে, এইটা ঠিক হজম হলো না, বললেন- ব্যায়ামের নাম কী, ডান্স মোটু ডান্স?
সাধন বাবু, একটু মুচকি হেসে বললেন- এই ব্যাপারটা আগে বুঝলে, আজ এই কথা শুনতে হতো না।
ছন্দা।
এই হেঁয়ালিপূর্ণ কথার মারপ্যাঁচ কিছুই বুঝতে না পেরে বললেন- তার মানে! তুমি ছাদে মিঠুন হয়ে দাপাবে, কেউ কিছু বলতে পারবে না! ছাদের কী হাল, তুমি জানোনা?
সাধন বাবুর মুখে এখনো সেই রহস্যময় হাসি, স্লিম স্লিম, এখন স্ললিমের যুগ। মোটকা ঢাউস, ময়দার বস্তার মতো ফিগার, এখন চলে না।
ছন্দার চোখের চাহনি বদলে গেল, অবাক হয়ে বললেন- কী ব্যাপার বলতো, কীসব বলছো, মাথার ঠিক আছে তো?
-হানড্রেড পারসেন্ট। এইযে, মিসেস দত্ত! আপনাকে বলছি, ইয়েস ম্যাডাম, আপনাকে… ব্যায়ামটা শুরু করুন, নইলে, ভোগান্তির একশেষ হতে হবে, এই বলে দিলুম।
ছন্দা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, কী যেন ভাবলেন, তারপর, হালকা গলায় বললেন -কথাটা মন্দ বলোনি। দিন দিন বড্ড ভারী হয়ে যাচ্ছি। দু’ পা হাঁটতে গিয়ে হাঁপিয়ে মরি। অসুখের যেন শেষ নেই বাপু। সব এই মোটা হবার কারণে।
সাধন বাবু, চোখ বুঁজে, মাথা নাড়িয়ে, দার্শনিকের মতো বললেন, মোটা কেউ কী হতে চায় , তবুও হয়ে যায়।
ছন্দা, ঝাঁঝিয়ে উঠলেন…থামো দেখি। গাদাগাদা তেল মশলা না হলে তো জিভে স্বাদ আসে না। ব্যায়াম করে ছাই হবে। ভুঁড়ি বাগিয়ে বসে আছেন গনেশ ঠাকুর হয়ে, বড়ো বড়ো লেকচার। যাও বাজার যাও। মাছ মাংস তেল মশলা সব বাদ। শুদ্ধু ঢ্যাঁড়স সেদ্ধ আর ভাত। তোমার মুখরোচক খাওয়ার ধুম, আজ থেকে বন্ধ। লুচি, পরোটা, পোলাও সব বন্ধ।
সাধন বাবু, ঠক করে টেবিলে চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালেন। রুদ্রমূর্তি…ফালতু কথা একদম বলবে না, আমি একা খাই? তুমি কি করো? খেয়েদেয়ে দুপুরবেলা ভোঁসভোঁস করে ঘুমোয় কে, আমি? আমাকে ঢ্যাঁড়স দেখাচ্ছে? তুমি গেলো ঢ্যাঁড়স, কচু….
কচুটা, বেশ জোরালো করে ছাড়লো।
ছন্দাও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়- মুখ সামলে কথা বলো! কচু? কচু কাকে দ্যাখাচ্ছ শুনি। অলক্ষুণে কথাবার্তা। ঘরের বউকে কেউ এসব কথা বলে, ছি ছি…
-কেন বলবো না। বেশ করেছি বলেছি। তুমি ঢ্যাঁড়স দেখাবে, আমি ছেড়ে দেবো।
ভুলে গেলে চলবে না। ছন্দার জাঁদরেল গলা, আমিও বেশ করেছি…তুমি সক্কাল বেলায় ছাদটাকে ব্যায়ামাগার করে তুলবে, তার বেলা কিছুনা ?
শীতের সকালে ঠান্ডা নয়, উত্তাপ বাড়ছে। কেউ কমতি যায় না…
বেশ করেছি, আমার বাবার ছাদ, আমি যা খুশি তাই করবো। ছাদে সুলভ কমপ্লেক্স করবো। বড় বাইরে পাঁচ টাকা, ছোট বাইরে দু’টাকা করবো, তাতে কার বাবার কী ?
ব্যাস হয়ে গেল। এইবার আঠারো দিনের কুরুক্ষেত্র শুরু।
-তুমি আমার বাপ তুল্লে…কান্না, ছন্দার মোক্ষম অস্ত্র। ঠিক আছে , থাকো তুমি তোমার বাবার এই ভুতুড়ে ভাঙা বাড়ি নিয়ে। ভুলে যেওনা, আমারও বাপের বাড়ি আছে। চললুম। খবরদার আনতে যাবে না , এই ব’লে দিলুম।
দুমদাম করে পা ঠুকে ঠুকে শোয়ার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো ছন্দা। এই দরজা কখন খুলবে, তা, মা মনসাই জানেন।
সাধন বাবুও মিলিটারি কায়দায় বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছন্দাকে শুনিয়ে বললেন, শোনো, ভালো করে কান খুলে শুনে রাখো, তোমার বাপের বাড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু, সেটা তোমার পাকাপোক্ত থাকার জন্যে নয়। দু’ দিনের জন্যে বেরাতে যাবার জায়গা। কথাটা মনে রেখো, হ্যাঁ… ঠাকুর বলেছিলেন, সংসারে থাক পাঁকাল মাছ হয়ে। অতই সোজা? ঠিক উল্টো হবে। সংসারের পাঁক, সারা গায়ে মাথায় মুখে মাখামাখি হয়ে গেছে। ও পাঁক পরিস্কার হবার নয়। ছেলে, ছেলের বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। বাঁচা গেছে। রোজ ঝামেলা, রোজ খুঁত ধরার কম্পিটিশন। মাছের মুড়ো নিয়েও অশান্তি। দরকার নেই মা আমার। আলাদা করে রেঁধে বেড়ে খাও। বুঝবে ঠ্যালা। রোজ বাজার যাও, দরদস্তুর করে মাছের বাজারে ল্যাজেগোবরে হও, মুদির দোকানের ফর্দ সামলাতে ভিরমি খেতে হবে। খুব ভালো হয়েছে। দ্যাখ কেমন লাগে…
আরে ভাই, এর নাম সংসার। অত সহজ নয় রেহাই পাওয়া। বিষফোঁড়া ফেটে গেল, পুঁজ রক্ত বেরিয়ে গেল, আহা, কী আরাম। কিন্তু, সন্তান যখন বিষিয়ে যায়, বিষফোঁড়া কেন, বিষধর কোবরাকেও হার মানায়।
কদিন যাবৎ নতুন একটা উৎপাত শুরু হয়েছে। ছেলের বউ, ছেলেকে উস্কানি দিচ্ছে। বাড়িটা বাপের কাছ থেকে লিখিয়ে নেবার জন্যে।
নির্লজ্জতা আর স্বার্থপরতার বোধকরি , কোনও সীমা থাকে না। আগে কায়দা করে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতো- একটা লেখাপড়া করে রাখা ভালো। মানুষের কথা তো বলা যায় না, কখন কী হয়… তাই…।
কিন্তু বিগত কয়েক মাস যাবৎ ব্যাপারটা জোর খাটানোর পর্যায়ে গেছে। খানিকটা যেন, ভয় দেখানো হুমকির সুর। দেখে নেওয়া গোছের ব্যাপার। দত্ত দম্পতির আপত্তি এখানেই। তুই তো না চাইলেও পেতিস। চেয়েই ভুল করলি। বুদ্ধি যে-ই যোগান দিক, ক্ষতি কিন্তু ছেলের। সম্পত্তির কথা ছেড়েই দিলাম, ভালবাসা? বিশ্বাস? আস্থা? সবই হারাবি। এ অমূল্য ধন, গেলে আর ফেরেনা।
আরে বাবা মোলে তো তোরাই ভোগদখল করবি। অত তাড়া কিসের,,?
ছন্দা ব্যবসায়ী বাপের মেয়ে। লাভ ক্ষতির হিসেব খুব বোঝে। বললেন, খবরদার বলে দিলুম, ভুলেও ওদের ফাঁদে পা দিও না। এসব ওই বউয়ের বুদ্ধি। ওই শেখাচ্ছে। সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে শেষে পাখি উড়ে যাবে। আমাদের পথে বসাবে।
সাধন বাবু, খেঁকিয়ে উঠলেন… থামোতো, সব বউ শেখাচ্ছে…তোমার ছেলে শিখছে কেন! ওকি ছেলেমানুষ! নিজস্ব বুদ্ধি নেই। পরের মেয়ে কে দোষ দিয়ে কী হবে! নিজের রক্তই যখন ঠিক নেই।
যাক, ওসব নিয়ে মাথা খারাপ করে লাভ নেই। ভেবে দেখি, কিছু তো একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
ছন্দা, কথায় সায় দিয়ে বললেন… অবশ্যই , ব্যবস্থা একটা করতেই হবে।
দোতলার এই বারান্দাটা, দত্ত দম্পত্তির ভারী পছন্দের। দু’জন দুটি চেয়ার পেতে, অল্প দূরে বহমান গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকেন। নিপাট শান্তি। অনেক খোঁজখবর করে শেষপর্যন্ত এই ফ্ল্যাট টাই পছন্দ হলো। নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ, সর্বোপরি সম্মুখে বহমান গঙ্গা। চুনাপুকুর লেনের সেই পুরনো বাড়িটা স্থানীয় এক প্রভাবশালী প্রমোটারের কাছে বেচে, এই ফ্ল্যাট কেনা। ছেলে কেও বঞ্চিত করেননি। তাকেও তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। তবে, সম্পর্কের ইতি।পাওনাগণ্ডার হিসেবনিকেশ, রক্তের সম্পর্ক কে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে। শকুনের বাসা বাঁধা গাছে , কোকিলা গান করে না।
এখন ফাগুনের মাঝামাঝি। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ। অন্ধকার বারান্দায় পাশাপাশি বসে দত্ত দম্পতি। লন্ঠনের আলো জ্বেলে, ভেসে যাওয়া জেলে নৌকার দিকে তাকিয়ে, মনেমনে স্মৃতির অতলে কতকিছুই খুঁজছিলেন।
নীরবতা ভেঙে ছন্দা বললেন… কী ভাবছ ?
_ নাঃ, কিছুনা ,,
_ ভেবো না, অকারণে মন ভারী করোনা।
_ অকারণে? কী বলছ, তুমি জানো!
_ আমি মা হয়ে জানবোনা? তাইকি কখনও হয়!
_ তবে ?
_ আমরা তো আমাদের কর্তব্য করেছি। সেখানে তো কোনও ফাঁকি নেই , তঞ্চকতা নেই। এই-বা কম কী। প্রতিদানে কোনও প্রত্যাশা রেখোনা , দুঃখ পাবে।
_ কিন্তু , সম্মান ! প্রতিদানে ভালবাসা, সম্মান আশা করাও কি ভুল? অন্যায় ?
_ অমানুষের কাছে ভালবাসা, সম্মান প্রত্যাশা শুধু ভুলই নয়, চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয়।
সাধন বাবু , চুপটি করে বসে রইলেন। চোখ গঙ্গার দিকে স্থির।মনেমনে বললেন , ঠিক বলেছো ছন্দা, ঠিক বলেছ, একদম ঠিক।
-ঘরে চলো। রাত হয়েছে। কাল ভোরবেলা উঠে ওই গঙ্গার ধারে , ডান্স মোটু ডান্স ব্যায়াম, প্রাণ ভরে চালিও, কেউ আর চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে বাধা দেবে না। এখন শোবে চলো…
কোথা থেকে যেন গান ভেসে আসছিল। রবীন্দ্র সঙ্গীত….
এবার নীরব করে দাও হে তোমার
মুখর কবি রে… এবার